আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস। বাঙালি জাতির জীবনে অনন্যসাধারণ একটি দিন। স্বাধীনতার ঘোষণা ও মুক্তিযুদ্ধের সূচনার এই সময়টি জাতি আবেগের সঙ্গে স্মরণ করে। এক অনাড়ম্বর স্বাধীনতা দিবস পালন হলো এবারের স্বাধীনতা দিবস।
কারণ বিশ্বজুড়ে আজ মহামারি রূপে হানা দিয়েছে ‘করোনাভাইরাস’ নামক এক অদ্ভুত ভাইরাসের। স্বাধীনতা দিবসের প্রথম প্রহর থেকে যে দিবসের সূচনা ঘটে লোক সমাগম ও পুস্পস্তবক অর্পণের মধ্য দিয়ে, সেখানে এবার বাতিল হয়েছে সব অনুষ্ঠান। নেই জনকোলাহল, দেশাত্মবোধক গান বাজছে না শহরের অলিতে-গলিতে। নেই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সহ কোন সংগঠনের অনুষ্ঠান। স্মৃতিসৌধ আজ পড়ে রয়েছে মালাবিহীন অবস্থায়। যে স্তম্ভ ছেয়ে যেত আজ ফুলে ফুলে আর মানুষের ভালবাসায়, সেই স্তম্ভ আজ পড়ে রয়েছে ভাবলেশহীনভাবে।
তবুও শহীদদের প্রতি ভালবাসা তো কমে না। শহীদদের প্রতি ভালবাসা যে এদেশের কোটি মানুষের মনে। আর তাই তো, এদেশের কোটি মানুষের অফুরন্ত ভালবাসা চিরকাল রবে স্বাধীনতার স্বাদ উপহার দেয়া সেসকল জীবন উতসর্গকারী বীর শহীদদের প্রতি,যে ভালবাসা কেড়ে নিতে পারবে না করোনার মত কোন মহামারি।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ কালরাতে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী স্বাধিকারের দাবিতে জেগে ওঠা নিরীহ বাঙালির ওপর চালিয়েছিল নির্মম হত্যাযজ্ঞ। এরপর জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান গ্রেপ্তারের আগমুহূর্তে ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। যে ঘোষণা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে প্রচারিত হয়।
স্বাধীনতার এই ৪৯তম বার্ষিকীতে জাতি মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন করবে। তবে, করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধ ও ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোসহ সকল জাতীয় কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের আগের বছরে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবার্ষিকীতে এবার স্বাধীনতা দিবস নতুন আবহ নিয়ে আসায় প্রস্তুতি ছিল অনেক।
কিন্তু মুজিববর্ষের উদ্বোধন অনুষ্ঠান স্থগিতের পর কোভিড-১৯ রোগের ব্যাপক বিস্তার ঠেকাতে গোটা দেশকে অবরুদ্ধ করে রাখার মধ্যেই এবারের স্বাধীনতা দিবস এল।
গতকাল বুধবার জাতীয় উদ্দেশে দেওয়া ভাষণে পরিস্থিতির গুরুত্ব তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, “এ পরিপ্রেক্ষিতে জনস্বাস্থ্যের কথা বিবেচনা করে আমরা এবারের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস ভিন্নভাবে উদযাপনের সিদ্ধান্ত নিয়েছি। “জনসমাগম হয়, এমন ধরনের সব অনুষ্ঠানের আয়োজন থেকে সবাইকে বিরত থাকার অনুরোধ জানাচ্ছি। এই মুহূর্তে আমাদের সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার মানুষকে এই প্রাণঘাতী ভাইরাসের সংক্রমণ থেকে রক্ষা করা।”

বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে শিশু কিশোর সমাবেশ কিংবা প্যারেড স্কয়ারে কুচকাওয়াজ, বঙ্গভবনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠান, স্বাধীনতার এই ৪৯তম বার্ষিকীতে জাতি মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী শহীদদের স্মৃতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধা নিবেদন, সেই সঙ্গে স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বঙ্গভবনে গণ অভ্যর্থনা এবং সর্বোচ্চ রাষ্ট্রীয় সম্মাননা স্বাধীনতা পদক বিতরণ অনুষ্ঠান সবই বাতিল করা হয়েছে। করোনাভাইরাস পরিস্থিতির কারণে সাভার জাতীয় স্মৃতি সৌধ ও ধানমন্ডিতে বঙ্গবন্ধু ভবনে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানোসহ সকল জাতীয় কর্মসূচি বাতিল করা হয়েছে।
স্বাধীনতা দিবসে চিরচেনা স্মৃতিসৌধ এখন নিস্তব্ধ, সুনশান পরিবেশ বিরাজ করছে। মানুষের ঢল নামেনি, ফুল হাতে দেখা মেলেনি এ প্রজন্মের ছোট্ট শিশুটিকেও; যে কিনা যুদ্ধ দেখেনি কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় আগামীর সমৃদ্ধ বাংলাদেশ দেখতে চায়। বন্ধ রয়েছে স্মৃতিসৌধের ফোয়ারাও। প্রধান বেদিতে নেই কোনো ফুল।

প্রতিবছর স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবসে প্রথম প্রহরে রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী; এরপর থেকে সবস্তরের মানুষ ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে জাতীয় স্মৃতিসৌধে ফুল দিয়ে শহীদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করে থাকেন। এবছর সারা বিশ্বে ছড়িয়ে পড়া করোনার মহামারির কারণে এ কর্মসূচিটি বাতিল করা হয়েছে।
স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছাবাণী

