সীমার মাঝে অসীম তুমি বাজাও আপন সুর/ আমার মধ্যে তোমার প্রকাশ তাই এত মধুর/ কত বর্ণে কত গন্ধে, কত গানে কত ছন্দে/ অরূপ, তোমার রূপের লীলায় জাগে হৃদয়-পুরু/ আমার মধ্যে তোমার শোভা এমন সুমধুর….। বাংলা সাহিত্যের প্রতিটি পরতে পরতে এমনি রস মিশিয়ে এই সাহিত্যকে সমৃদ্ধ করেছেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।
পঁচিশে বৈশাখ, বাংলা সাহিত্যের অনন্যপ্রতিভা কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মদিন। আজ থেকে ১৫৯ বছর আগে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে (৭ মে, ১৮৬১ খ্রিষ্টাব্দ) কলকাতায় জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে ক্ষণজন্মা এই মানুষটির জন্ম হয়। তাঁর লেখনীতে বাংলা সাহিত্যের সব কটি ধারা পরিপুষ্ট হয়েছে।
পৃথিবী আজ ধুঁকছে মহামারী করোনায়। এই সময়ে কবিগুরুর গান, কবিতা, সাহিত্য মানুষের মনে সাহস জোগায়, মনকে শান্ত করে। কুর বাঙালির মানসপটে সদাই বিরাজমান। বাঙালির জীবনের যত ভাবনা, বৈচিত্র্য আছে, তার পুরোটাই লেখনী, সুর আর কাব্যে তুলে ধরেছেন কবিগুরু ।
তার সাহিত্যকর্ম, সঙ্গীত, জীবনদর্শন, মানবতা, ভাবনা- সবকিছুই সত্যিকারের বাঙালি হতে অনুপ্রেরণা দেয়।
কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের হাতেই মূলত সার্থক বাংলা ছোটগল্পের সূত্রপাত। মাইকেল মধুসূদন দত্ত ও বিহারীলালের লেখনীর মাধ্যমে বাংলা কবিতায় আধুনিকতার সূচনা হলেও রবীন্দ্রনাথের হাতেই তা পূর্ণতা পায়। একইভাবে রাজা রামমোহন রায়, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর ও বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের হাতে জন্ম নেওয়া বাংলা গদ্যকেও তিনি চূড়াস্পর্শী সাফল্য দান করেন।
রবীন্দ্রনাথ একাধারে কবি, কথাশিল্পী, প্রাবন্ধিক, নাট্যকার, সংগীত রচয়িতা, সুরস্রষ্টা, গায়ক ও চিত্রশিল্পী। সৃষ্টিশীলতার সমান্তরালে তিনি ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি ও সমাজভাবনা সমানভাবেই চালিয়ে গেছেন। বিশ্বভারতী তাঁর বিপুল কর্মকাণ্ডের একটি প্রধান কীর্তি।
গীতাঞ্জলি কাব্যগ্রন্থের জন্য ১৯১৩ সালে রবীন্দ্রনাথ সাহিত্যে নোবেল পুরস্কার পান। সাহিত্যে নোবেল বিজয়ী তিনিই প্রথম এশীয় ও একমাত্র বাঙালি লেখক।
বলা হয়ে থাকে যে গীতাঞ্জলী কাব্যগ্রন্থের জন্য তিনি যদি নোবেল পুরস্কারের জন্য মনোনীত নাও হতেন; তবে ছোটগল্পের জন্য অবশ্যই তিনি নোবেল প্রাইজ লাভ করতেন। উপন্যাস কিংবা নাটক রচনাতেও তিনি অসামান্য পারদর্শীতা দেখিয়েছেন। “শেষের কবিতা” উপন্যাসটি আনুমানিক ১৯০৩ খ্রিস্টাব্দের দিকে রচনা করা। সেই সময় তিনি এ উপন্যাসে যেভাবে তথাকথিত আধুনিকতা আর আটপৌরে জীবনের মধ্যে পার্থক্য দেখিয়েছেন, তা আজকের যুগেও আমাদের অনেকের চিন্তার পরিধির বাহিরে।
“চোখের বালি”, “গোরা”, “নৌকাডুবি”, “যোগাযোগ”, “বৌ ঠাকুরানীর হাট”, “ঘরে বাইরে” প্রত্যেকটি উপন্যাসই অসামান্য। সব জায়গায় তিনি গেয়েছেন মানবিকতার জয়গান। নোবেল পুরস্কার লাভ যেন তার কৃতির যৎসামান্য কৃতিত্ব বৈ আর কিছুই নয়।
