ক্যালেন্ডারের পাতায় আজ ১৩ এপ্রিল। বাংলাদেশের ক্রিকেট ইতিহাসের গৌরবান্বিত এক দিন। এই দিন কেনিয়াকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো আইসিসি ট্রফি জয় করে। আইসিসি ট্রফি জয়ের ফলেই খেলতে পেরেছিলাম বিশ্বকাপ, পেয়েছিলাম দ্রুতই ওয়ানডে আর টেস্ট স্ট্যাটাস।
আইসিসি ট্রফির সেমিফাইনালে স্কটল্যান্ডকে হারিয়ে বিশ্বকাপের টিকেট নেয়ার পাশাপাশি ফাইনাল খেলাও নিশ্চিত করে বাংলাদেশ। ফাইনালে প্রতিপক্ষ তখনকার শক্তিশালী দল কেনিয়া, যারা ১৯৯৬ সালের বিশ্বকাপ খেলেছিল এবং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে ৭৩ রানে হারিয়ে তখন ওয়ানডে ফরম্যাটে ইতিহাসের সেরা অঘটনের জন্ম দিয়েছিল। ওয়ানডে ক্রিকেটের ইতিহাসে বাংলাদেশের ২০০৫ সালে অজিদের হারানোর পর এই ম্যাচটাকেই এখনও সবচেয়ে বড় অঘটন হিসেবে গণ্য করা হয়। সেমিফাইনাল ম্যাচের মতো ফাইনাল ম্যাচেও যথারীতি বৃষ্টি বাগড়া দিয়েছিলো। রিজার্ভ ডে থাকার কারণে সিদ্ধান্ত নেয়া হয় দুইদিন ধরে খেলা হবে। এক দল প্রথম দিন ও আরেক দল দ্বিতীয় দিন ব্যাট করবে। খেলা হবে ৫০ ওভার। সেই স্বপ্নজয়ের পিছনের গল্পগুলো একটু বাক্সবন্দী করে শোনা যাক।
৯৬ এ স্বপ্নভঙ্গ
১৯৯২ সালে জিম্বাবুয়ে টেস্ট স্ট্যাটাস পাওয়ার পর আইসিসি ঠিক করল ১৯৯৬ সালের জন্য সহযোগী দেশগুলা থেকে ৩ টি দেশ নেওয়া হবে। স্বপ্ন দেখার পালা শুরু হল বাংলাদেশের জন্য।
প্রথম পর্বে আরব আমিরাতের কাছে হারার পরেও স্বপ্ন টিকে থাকল। দ্বিতীয় রাউন্ডে শুরুতে হল্যান্ডের কাছে হারার পরেও একটা আশা ছিল। তবে তার জন্য কেনিয়াকে হারাতেই হবে। প্রথম ২৫ ওভারে ১০০ এরও কম রান তোলা কেনিয়া করল ২৯৫। ১৯৯৪ সালে ৫০ ওভারের খেলায় ২৯৫ ভয়াবহ রান। বাংলাদেশের মানুষ তাও আশায় বুক জিইয়ে রাখল। ওপেনিং জুটি অবিশ্বাস্যভাবে রান তুলছে। জাহাঙ্গীর আর বুলবুল দু’জনেই ব্যক্তিগত অর্ধশত পার হয়ে গেছে। রানরেট ঠিক আছে। শেষ রক্ষা হয়নি। বাংলাদেশ তুলতে পেরেছিল ২৮২। ৯৬ বিশ্বকাপে তাই আর বাংলাদেশের আর খেলার সুযোগ হয়নি।

১২ই এপ্রিল, ১৯৯৭ : স্বপ্নজয়ের শুরুর দিন
বাংলাদেশ দলের অধিনায়ক আকরাম খান টস জিতে ভারী আউটফিল্ড থাকার কারণে ফিল্ডিং বেঁছে নেন। টাইগার পেসার সাইফুল ইসলাম প্রথম ওভারেই উইকেট তুলে নেন আসিফ করিমকে বোল্ড করে। শুন্য রানেই প্রথম উইকেট হারিয়ে বসে কেনিয়া। দলীয় ১৫ রানে ওয়ান ডাউনে নামা উইকেটকিপার ব্যাটসম্যান কেনেডি ওটিয়েনো এলবিডব্লিউ হয়ে ফিরে যান, বোলার সেই সাইফুল। তারপর সঞ্জীব গুপ্তা ও কেনিয়ার ক্রিকেট ইতিহাসের সেরা ব্যাটসম্যান স্টিভ টিকোলো দলের হাল ধরার চেষ্টা করেন। সঞ্জীব গুপ্তা-স্টিভ টিকোলো জুটি ৪৩ রান যোগ করার পর কেনিয়ার দলীয় ৫৮ রানে খালেদ মাহমুদের বলে ফিরতি ক্যাচ দিয়ে ফিরে যান গুপ্তা। তারপর ক্রিজে আসেন অধিনায়ক মরিস উদম্বে। এই জুটি বাংলাদেশের বোলারদের নাকাল করে ছেড়ে দেয়।
