কাজী নজরুল ইসলাম
বল বীর-
বল উন্নত মম শির!
শির নেহারী’ আমারি নতশির ওই শিখর হিমাদ্রীর!
‘বিদ্রোহী’ কবিতার এই পঙক্তিমালায় একই সাথে ফুটে উঠেছে কাজী নজরুল ইসলাম এর আত্মপ্রত্যয়ী ও বিদ্রোহী মনোভাব। তিনি ছিলেন একাধারে কবি, সাহিত্যিক, সংগীতজ্ঞ, সাংবাদিক, সম্পাদক, রাজনীতিবিদ এবং সৈনিক। আজ এই মহান সাহিত্যস্রষ্টা জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের ১২২তম জন্মবার্ষিকী। প্রতিবছরই জন্মদিনে কাজী নজরুল ইসলামকে স্মরণ করে থাকে নানা আয়োজন। সরকারি ও সামাজিক প্রতিষ্ঠান থেকে কিছু আয়োজন রাখা হয়েছে কবি স্মরণে।
মানবতার মুক্তির পাশাপাশি সাম্প্রদায়িকতা, ধর্মান্ধতা, কুসংস্কার, কূপমণ্ডূকতার বিরুদ্ধেও তিনি ছিলেন সোচ্চার।
১৮৯৯ খ্রিষ্টাব্দে ২৫ মে, ১৩০৬ বঙ্গাব্দের ১১ জ্যৈষ্ঠ ভারতের পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার আসানসোল মহকুমার চুরুলিয়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। মাতা জাহেদা খাতুন এবং পিতা কাজী ফকির আহমেদের ষষ্ঠ সন্তান এই বিদ্রোহী কবি। তার বাবা ফকির আহমদ ছিলেন স্থানীয় মসজিদের ইমাম এবং মাজারের খাদেম।
সংগ্রামী জীবন:
দরিদ্র পরিবারে জন্মের পর দুঃখ-দারিদ্র্য ছিল তাঁর নিত্যসঙ্গী। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম এর জীবন ছিল বিচিত্র। ছোটবেলায় ছিলেন বেশ লাজুক। তাঁর ডাকনাম ছিল দুখু মিয়া। বাবার অকালমৃত্যুতে পরিবারের ভরণপোষণের জন্য তিনি শিশু বয়সেই মক্তবে শিক্ষকতা, হাজি পালোয়ানের মাজারে খাদেম, মসজিদে মুয়াজ্জিনের,লেটো গানের দলে কাজ করেন।
১৯১০ সালে নজরুল লেটো দল ছেড়ে ছাত্র জীবনে ফিরে আসেন। এই নতুন ছাত্রজীবনে তার প্রথম স্কুল ছিল রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুল, এরপর ভর্তি হন মাথরুন উচ্চ ইংরেজি স্কুলে। আর্থিক সমস্যা তাকে বেশ দিন এখানে পড়াশোনা করতে দেয়নি। ষষ্ঠ শ্রেণী পর্যন্ত পড়ার পর তাকে আবার কাজে ফিরে যেতে হয়। প্রথমে যোগ দেন বাসুদেবের কবিদলে। এর পর একজন খ্রিস্টান রেলওয়ে গার্ডের খানসামা এবং সবশেষে আসানসোলের চা-রুটির দোকানে রুটি বানানোর কাজ নেন। এভাবে বেশ কষ্টের মাঝেই তার বাল্য জীবন অতিবাহিত হতে থাকে। নজরুলকে ১৯১৪ খ্রিষ্টাব্দে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালের দরিরামপুর স্কুলে সপ্তম শ্রেণীতে ভর্তি করে দেন এক দারোগা। ১৯১৫ খ্রিষ্টাব্দে তিনি আবার রানীগঞ্জের সিয়ারসোল রাজ স্কুলে ফিরে যান এবং সেখানে অষ্টম শ্রেণী থেকে পড়াশোনা শুরু করেন। ১৯১৭ সাল পর্যন্ত এখানেই পড়াশোনা করেন। ১৯১৭ খ্রিষ্টাব্দের শেষদিকে মাধ্যমিকের প্রিটেস্ট পরীক্ষার না দিয়ে তিনি সেনাবাহিনীতে সৈনিক হিসেবে যোগ দেন।