নিপীড়িত মানুষদের প্রতি তার কণ্ঠস্বর ছিল সদা বলিষ্ঠ। “দুই বিঘা জমি”- নামক বিখ্যাত কবিতার মধ্য দিয়ে তিনি অত্যাচারী শাসকগোষ্ঠীর বিরুদ্ধে কলম ধরেছেন এভাবে;
“এ জগতে হায়, সেই বেশি চায়, আছে যার ভূরি ভূরি;
রাজার হস্ত করে সমস্ত কাঙালের ধন চুরি! “
আজকে তার রচিত কোন কবিতার দুইটি চরণ কিংবা কোন গদ্যাংশের দুটি লাইন নিয়েও সৃষ্টি হয়ে গেছে অনেক প্রবাদ-প্রবচন। অনেক সময় সৃষ্টি হচ্ছে নাটক। অসাম্প্রদায়িকতার এক উজ্জ্বল উদাহরণ রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে ব্রিটিশ সরকার যখন তাকে “নাইট”-উপাধিতে ভূষিত করেন; তিনি তা প্রত্যাখ্যান করেন। মূলত পাঞ্জাবের অমৃতসরের জালিয়ানওয়াওয়ালবাগে নিষ্ঠুর ইংরেজ শাসকদের গুলিতে প্রাণ হারানো জাতীয় বীরদের প্রতি সহমর্মিতা জানাতেই তার এ প্রতিবাদ।
রবীন্দ্রসাহিত্য, বিশেষত রবীন্দ্রসংগীত বাঙালির কাছে আলোকবর্তিকা হয়ে দেখা দিয়েছিল মুক্তিযুদ্ধে। মুক্তিযুদ্ধে বিজয় অর্জনের পর তাঁর গানই বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতের মর্যাদায় অভিষিক্ত হয়েছে।
বিশ্বে যদি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ পাঁচ জন সাহিত্যিকের তালিকা করা হয় তবে আমার মতে সেখানে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে রাখতেই হবে। ইংরেজি সাহিত্যে যে রকম উইলিয়াম শেক্সপিয়ার, রুশ সাহিত্যে যেরকম লিও তলস্তয়, জার্মান সাহিত্যে গ্যায়টে, ফ্রেঞ্চ সাহিত্যে ভিক্টর হিউগো, ল্যাটিন আমেরিকার সাহিত্যে গর্সিয়া মার্কুয়েজ আমাদের বাংলা সাহিত্যে ঠিক একই রকমভাবে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাই তো ২০০৪ সালে বিবিসির করা এক জরিপে তিনি সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালির মধ্যে সেরা তিনে স্থান পেয়েছেন।
রাষ্ট্রীয়ভাবে উদ্যাপন স্থগিত করা হলেও, রবীন্দ্র জয়ন্তী উপলক্ষে বাণী দিয়েছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
রাষ্ট্রপতির বাণীঃ
বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে দেয়া বাণীতে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেছেন, "রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বাঙালী চেতনা ও মননের প্রধান প্রতিভূ। তিনি আমাদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ সঙ্গীত স্রষ্টা। চিত্রকর, সমাজচিন্তক এবং দার্শনিক হিসেবেও বিশেষ খ্যাত। রবীন্দ্রনাথ বাঙালী জাতীয়তা-বোধের অন্যতম প্রধান রূপকার বলেও মন্তব্য করেন তিনি। "
প্রধানমন্ত্রীর বাণীঃ
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, "রবীন্দ্রাথ ছিলেন শান্তির কবি, মানবতার কবি ও প্রকৃতির চিরন্তন সৌন্দর্যের কবি। তিনি ছিলেন বৈচিত্র্যের সাধক। বিশ্বব্যাপী দ্বন্দ্ব, সংঘাত ও বৈষম্যের বিলোপ সাধন এবং ধর্ম-বর্ণ-ভাষায় বৈচিত্র্য সমুন্নত রাখতে রবীন্দ্রাথের জীবন ও দর্শন উজ্জ্বল এক আলোকবর্তিকা। বিশ্ব কবির ব্যঞ্জনাময় উপস্থিতি শোষণ, বঞ্চনা, সাম্প্রদায়িকতা ও স্বৈরতন্ত্র