চতুর্থ উইকেটে টিকোলো-উদম্বে ১৩৮ রানের জুটি গড়ে ফেলার সময় বিশাল রানের পাহাড়ে চাপা পড়ার শঙ্কায় তখন কোটি টাইগার সমর্থকদের মনে। এমন সময়ে ত্রাতা হয়ে আসলেন অভিজ্ঞ মোহাম্মদ রফিক। ব্যক্তিগত ৪৩ রান করে পাইলট তার বলে উদম্বেকে স্ট্যাম্পিং করলে ১৯৬ রানে চতুর্থ উইকেটের পতন হয় কেনিয়ার।
পরে কেনিয়ার পেস অলরাউন্ডার টমাস ওদোয়ো দলীয় ২১২ রানের সময় মাত্র ১ রান করে বোল্ড হয়ে যায়। রানের গতি তখন কমতে শুরু করে। দলীয় ২৩০ রানে খালেদ মাহমুদের বলে সাইফুল দারুণ এক ক্যাচ ধরলে শেষ হয় স্টিভ টিকোলোর ১৪৭ রানের মহাকাব্যিক ইনিংস, যা তিনি খেলেছিলেন ১২টি চার ও ৩ ছক্কার সাহায্যে। ১৫২ বলে খেলা এই ইনিংস ছিল প্রথমে ধরে খেলা তারপর মেরে খেলার এক অনন্য দৃষ্টান্ত। টিকোলো আউট হলে রানের পাহাড়ে চাপা পড়ার সব সংশয় দূর হয়ে যায়, কারণ ৬ উইকেট পড়ে যাওয়ার পর কেনিয়ার টেল এল্ডাররাই ব্যাট করতে আসা বাকি ছিল। শেষ ওভারের শেষ বলে টনি সুজিকে স্ট্যাম্পিংয়ের ফাঁদে ফেলেন রফিক, কেনিয়ার স্কোর দাঁড়ায় ৭ উইকেটে ২৪১ রান।
কেনিয়ার ইনিংস শেষের মধ্য দিয়ে প্রথমদিনের খেলার সমাপ্তি ঘটে। একটা সময় টিকোলো আর উদম্বে এমনভাবে ব্যাট করছিল যে রান ৩০০ এর কাছাকাছি যাবে মনে হচ্ছিল। কিন্তু পরে উইকেট তুলে বোলাররা ম্যাচে ফিরিয়ে আনে দলকে। রফিক ৩টি , সাইফুল ও সুজন ২টি করে উইকেট নেন। ২৪১ বড় রান না হলেও বৃষ্টি ভেজা মাঠ বিবেচনায় মোটেও কম রান ছিল না। কন্ডিশন নিয়ে কিছুটা চিন্তার ভাঁজ নিয়েই সেদিন রাত পার করে দেশবাসী। তবে অজানা এক আত্মবিশ্বাস ১১ কোটি মানুষের হৃদয়ে ভর করেছিল যে আমরাই জিততে চলেছি।
১৩ই এপ্রিল, ১৯৯৭ : স্বপ্নজয়ের দিন
বাংলাদেশ সময় সকাল সাড়ে ৭টায় খেলা শুরু হবে। কিন্তু মুষলধারে বৃষ্টি হচ্ছে কুয়ালালামপুরে, ম্যাচ অনিশ্চিত! মাঠের ড্রেনেজ সিস্টেম তেমন ভালো নয়। আগের দিন সারারাত বৃষ্টির পর সকালেও তা থামেনি। সব মিলিয়ে পরিস্থিতি যেন একেবারেই অনুকূলে ছিল না। একসময় বৃষ্টি থামলেও মাঠ পানিতে ভেসে গেছে!! ড্রেনেজ সিস্টেম ও তেমন ভালো ছিল না।

তবে সকলের প্রচেষ্টায় একসময় মাঠ থেকে পানি সরানো গেল, সূর্য মামা উঁকি দিল! মাঠ শুকানোর পালা এবার। অবশেষে এলো সুখবর! সবার অক্লান্ত, আন্তরিকতা আর অবিশ্বাস্য পরিশ্রমের পর জানা গেল বাংলাদেশ সময় দুপুর দেড়টায় শুরু হবে ম্যাচ! এই ঘোষণার পর যেন চিৎকার করে উঠল টেকনাফ থেকে তেতুলিয়া! অনেক দেরিতে ম্যাচ শুরু হওয়াতে জানাই ছিল ওভার অনেক কমে যাবে। তখনকার নিয়ম ছিল কোনো দলকে কমপক্ষে ২৫ ওভার ব্যাট করতে হবে। সেই সময় পাওয়া না গেলে ম্যাচ পরিত্যক্ত হবে। কোনোমতে ২৫ ওভারই পাওয়া গেল। কিন্তু বৃষ্টি আইনে বাংলাদেশের টার্গেট দাঁড়াল ১৬৬ রান। দেশবাসীর মাথায় হাত! ওভারে ৬ এর ওপরে রান তুলতে হবে দলকে।
