মুসলমানদের জন্য রমজান মাস হলো শ্রেষ্ঠ নেয়ামতের মাস। এই রমজান মাসের ফজিলতপুর্ন ইবাদতগুলোর মধ্যে অন্যতম ইবাদত হলো ইতিকাফ। নবী করিম (সা.) ইতিকাফের এত বেশি গুরুত্ব দিতেন যে কখনো তা ছুটে গেলে ঈদের মাসে আদায় করতেন। তিনি বলেন, ‘যে ব্যক্তি সারাজীবনে একদিন হলেও ইতিকাফ করবেন, কিয়ামতের দিন জাহান্নাম তার কাছ থেকে ১৫শ’ বছর পথ দূরে থাকবে।’
ইতিকাফ কি
এটি আরবি শব্দ। এর আভিধানিক অর্থ হচ্ছে বিচ্ছিন্নতা, নিঃসঙ্গতা, অবস্থান ইত্যাদি। শরিয়তের পরিভাষায়, আল্লাহর নৈকট্য লাভের আশায় জাগতিক কার্যকলাপ ও পরিবার পরিজন থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে মসজিদ বা ঘরের নির্দিষ্ট স্থানে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত অবস্থান করা বা স্থির থাকাকে ইতিকাফ বলে।
রাসুল (সাঃ) নিজে ইতিকাফ করেছেন এবং সাহাবাদেরকেও উৎসাহিত ও অনুপ্রাণিত করেছেন। তিনি বলেন, ‘মসজিদ মুত্তাকিদের ঘর। যে ব্যক্তি ইবাদতের উদ্দেশ্যে মসজিদে অবস্থান করবে আল্লাহ তার প্রতি শান্তি ও রহমত নাজিল করবেন এবং পুলসিরাত পার-পূর্বক বেহেশতে পৌঁছবার জিম্মাদার হবেন।’
কুরআন ও হাদিসের আলোকে ইতিকাফের ফজিলত ও গুরুত্বঃ
রমজানের শেষ ১০ দিন মসজিদে ইতিকাফ করা সুন্নাতে মুয়াক্কাদা-ই-কিফায়া। মহল্লার কোনো একজন ব্যক্তি ইতিকাফ আদায় করলে সবার পক্ষ হতে আদায় হয়ে যায়। কেউ যদি ইতিকাফ না করেন তবে সবাই সুন্নাত ত্যাগের জন্য দায়ী থাকবে।
পবিত্র কুরআনে বিভিন্নভাবে এটি সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে। মহান আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেন,
وَعَهِدۡنَآ إِلَىٰٓ إِبۡرَٰهِۧمَ وَإِسۡمَٰعِيلَ أَن طَهِّرَا بَيۡتِيَ لِلطَّآئِفِينَ وَٱلۡعَٰكِفِينَ وَٱلرُّكَّعِ ٱلسُّجُودِ–( البقرة: ١٢٥)
এবং আমি ইবরাহিম ও ইসমাইলকে আদেশ করলাম, তোমরা আমার গৃহকে তাওয়াফকারী, ইতেকাফকারী ও রুকু-সিজদাকারীদের জন্য পবিত্র করো। [সূরা বাকারা-১২৫]
এর ফলে আল্লাহ তাআলার সাথে সম্পর্ক দৃঢ় হয়, এবং আল্লাহ তাআলার জন্য মস্তক অবনত করার প্রকৃত চিত্র ফুটে উঠে। কেননা আল্লাহ তাআলা বলেন:
وَمَا خَلَقۡتُ ٱلۡجِنَّ وَٱلۡإِنسَ إِلَّا لِيَعۡبُدُونِ ٥٦ # الذاريات: ٥٦