সাহিত্য জীবন
১৯২২ সালে তার বিখ্যাত কবিতা-সংকলন অগ্নিবীণা প্রকাশিত হয়। এই কাব্যগ্রন্থ বাংলা কবিতায় একটি নতুনত্ব সৃষ্টিতে সমর্থ হয়, এর মাধ্যমেই বাংলা কাব্যের জগতে পালাবদল ঘটে। এই কাব্যগ্রন্থের সবচেয়ে সাড়া জাগানো কবিতাগুলোর মধ্যে রয়েছে: “প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, শাত-ইল্-আরব, বিদ্রোহী, কামাল পাশা” ইত্যাদি।
কাজী নজরুল ইসলামের দুটি বৈপ্লবিক সাহিত্যকর্ম বিদ্রোহী কবিতা ও ভাঙ্গার গান সঙ্গীত। এগুলো বাংলা কবিতা ও গানের ধারাকে সম্পূর্ণ বদলে দিয়েছিল। বিদ্রোহী কবিতার জন্য নজরুল সবচেয়ে বেশি জনপ্রিয়।এছাড়াও সঞ্চিতা, চক্রবাক, মরুভাস্কর,সঞ্চয়ন ইত্যাদি কবিতাও উলেখযোগ্য।তাঁর শিশুতোষ কবিতার মধ্যে উল্লেখযোগ্য খুকী ও কাঠবিড়ালি, লিচু-চোর, খাঁদু-দাদু খুব জনপ্রিয়।
ছোট গল্পের মধ্যে ব্যাথার দান, রিক্তের বেদন, শিউলি মালা। উপন্যাস বাঁধন হারা, মৃত্যুক্ষুধা, কুহেলিকা উলেখযোগ্য। নাটক ঝিলিমিলি, আলেয়া,পুতুলের বিয়ে,মধুমালা ইত্যাদি। প্রবন্ধগ্রন্থের মধ্যে যুগবানী, ঝিঙ্গে ফুল, দুর্দিনের যাত্রী, রুদ্র মঙ্গল, ধুমকেতু,রাজবন্দীর জবানবন্দী ইত্যাদি।
কবিতার পাশাপাশি বাংলা গানের ক্ষেত্রেও তাঁর ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নজরুলের গানের সংখ্যা চার হাজারের অধিক। যা নজরুল সঙ্গীত নামে পরিচিত। তিনিই প্রথম বাংলা গজলের প্রবর্তন করেন এবং একে উত্তর ভারতীয় রাগ সংগীতের দৃঢ় ভিত্তির ওপর স্থাপন করেন। সঙ্গীত গ্রন্থাবলী মধ্যে বুলবুল,চোখের চাতক,চন্দ্রবিন্দু, নজরুল গীতিকা, নজরুল স্বরলিপি,গানের মালা উল্লেখযোগ্য। কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ও মন রমজানের ঐ রোজার শেষে এলো খুশির ঈদ’ প্রকাশ করে ঈদের খুশি,আমেজ ও শিক্ষাকে।

জটিল রোগে আক্রান্ত:
১৯৪২ খ্রিষ্টাব্দে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন। এতে তিনি বাকশক্তি হারিয়ে ফেলেন। ১৯৪২ সালের শেষের দিকে তিনি মানসিক ভারসাম্যও হারিয়ে ফেলেন। এরপর নজরুল পরিবার ভারতে নিভৃত সময় কাটাতে থাকে। ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তারা নিভৃতে ছিলেন। ১৯৫২ খ্রিষ্টাব্দে কবি ও কবিপত্নীকে রাঁচির এক মানসিক হাসপাতালে পাঠানো হয়। এরপর ১৯৫৩ খ্রিষ্টাব্দের মে মাসে নজরুল ও প্রমীলা দেবীকে চিকিৎসার জন্য লন্ডন পাঠানো হয়। লন্ডন পৌঁছানোর পর বেশ কয়েকজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক তার রোগ নির্ণয়ের চেষ্টা করেন। ড. হফ বলেন যে, কবি নিশ্চিতভাবে পিক্স ডিজিজ নামক একটি নিউরনঘটিত সমস্যায় ভুগছেন। এই রোগে আক্রান্তদের মস্তিষ্কের ফ্রন্টাল ও পার্শ্বীয় লোব সঙ্কুচিত হয়ে যায়। তিনি আরও বলেন বর্তমান অবস্থা থেকে কবিকে আরোগ্য করে তোলা অসম্ভব। অচিরেই নজরুল ইউরোপ থেকে দেশে ফিরে আসেন।

বাংলাদেশের জাতীয় কবির মর্যাদা
১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে বাঙালিদের বিজয় লাভের মাধ্যমে বাংলাদেশ নামে একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা লাভ করে। ১৯৭২ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ মে তারিখে ভারত সরকারের অনুমতিক্রমে কবি নজরুলকে সপরিবারে বাংলাদেশে নিয়ে আসা হয়। বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমান এক্ষেত্রে বিশেষ উদ্যোগ নিয়েছিলেন। কবির বাকি জীবন বাংলাদেশেই কাটে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দে নজরুলকে স্বাধীন বাংলাদেশের নাগরিকত্ব প্রদানের সরকারী আদেশ জারী করা হয়।ৃপরে তাঁকে জাতীয় কবি হিসেবে ঘোষণা করা হয়।