কোটি মানুষের আশঙ্কার ভেতরেই দুই ওপেনার ব্যাট করতে নামলেন। এখানেই চমক, দুর্জয়ের সাথে আতাহারকে না নামিয়ে পাঠানো হলো হার্ড হিটিং করতে পারা রফিককে! অর্থাৎ জয়ের জন্য যা করা দরকার তেমন সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল টিম ম্যানেজমেন্ট। স্ট্রাইকে তখন দুর্জয়, তিনি প্রথম ওভারের প্রথম বলেই পেসার মার্টিন সুজির বলে বোল্ড হয়ে গেলেন। শুরুতেই এমন আঘাত ছিল টাইগার সমর্থকদের জন্য হৃদয়ে বজ্রাঘাত! তারপর নান্নু ব্যাট করতে নামলেন আর রফিক ঝড় তোলা শুরু করলেন। টিম ম্যানেজমেন্টের সিদ্ধান্ত সঠিক প্রমাণ করে রফিক খুব দ্রুত নান্নুর সাথে ৫০ রানের জুটি গড়ে ফেলেন। ঠিক তখনই ১৫ বলে ২ চার আর ২ ছক্কার কল্যাণে ২৬ রান করে রফিক আউট হয়ে যান।
দলীয় ৬৩ রানে নান্নুও ব্যক্তিগত ২৬ রান করে আউট হয়ে গেলে দল একটু চাপে পড়ে যায়। তারপর অধিনায়ক আকরাম খান আর সহ-অধিনায়ক আমিনুল ইসলাম বুলবুল দারুণ একটা সময় উপযোগী জুটি গড়েন। আকরাম খান এমন এক বিশাল ছক্কা মেরেছিলেন, যা স্টেডিয়ামের বাইরে চলে যায়! রান রেটের সাথে পাল্লা দিয়ে দারুণ এগিয়ে যাচ্ছিলেন তারা। আকরাম-বুলবুল ৫৩ রানের জুটি গড়ার পর আসিফ করিমের বলে ৩৭ রান করে বোল্ড হয়ে যান বুলবুল। দলের রান তখন ১১৬, জয় থেকে মাত্র ৫০ রান দূরে। বুলবুল আউট হলেও সোজাই মনে হচ্ছিল এই মহামূল্যবান জুটির পর হাতে ৬ উইকেট থাকার কারণে। কিন্তু দলের ১১৮ রানে আকরাম ব্যক্তিগত ২২ রান করে ও ১২৩ রানে এনামুল হক মণি মাত্র ৫ রান করে আউট হলে কেনিয়া ভালোভাবেই ম্যাচে ফিরে আসে এবং চাপে পড়ে যায় বাংলাদেশ।
ক্রিজে তখন সাইফুল ইসলাম আর অভিজ্ঞ বীর সেনানী খালেদ মাসুদ পাইলট। দলের প্রয়োজনে ১৩ বলে ১৪ রানের মহামূল্যবান একটা ছোট অথচ ইতিহাস গড়তে যাওয়ার জন্য গুরুত্বপূর্ণ ইনিংস খেললেন সাইফুল। যার ভেতর একটা ছক্কার মার ছিল। ১৩৯ রানে সপ্তম ব্যাটসম্যান হিসাবে সাইফুল আউট হলে দল আবার বিপদে পড়ে। রান রেট বাড়তে শুরু করেছে আর উইকেট পড়ে যাচ্ছে একের পর এক। এরপর সুজন ক্রিজে আসলেন। পাইলট একটি ছক্কা এবং খালেদ মাহমুদ সুজন একটি বাউন্ডারি মারায় একটু স্বস্তি ফিরে আসে টাইগার শিবিরে। কিন্তু জয় থেকে ১৫ রান দূরে থাকতে সুজন মাত্র ৫ রান করে স্ট্যাম্পিংয়ের শিকার হলে ৮ উইকেট পড়ে যায় টাইগারদের।
স্বপ্নজয়ের মুহূর্ত

২৪ ওভার শেষ, রান তখন ৮ উইকেটে ১৫৫। শেষ ৬ বলে ১১ রান দরকার। স্ট্রাইকে ছিলেন খালেদ মাসুদ পাইলট। প্রথম বলে ছক্কা হাকালে সমীকরণ সহজ হয়ে যায় বাংলাদেশের জন্য। পরের পাঁচ বলে দরকার পাঁচ রান। স্নায়ু চাপের ম্যাচে দ্বিতীয় বল ডট দেন। ফলে সমীকরণ কঠিন হলেও তা আর সমস্যার কারণ হয়নি দলের জন্য। পরের ৪ বলে ৫ রান নিয়ে দলকে জয়ের বন্দরে নিয়ে যান জয়ের কান্ডারী খালেদ মাসুদ পাইলট।
গোটা দেশ তখন মেতে উঠেছিল রঙ খেলায়। রাস্তায় নামা মানুষজন কেউ সেই রঙ লাগা থেকে রেহাই পাননি! এমন অবিস্মরণীয় অর্জন নিয়ে আসলে লেখা শেষ হওয়ার নয়। কারণ এই বিজয় ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধের পর আবারো সবাইকে এক সুতোয় গাঁথতে পেরেছিল।