আমি মানুষ এবং জিন জাতিকে একমাত্র আমারই ইবাদতের জন্য সৃষ্টি করেছি। [সূরা আয-যারিয়াত-৫৬]
ইতিকাফে থাকা অবস্থায় স্ত্রীদের সাথে কি আচরণ হবে তা বর্ননা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তাআলা বলেন :
وَلَا تُبَٰشِرُوهُنَّ وَأَنتُمۡ عَٰكِفُونَ فِي ٱلۡمَسَٰجِدِۗ # البقرة: ١٨٧
আর তোমরা মসজিদে ইতিকাফকালে স্ত্রীদের সাথে মেলামেশা করো না। [সূরা বাকারা-১৮৭]
ইবরাহিম আলাইহিস সালাম তাঁর পিতা এবং জাতিকে লক্ষ্য করে মূর্তির ভর্ৎসনা করতে গিয়ে মহান আল্লাহ তাআলা ইরশাদ করেন :
إِذۡ قَالَ لِأَبِيهِ وَقَوۡمِهِۦ مَا هَٰذِهِ ٱلتَّمَاثِيلُ ٱلَّتِيٓ أَنتُمۡ لَهَا عَٰكِفُونَ ٥٢ الانبياء: ٥٢#
যখন তিনি তাঁর পিতা ও তাঁর সম্প্রদায়কে বললেন, এই মূর্তিগুলো কি, যাদের পূজারি (ইতেকাফকারী হয়ে) তোমরা বসে আছ? [সূরা আম্বিয়া-৫২]
হজরত আবদুল্লাহ ইবনে আব্বাস (রা.) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূলুল্লাহ (সা.) ইতিকাফকারী সম্পর্কে বলেছেন, সে ব্যক্তি গোনাহসমূহ হতে বিরত থাকে এবং তার জন্যে নেকিসমূহ লেখা হয় ঐ ব্যক্তির ন্যায় যে বাইরে থেকে যাবতীয় নেক কাজ করে।’ (সুনানে ইবনে মাজাহ, হাদিস-১৭৮১)
রাসুলুল্লাহ (সা.) প্রতি বছর অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। হযরত আয়েশা সিদ্দীকা রা. হতে বর্নিত,
أَنّ النّبِيّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ كَانَ يَعْتَكِفُ الْعَشْرَ الْأَوَاخِرَ مِنْ رَمَضَانَ، حَتّى تَوَفّاهُ اللهُ عَزّ وَجَلّ، ثُمّ اعْتَكَفَ أَزْوَاجُهُ مِنْ بَعْدِهِ.
নবী কারীম সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ইন্তিকালের আগ পর্যন্ত রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন। নবীজীর পর তাঁর স্ত্রীগণও এটি আদায় করতেন। (সহীহ মুসলিম-১১৭২; সহীহ বুখারী-২০২৬)
হযরত আবু হুরাইরা রা. হতে বর্নিত,
كَانَ يَعْرِضُ عَلَى النّبِيِّ صَلّى اللهُ عَلَيْهِ وَسَلّمَ القُرْآنَ كُلّ عَامٍ مَرّةً، فَعَرَضَ عَلَيْهِ مَرّتَيْنِ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ، وَكَانَ يَعْتَكِفُ كُلّ عَامٍ عَشْرًا، فَاعْتَكَفَ عِشْرِينَ فِي العَامِ الّذِي قُبِضَ فِيهِ.