রাষ্ট্রপতি তাঁর বাণীতে দেশবাসীসহ প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান। রাষ্ট্রপতি বলেন, “বাংলাদেশ আজ উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। উন্নয়নকে জনমুখী ও টেকসই করতে সুশাসন, সামাজিক ন্যায়বিচার, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিত করতে হবে।” “অনেক ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত মহান স্বাধীনতা। বঙ্গবন্ধু সবসময় রাজনৈতিক স্বাধীনতার পাশাপাশি একটি সুখী-সমৃদ্ধ দেশ গড়ার স্বপ্ন দেখতেন। তার সেই স্বপ্ন বাস্তবায়নে বর্তমান সরকার নিরলস প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। বাংলাদেশ উন্নয়নের মহাসড়কে অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। দারিদ্র্যবিমোচন, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, মানবসম্পদ উন্নয়ন, নারীর ক্ষমতায়ন, শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার হ্রাস, লিঙ্গবৈষম্য দূরীকরণ, গড় আয়ু বৃদ্ধিসহ আর্থসামাজিক উন্নয়নের বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ঈর্ষণীয় সাফল্য অর্জন করেছে।”

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, “লক্ষ প্রাণের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীনতা বাঙালি জাতির শ্রেষ্ঠ অর্জন। এই অর্জনকে অর্থবহ করতে সবাইকে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস জানতে হবে। প্রধানমন্ত্রী মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে দেশের সব নাগরিক এবং প্রবাসী বাংলাদেশিদের আন্তরিক শুভেচ্ছা ও অভিনন্দন জানান।”

বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট চ্যাটার্টন ডিকসন। ঢাকার ব্রিটিশ হাইকমিশনের এক ভিডিও বার্তায় তিনি এই শুভেচ্ছা জানান। বার্তায় তিনি বলেন,“আমি বাংলাদেশের সব বন্ধুকে একটি কথা বলতে চাই, সেটা হলো- সবাইকে স্বাধীনতা দিবসের শুভেচ্ছা।”
বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশি নাগরিকদের শুভেচ্ছা জানিয়েছেন জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেজ। রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের কাছে পাঠানো এক বার্তায় তিনি এ শুভেচ্ছা জানান।

মহাসচিব বলেন, “বাংলাদেশের স্বাধীনতা দিবসে দেশটির জনগণকে আমি শুভেচ্ছা জানাই। জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্যের স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও ইতিহাস রয়েছে। আপনার দেশের জাতিসংঘের সঙ্গে সম্পৃক্ততা ও আন্তর্জাতিক এজেন্ডা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ বছর টেকসই উন্নয়নের প্রথম দশকে আমরা অবশ্যই বৈশ্বিকভাবে আমাদের লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে যাবো।” “জাতিসংঘের প্রতিটি সদস্য রাষ্ট্রেরই স্বতন্ত্র সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্য রয়েছে। এ বৈচিত্র্যতা আমাদের সংস্থা ও বিশ্বকে সমৃদ্ধ করেছে। জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক এজেন্ডায় আপনার দেশের অংশগ্রহণ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। সবার জন্য একটি শান্তিপূর্ণ, ন্যায়ভিত্তিক ও টেকসই বিশ্ব গড়ে তুলতে তিনি বাংলাদেশের জনগণের অংশগ্রহণ ও সমর্থন কামনা করেন।”
এ ছাড়া মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প দেশটির জনগণের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস উপলক্ষে বাংলাদেশি নাগরিকদের উষ্ণ অভিনন্দন জানিয়েছেন।
এদিকে, আজ মহান স্বাধীনতা ও জাতীয় দিবস-২০২০ উদযাপন উপলক্ষে ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উদ্যোগে বৃহস্পতিবার দুপুরে জোহর নামাজের পর বায়তুল মোকাররম জাতীয় মসজিদে দোয়া ও মোনাজাত অনুষ্ঠিত হয়েছে। মোনাজাতে ২৬ মার্চ ও মহান স্বাধীনতা যুদ্ধে শাহাদাতবরণকারী সকল শহীদদের আত্মার শান্তি কামনা করে দোয়া ও মোনাজাত করা হয়।


উল্লেখ্য,একাত্তরের ২৫ মার্চের মৃত্যুর বিভীষিকা থেকে এক হয়ে মাথা তুলে দাঁড়িয়েছিল দেশের মানুষ। ওই দিন দিবাগত রাতেই (একাত্তরের ২৫ মার্চ) গ্রেপ্তার হন বঙ্গবন্ধু। তার আগেই বার্তা পাঠিয়ে দেন স্বাধীনতার ঘোষণার।
এরপর গঠিত হয় প্রবাসী সরকার। তাদের নেতৃত্বে সংগঠিত রূপ নেয় মুক্তিযুদ্ধ। নয় মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৩০ লাখ মানুষের আত্মদান, দুই লাখ নারীর সম্ভ্রম আর বিপুল ক্ষয়ক্ষতির মধ্য দিয়ে অর্জিত হয় বিজয়। পৃথিবীর মানচিত্রে অভ্যুদয় ঘটে স্বাধীন বাংলাদেশের।
গত প্রায় অর্ধ শতকে নানা চড়াই-উৎরাই পেরিয়ে আসা বাংলাদেশে এবারই প্রথম, যে স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠান এমন অনাড়ম্বর করতে হলো। স্বাধীনতার এই দিনে মহান মুক্তিযুদ্বে অংশগ্রহণকারী শহীদ, মুক্তিযোদ্বা, বুদ্বিজীবী, বীরাঙ্গনাসহ সকল মুক্তিযুদ্বে ত্যাগ শিকারকারী বাংলার মানুষদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্বা ও ভালোবাসা।