মৃত্যুবরণ
এরপর যথেষ্ট চিকিৎসা সত্ত্বেও নজরুলের স্বাস্থ্যের বিশেষ কোন উন্নতি হয়নি। ১৯৭৬ সালে নজরুলের স্বাস্থ্যেরও অবনতি হতে শুরু করে। জীবনের শেষ দিনগুলো কাটে ঢাকার পিজি হাসপাতালে। ১৯৭৬ খ্রিষ্টাব্দের ২৯ আগস্ট তারিখে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। নজরুল তার একটি গানে লিখেছেন, “মসজিদেরই পাশে আমায় কবর দিয়ো ভাই / যেন গোরের থেকে মুয়াজ্জিনের আযান শুনতে পাই”:- কবির এই ইচ্ছার বিষয়টি বিবেচনা করে কবিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিস্থ করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয় এবং সে অনুযায়ী তার সমাধি রচিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় মসজিদের পাশে অন্তিম শয়নে শায়িত হোন কাজী নজরুল ইসলাম।
কাজী নজরুল ইসলাম এমন একজন ব্যক্তিত্ব যাঁর নামে ডাকটিকিট প্রকাশ হয়েছে পাকিস্তান, বাংলাদেশ ও ভারত থেকে৷ এমন নজির প্রায় বিরল৷
পাকিস্তান সরকার মুক্তিযুদ্ধের আগে ১৫ ও ৫০ পয়সা দামের ডাকটিকেট প্রকাশ করেছিল কাজী নজরুল ইসলামকে উৎসর্গ করে৷ ঐ ডাকটিকেটে ছিল উর্দু, বাংলা, ইংরাজিতে লেখা দেশের নাম৷ সঙ্গে বাংলায় লেখা ‘গাহি সাম্যের গান…’৷
তাঁর সম্মানে বিভিন্ন সময়ে ডাকটিকিট প্রকাশ করেছে বাংলাদেশ সরকারও৷
পরে ভারত সরকারের তরফে কাজী নজরুল ইসলামের নামে ডাকটিকিট প্রকাশ করা হয়৷ তিন টাকার সেই পোস্টাল স্ট্যাম্প প্রকাশের বছর ১৯৯৯ সাল লেখা রয়েছে৷ সঙ্গে হিন্দি ও ইংরাজিতে কবির নাম৷

জীবনের বেশিরভাগ সময় কেটেছে যার দারিদ্রের সাথে, সেই নজরুলের লেখনীতে একদিকে ছিলো বিদ্রোহ, অন্যদিকে মানবতাবাদী। তার গান জাতিকে জাগরণের পথে প্রেরণা যুগিয়েছে। কবিতা, গান ও গদ্য উপমহাদেশের মানুষকে সংগ্রামে উদ্বুদ্ধ করেছে। একজন সাংবাদিক হিসেবেও নজরুলের সম্পাদিত ‘ধূমকেতু’ গণমানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে অবিস্মরণীয় ভূমিকা পালন করেছে। ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতা রচনার জন্য কবি রাজদ্রোহের অপরাধে কারাদণ্ডে দণ্ডিত হন।
১৯৪৭ সালে দেশভাগের যন্ত্রণায় বিদ্ধ হচ্ছেন৷ আবার সাম্প্রদায়িক সংঘর্ষের বিরুদ্ধে কলম ধরছেন৷ সীমান্তের দুই পারে সাম্যবাদী কবির গান-কবিতা গুঞ্জরিত হয়েছিল৷
পাকিস্তান সরকার বিরোধী গণ মিছিলের স্লোগানে বিদ্রোহী কবির উপস্থিতি৷ ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে প্রেরণা জুগিয়েছে কাজী নজরুল ইসলামের সৃষ্টি দেশপ্রেম ও বিদ্রোহী গান,কবিতা।
নজরুজয়ন্তী উপলক্ষে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পৃথক পৃথক বাণী দিয়েছেন। বর্তমানে করোনা ভাইরাস পরিস্থিতির কারণে জাতীয়ভাবে উন্মুক্তস্থানে কোনো অনুষ্ঠানের আয়োজন হচ্ছে না। তবে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয়সহ বেশ কিছু সংগঠন ভার্চ্যুয়ালি নজরুলজয়ন্তী উদযাপন করবে। নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে সংস্কৃতি বিষয়ক মন্ত্রণালয় বিটিভিসহ বিভিন্ন টেলিভিশনে প্রচারের জন্য ‘জাগো অমৃত পিয়াসী’ শিরোনামে ৫৫ মিনিটের একটি অনুষ্ঠান তৈরি করেছে। যা সোমবার সকাল ১১টা থেকে নিকটতম সময় প্রচারিত হবে। এতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাণী প্রচারিত হবে।
নজরুলজয়ন্তী উপলক্ষে শিল্পকলা একাডেমির আয়োজনে থাকছে ‘শান্তির জয় হোক, সাম্যের জয় হোক’ শীর্ষক অনুষ্ঠান। একাডেমির মহাপরিচালক লিয়াকত আলী লাকীর পরিকল্পনায় যা বিকেল তিনটায় একাডেমির ফেসবুক পেজে প্রচারিত হবে। ‘নব যুগ ঐ এল ঐ’ শীর্ষক বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করেছে ছায়ানট। সন্ধ্যা সাতটায় ছায়ানটের ইউটিউব চ্যানেলে দেখা যাবে অনুষ্ঠানটি।
আরো দেখুন,
শিব নারায়ণ, যার আঁকা পতাকা স্বপ্ন দেখিয়েছিল স্বাধীন বাংলাদেশের