জিবরাইল (আ) প্রতি বছর নবী সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লামকে একবার কুরআন শোনাতেন। কিন্তু যে বছর তাঁর ওফাত হয় সে বছর দুই বার শোনান। রাসুল (সা) প্রতি বছর দশ দিন ইতিকাফ করতেন। কিন্তু ইন্তেকালের বছর তিনি বিশ দিন ইতিকাফ করেন। (সহীহ বুখারী-৪৯৯৮, ২০৪৪)।
ইতিকাফকারীর জন্য দুটি হজ্জ ও দুটি ওমরার সওয়াব রয়ে। নবী করিম (সা.) ইরশাদ করেছেন, ‘যে ব্যক্তি রমজানের শেষ ১০ দিন ইতিকাফ করবে, তার জন্য দুটি হজ ও দুটি ওমরার সওয়াব রয়েছে।’ (বায়হাকী)
ইতিকাফের উপকারিতা
ইতিকাফকারী এক নামাজের পর অন্য ওয়াক্ত নামাজের অপেক্ষায় থাকে, আর এ অপেক্ষার অনেক ফজিলত রয়েছে। রাসুলুল্লাহ (সা.) বলেছেন, ‘নিশ্চয় ফেরেশতারা তোমাদের একজনের জন্য দোয়া করতে থাকেন যতক্ষণ সে কথা না বলে, নামাজের স্থানে অবস্থান করে। তারা বলতে থাকে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করে দিন, আল্লাহ তার প্রতি দয়া করুন, যতক্ষণ তোমাদের কেউ নামাজের স্থানে থাকবে এবং নামাজ তাকে আটকে রাখবে, তার পরিবারের কাছে যেতে নামাজ ছাড়া আর কিছু বিরত রাখবে না, ফেরেশতারা তার জন্য এভাবে দোয়া করতে থাকবে।’ (মুসলিম-৬০১১)
ইতিকাফের প্রকারভেদ
- সুন্নাত ইতিকাফঃ রমজানের শেষ দশকের ইতিকাফ। অর্থাৎ ২০ রমজানের সূর্য ডোবার আগ মুহূর্ত থেকে শাওয়াল মাসের চাঁদ ওঠা পর্যন্ত মসজিদে ইতিকাফ করা। এ ধরনের ইতিকাফকে সুন্নাতে মুয়াক্কাদা কিফায়া বলা হয়। গ্রাম বা মহল্লাবাসীর পক্ষে কোনো এক বা একাধিক ব্যক্তি এই ইতিকাফ করলে সবার পক্ষ থেকে তা আদায় হয়ে যাবে।
- ওয়াজিব ইতিকাফঃ মানতের ইতিকাফ ওয়াজিব। যেমন কেউ বলল যে, আমার অমুক কাজ সমাধা হলে আমি এত দিন ইতিকাফ করব অথবা কোনো কাজের শর্ত উল্লেখ না করেই বলল, আমি এত দিন অবশ্যই ইতিকাফ করব। যত দিন শর্ত করা হবে তত দিন ইতিকাফ করা ওয়াজিব। ওয়াজিব ইতিকাফের জন্য রোজা রাখা শর্ত। সুন্নাত ইতিকাফ ভঙ্গ করলে তা পালন করা ওয়াজিব হয়ে যায়।
- নফল ইতিকাফঃ সাধারণভাবে যেকোনো সময় ইতিকাফ করা নফল। এর নির্ধারিত কোন মেয়াদ নেই। অল্প সময়ের জন্যও ইতিকাফ করা যেতে পারে। সাওম পালন করা শর্ত নয়।
ইতিকাফের নিয়তঃ
ইতিকাফের জন্য মসজিদে প্রবেশের সময় নিয়ত করে নিতে হয়। নিয়ত : ‘নাওয়াইতু আন সুন্নাতুল ইতিকাফ-মাদুমতু হাজাল মাসজিদ।’
ইতিকাফের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যঃ
