কথায় বলে অহংকার নাকি বেশিদিন থাকে না। অহংকারী ব্যক্তিদের নাকি পতন হয় খুব তাড়াতাড়ি। আর তাদের পতনও হয় অনেক শোচনীয়ভাবে। সেই পতনটা যদি হয় বিশ্বের শক্তিধর কোন রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টের তবে বলার আর অপেক্ষা রাখে না যে পরাজয়টা কত শোচনীয় ও দৃষ্টান্তমূলক। বলছি আমেরিকার সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের কথা,যিনি সদ্য বিদায়ী হিসেবে তার সাম্রাজ্য হারিয়েছেন।
২০১৬ সালে নাটকীয়ভাবে যখন ডেমোক্রেটিক পার্টির হিলারি ক্লিন্টনকে হারিয়ে ক্ষমতায় আসেন ডোনাল্ড ট্রাম্প তখন তার চোখে মুখে অহংকারের ছাপ প্রবল ছিল৷ হোয়াইট হাউজের মত বিশ্বের সবচেয়ে বড় অভিজাত সাম্রাজ্যকে পরিত্যাগ করে নিজের বানানো ট্রাম্প হাউজ থেকে যখন দেশ পরিচালনা শুরু করেন,তখন খোদ আমেরিকান নয়, সারা বিশ্ববাসী সবাই অবাক হয়েছিল তার বৈভব আর রসিকতা দেখে। যদিও পরবর্তীতে হোয়াইট হাউসকেও তিনি ব্যবহার করেছিলেন। তবে সেই মূল্যহীন রাজপ্রাসাদই যেন শেষ পর্যন্ত অতি মূল্যবান হয়ে ওঠে তার কাছে। আর হবে নাই বা কেন, কারণ রাজপ্রাসাদই যে তার সাম্রাজ্যের একমাত্র কারিগর।
বিভিন্ন সময় বিভিন্ন বেফাস মন্তব্য আর মিডিয়ায় এসে বিভিন্ন অঙ্গভঙ্গি দেখিয়ে লোক হাসানোটাই যেন ছিল তার নিত্য সঙ্গী। বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর রাষ্ট্রের বুকে ইতিহাসের সবচেয়ে বিচক্ষণহীন এক প্রেসিডেন্টের তকমা লাগিয়েছিলেন অনেক আগেই, তবে তার এই বিচক্ষণহীনতা আর ব্যর্থতার ছাপ স্পষ্ট হয় ২০২০ সালের করোনা মহামারীতে। করোনা দূর্যোগে যখন একের পর এক লাশের সারি হতে শুরু করে যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তা,করবস্থানে,তখন তিনি লিপ্ত ছিলেন চীন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার দোষারোপ করতে। এমনকি নিজের ব্যর্থতা, পদক্ষেপের বিষয়ে সাংবাদিকরা কোন প্রশ্ন করলে উত্তরে তিনি দাম্ভিকতার সাথে এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতেন আর সাংবাদিককে চীনে যেতে বলতেন ও চীনকে জিজ্ঞাসা করতে বলতেন।
একজন প্রেসিডেন্ট কতটা পরিমাণে ব্যর্থ হলে নিজের ব্যর্থতা ঢাকতে অন্য কোন দেশ বা সংস্থাকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে তা ট্রাম্পকে না দেখলে বা এই করোনা মহামারী না দেখলে বোঝা যেত না।
ফিলিস্তিনকে স্বীকৃতি দেয়ার বিষয়ে যখন জাতিসংঘ সহ বেশ কয়েকটি দেশ যখন তাদের সম্মতি ও অবস্থান স্পষ্ট করে তখন একমাত্র ট্রাম্প ইসরায়েলের পক্ষ নিয়ে ফিলিস্তিনকে দেশ বা স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে স্বীকৃতি দিতে অস্বীকৃতি জানান এবং ফলাফল পরবর্তীতে সবাই জানে।
গত ৪ বছরের ইতিহাসে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন ও শিকার হয়েছে। আর তার একমাত্র কারণ ট্রাম্পের একরোখা স্বভাব ও কান্ডজ্ঞানহীন কার্যক্রমের জন্য। তবে যদিও এত খারাপের ভিড়ে ভাল কাজও ছিল তার কিছু যেমনঃ ইরাকে যুদ্ধ বিরতি, ইয়েমেনে যুদ্ধ বিরতি, আফগানিস্তানে সৈন্য প্রত্যাহার ছিল তার ভাল কাজের মধ্যে কিছু। তবে ইরানের সাথে যে ছেলে মানুষী খেলা তিনি খেলেছেন সেটাতে ইরান তথা বিশ্বের ইতিহাসে একজন সেনাপ্রধান হিসেবে কাশেম সোলাইমানিকে হত্যায় প্রত্যক্ষ মদদ দেয়ার জন্য ঘৃণিতও হয়েছেন ট্রাম্প। সর্বশেষ নিজ দেশেই কৃষ্ণাঙ্গ যুবক জর্জ ফ্লয়েডকে হত্যার মাধ্যমে প্রশাসনকে প্রশ্নবিদ্ধ করার এবং বর্ণবাদ বৈষম্যকে আবারো সামনে আনেন ট্রাম্প। কারণ নিজের মত করে তিনি সাজিয়েছিলেন প্রশাসনকে আর তাদেরকে তিনি বর্ণবাদ বৈষম্যের ক্ষেত্রে শতভাগ মদদ দিয়েছেন।
২০২০ সালের নির্বাচনে এসে যখন ট্রাম্প তার পূর্বের নির্বাচনের অভিজ্ঞতার আলোকেই নির্বাচনের মাঠের নিজের জানান দেয়ার চেষ্টা করেন তখন তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে তার এই ৪ বছরের মুকুট ও সাম্রাজ্যের কালিমা দাগগুলো আবারও জীবন্ত হয়ে উঠেছে, যা এতদিন চেপে রাখা হয়েছিল অহংকার আর দাম্ভিকতা বেড়াজালে।কিন্তু বাধভাঙ্গা জোয়ারের মত মানুষ নির্বাচনে ভোট দিতে আসে এবং তারা ট্রাম্পের প্রতি যে কতটা বিরক্ত বা প্রশাসনও যে কতটা তার উপর আস্থা হারিয়ে ফেলেছে তা ভোটের ফলাফলেই স্পষ্ট হয়ে ওঠে।
তবে তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ডেমোক্রেটিক পার্টির জো বাইডেন যেন আড়ালে থেকে মুচকি মুচকি হাসি হেসেছেন ট্রাম্পের এরকম অধঃপতন হওয়া দেখে। যদিও নির্বাচনের শুরুতে অত্যন্ত ঠান্ডাভাবে নির্বাচনে অগ্রসর এবং নির্বাচনেও নিজের বিচক্ষণতার পরিচয় দিয়েছেন, তবুও মানুষের ক্ষমতা পরিবর্তনের চাহিদা থেকেই বাইডেন হয়ে ওঠেন তাদের একমাত্র ভরসা এবং সবশেষে ইতিহাসের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ প্রেসিডেন্ট হিসেবে হোয়াইট হাউসের অধিপতি হলেন জো বাইডেন।
সেই সাথে পতন হলো এক অহংকারী,দাম্ভিক সাম্রাজ্যবাদীর, যার কাছে টাকাটাই ছিল প্রধান অস্ত্র আর কিছু শব্দ ও হাসির খোরাক।
আপনার মতামত দিন