প্রতিরোধে বাঙালীর অগ্রযাত্রাকে চিরকাল অব্যাহত রাখবে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কালজয়ী এ কবি জীবন ও জগৎকে গভীরভাবে নিরীক্ষণ করেছেন। সাহিত্যের সব শাখায় তাঁর অনন্য সাধারণ প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। জীবন সম্পর্কে তাঁর দুরদর্শী চিন্তার প্রতিফলন ঘটিয়েছেন। তাঁর সৃষ্টি বাংলা সাহিত্যকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেছে।"
কর্মসূচিঃ
করোনাভাইরাস সংক্রমণের কারণে বহুদিন ধরেই জনসমাগম নিষিদ্ধ। তাই প্রতিবছর যেভাবে আয়োজন করে উদ্যাপন করা হতো বিশ্বকবির জন্মদিন, এ বছর সেভাবে হচ্ছে না। তাই বলে থেমে থাকবে না জন্মদিনের উৎসব। অনলাইনে নানা অনুষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যাপন করা হবে তাঁর জন্মোৎসব।
ছায়ানটসহ দু’ একটি সংগঠন সঙ্গীতের ভাষায় সীমিত আকারে কবিগুরুর প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করবে।
ছায়ানটঃ
আজ সীমিত পরিসরে রবীন্দ্রজয়ন্তী উদযাপনের প্রস্তুতি নিয়েছে ছায়ানট। প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, আজ সকাল ৯টায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে এ অনুষ্ঠান প্রচার করা হবে। এ অনুষ্ঠান গ্রন্থনা করেছেন বাঙালীত্বের একনিষ্ঠ সাধক ও আয়োজক প্রতিষ্ঠানের সভাপতি সনজীদা খাতুন।
বিটিভিঃ
সকাল ১০টায় সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে বিটিভিতে সম্প্রচারিত হয় রবীন্দ্রজয়ন্তীর অনুষ্ঠান।
উদীচীঃ
এছাড়া সকাল ১০টায় ফেসবুকের মাধ্যমে সম্প্রচারিত হয় উদীচীর রবীন্দ্রজয়ন্তীর আয়োজন।উদীচীর ফেসবুক পেজে এই অনুষ্ঠানমালার আয়োজন করা হয়। আয়োজনের মধ্যে ছিল সঙ্গীত, নৃত্য, কবিতা ও কথামালা। এসবে অংশ নেন দুই বাংলার শিল্পীরা।
অন্য বছর এই দিনে রাজধানী ঢাকা ছাড়াও, শিলাইদহ শাহজাদপুর পতিসর দক্ষিণডিহি ও পিঠাভোগে রবীন্দ্রজয়ন্তীর বিশেষ অনুষ্ঠানমালা আয়োজন করা হয়। সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় এসব অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘরসহ রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পীদের বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে কবিগুরুকে স্মরণ করা হয়। সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার স্বার্থে এবার অধিকাংশ আয়োজন স্থগিত করা হয়েছে।
গতকাল ৭ মে, বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ২৫ বৈশাখ। বাংলা সাহিত্যের এই কিংবদন্তি কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ১৫৯তম জন্মবার্ষিকী। ১৮৬১ সাল এবং বাংলা বর্ষপঞ্জিতে ১২৬৮ বঙ্গাব্দের এই দিনে তিনি কলকাতার বিখ্যাত জোড়াসাঁকোর ঠাকুর পরিবারে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। বাবা মহর্ষি দেবনাথ ঠাকুর এবং পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ ঠাকুর সবাই ছিলেন ভিন্ন এক উচ্চতার মানুষ। জন্মবার্ষিকীর এ দিনে তাই তার প্রতি রইলো গভীর শ্রদ্ধা।