রমজান মাসের শেষ দশ দিন ইতিকাফের প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে লাইলাতুল কদরপ্রাপ্তির মাধ্যমে মহান আল্লাহর একান্ত সান্নিধ্য লাভ। যে ব্যক্তি উক্ত দিনগুলোতে ইতিকাফ করবে, তিনি নিশ্চয়ই ‘লাইলাতুল কদরের’ ফজিলত লাভ করবে।
আল্লামা হাফেজ ইবনে রজব (র:) বলেছেন, ‘ইতিকাফের উদ্দেশ্য হল সৃষ্টির সাথে সাময়িকভাবে সম্পর্ক ছিন্ন করা এবং স্রষ্টার সাথে সম্পর্ক কায়েম করা। আল্লাহর সাথে পরিচয় যত দৃঢ় হবে, সম্পর্ক ও ভালোবাসা ততো গভীর হবে এবং তা বান্দাকে পুরোপুরি আল্লাহর কাছে নিয়ে যাবে।’
ইতিকাফের সর্বোত্তম স্থানঃ
ইতিকাফের জন্য সর্বোত্তম স্থান হলো বাইতুল্লাহ শরিফ। বাইতুল্লাহ শরিফের পর মসজিদে নববি। এরপর বাইতুল মাকদিস বা মুকাদ্দাস। তারপর জুমা আদায় করা হয় এমন মসজিদ। এরপর মহল্লার যে মসজিদে নামাজির সংখ্যা বেশি হয়, সে মসজিদে ইতিকাফে সওয়াব বেশি।
ইতিকাফের শর্তসমুহ :
১.মুসলমান হওয়া ২. পাগল না হওয়া ৩. বালেগ হওয়া ৪. মসজিদে ইতিকাফ করা ৫. ইতিকাফের নিয়ত করা ৬. ইতিকাফকারী সর্বদা জানাবাত (বা মহিলা হলে হায়েজ নেফাস) থেকে পবিত্র থাকা । ৭. রোজা রাখা।
নারীদের ইতিকাফঃ
পুরুষদের ন্যায় নারীদের জন্য ইতিকাফ সুন্নত। কিন্তু তারা ঘরে ইতিকাফ করবে। ইতিকাফের জন্য ঘরের নির্দিষ্ট নামাজঘরকে ব্যবহার করা যেতে পারে। কারো নামাজের জন্য নির্দিষ্ট নামাজঘর না থাকলে নামাজের নির্দিষ্ট স্থানকে কাপড় দিয়ে ঘেরাও করে নেওয়া যেতে পারে।
হজরত আয়েশা (রা.) থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, ‘রাসুলুল্লাহ (সা.) রমজানের শেষের দশকে ইতিকাফ করেছেন ইন্তেকাল পর্যন্ত। এরপর তাঁর স্ত্রীরা ইতিকাফ করেছেন।
ইতিকাফে করণীয়ঃ
ইতিকাফে করণীয় হচ্ছে- |
---|
১. বেশি বেশি আল্লাহর জিকির-আজকার করা, |
২. নফল নামাজ আদায় করা, |
৩. কোরআন তেলাওয়াত করা, |
৪. দ্বীনি ওয়াজ-নসিহত শোনা ও |
৫. ধর্মীয় গ্রন্থাবলী পাঠ করা। |
ইতিকাফে বর্জনীয়ঃ
ইতিকাফে যেসব কাজ বর্জনীয়- |
---|
১. ইতিকাফ অবস্থায় বিনা ওজরে মসজিদের বাইরে যাওয়া, |
২. দুনিয়াবি আলোচনায় মগ্ন হওয়া, |
৩. কোনো জিনিস বেচাকেনা করা, |
৪. ব্যবসা-বাণিজ্যের হিসাব-নিকাশ করা, |
৫. ওজরবশত বাইরে গিয়ে প্রয়োজনাতিরিক্ত বিলম্ব করা ও |
৬. স্ত্রীর সঙ্গে সহবাস করা। এসব কাজ করলে ইতিকাফ ভঙ্গ হয়ে যায়। |
সর্বোপরি, ইসলামে ইতিকাফের গুরুত্ব ও ফজিলত অপরিসীম। ইতিকাফ ইমান বৃদ্ধির একটি মুখ্য সুযোগ। মহান আল্লাহ রব্বুল আলামীন পবিত্র মাহে রমজানে ইতিকাফ করার মাধ্যমে তার নৈকট্য লাভের তাওফিক দান করুন (আমিন)।
আরো পড়ুন, ঐতিহাসিক বদর দিবস