আমরা নিজেরা সুস্থ দাবী করি ততক্ষণ, যতক্ষণ আমরা ডাক্তারের কাছে যেতে বাধ্য না হই। তার মানে কি আমাদের শরীরে কোন সমস্যা নেই? আসলেই কি তাই? আজকাল চারপাশে এত স্বাস্থ্যসমস্যা মধ্যে কিডনি নিয়ে ভুগছে কত শত, হাজার মানুষ তা বেশিরভাগই অজানা। অথচ সহজ কিছু উপায় আছে যার মাধ্যমে কিডনির যত্ন নেয়া যায়। আসুন জেনে নিই।
মানুষের শরীরে দুটি কিডনি থাকে যেগুলো শরীরের পানির ভারসাম্য রক্ষা করে এবং বিভিন্ন দূষিত পদার্থ ছেঁকে ফেলে। এই কিডনি যদি আপনার শরীরের কাজ না করে তবে আমরা বলে থাকি কিডনি নষ্ট হতে চলেছে। আর কিডনি কাজ না করলে শরীরে নানাবিধ সমস্যা দেখা দেবে।
কিডনি রোগ একটি নীরব ঘাতক। কিডনির সমস্যা প্রথম দিকে বোঝা যায় না। তবে যখন সমস্যা প্রকোট হয় তখন আপনার নানাবিধ শরীরিক সমস্যা দেখা দেয়। বাংলাদেশে কিডনি রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা প্রতিনিয়ত বাড়ছে। প্রতিবছর অনেক মানুষ এ রোগে মৃত্যুবরণ করে। এ ধরনের রোগের চিকিৎসাও বেশ ব্যয়বহুল। তাই আগে থেকেই কিডনির যত্ন নেয়া উচিত।
শরীরে ফ্লুয়িড ব্যালেন্স ঠিক রাখা
কিডনি ভালো রাখতে শরীরের ফ্লুয়িড ব্যালেন্স ঠিক রাখা জরুরি। নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে পানি খেলে কিডনি আরও বেশি কার্যকর হবে। বেশি বেশি পানি খেলে প্রস্রাব থাকবে স্বচ্ছ আর হালকা, আর যদি দেখেন তা হলদেটে বা আরো গাঢ় রং-এর তাহলে বুঝবেন, পানি খাওয়াটা কম হচ্ছে। নিয়মিত প্রয়োজনের তুলনায় কম পানি খাওয়া আপনার কিডনির জন্য খারাপ কিছু বয়ে আনতে পারে। তাই প্রতিদিন অন্তত ৮ গ্লাস পানি বা তরল খাবার খাওয়া উচিত। তবে অতিরিক্ত ঘাম হলে পানি খাওয়ার পরিমাণ আরও বাড়াতে হবে। পর্যাপ্ত পরিমাণে পানি খেলে কিডনিতে পাথর হয় না এবং এর স্বাভাবিক কার্যক্রম ঠিক থাকে।
খাবারে থাকুক ভারসাম্য
শরীরের জন্য খাবার যে দরকার তা তো সবার জানা। তবে শরীরের জন্য খাবারের সঠিক ভারসাম্য রাখা চাই। প্রতিদিনের তালিকাভুক্ত খাবারে যেন মিনারেল এবং ভিটামিনের উপস্থিতি থাকে তা অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে। বিভিন্ন খাবারের পাশাপাশি শাক-সবজি খেতে হবে প্রচুর পরিমাণে। আর আমাদের দেশে প্রায় সারাবছরই মৌসুমি ফল পাওয়া যায়, আর গ্রীষ্মে তো রীতিমত ফল উৎসবই থাকে। তাই উল্লেখযোগ্য পরিমাণে খেতে হবে বিভিন্ন রকমের ফল। আর এসব খাবার নিয়মিত খেলে তা কিডনিকে ভালো এবং অ্যাকটিভ রাখতে সাহায্য করবে। মানুষের শরীরে প্রতিদিন মাত্র ১ চা চামচ লবণের চাহিদা থাকে। তাই সেই সাথে অবশ্যই অতিরিক্ত লবণ ও স্নেহ বা চর্বিযুক্ত খাবার এড়িয়ে যেতে হবে।
গরমে কিডনির বিশেষ যত্ন
গ্রীষ্মকাল প্রায় এসেই গেছে। আর এই সময়ে বাইরে কাঠফাটা রোদ আর গনগনে গরম কতখানি তা টের পাওয়া যায় বাইরে কাজে বের হলে, বেড়াতে গেলে, খেলাধুলা কিংবা ব্যায়াম করতে গেলে। অসহ্য এই গরমে অল্পতেই ঘেমে যাওয়া, ক্লান্ত হয়ে পড়ার কারণে শরীরে পানির পরিমাণ কমে যায় অনেকখানি। দেখা দিতে পারে নানা অসুখ-বিসুখ, বাজে প্রভাব পড়তে পারে কিডনির উপরও। তাই গরমের সময় কিডনিকে ভালো রাখতে খেতে হবে স্বাভাবিকের চাইতে বেশি পানি।
ওজন রাখুন নাগালের মধ্যেই
খাবার ছাড়া আমরা বাঁচতে পারি না এটা ঠিক। তবে অতিমাত্রায় খাওয়ার ফলে ওজন বৃদ্ধি পায়। আর এই ওজন বৃদ্ধি ভবিষ্যতে ডায়াবেটিস আর উচ্চ রক্তচাপের সম্ভাবনা বাড়িয়ে দেয় যা কিনা কিডনি রোগের অন্যতম মূল কারণ। কারণ রক্ত চাপ যদি খুব বেড়ে যায় তবে তা কিডনির জন্য বড় ধরণের হুমকি। অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসের ফলে রক্তে বেড়ে যাওয়া সুগারও একইভাবে কিডনির জন্য ক্ষতিকর। তাই অতিমাত্রায় খেয়ে মুটিয়ে যাওয়া নয় বরং পরিমিত খাবার খেয়ে নিজের শরীরের ওজন নিয়ন্ত্রণ করুন। যা আপনাকে রাখবে অ্যাকটিভ আর রক্ত চাপ রাখবে নিয়ন্ত্রণে আর ডায়াবেটিস কে রাখবে দূরে। ফলে কিডনি থাকবে ভালো এবং ঝুঁকিমুক্ত।
কিডনির পরীক্ষা করান
উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস, অতিরিক্ত ওজন অথবা পরিবারের কারও কিডনি সমস্যা থাকলে কিডনি রোগ হওয়ার ঝুঁকি বেশি থাকে। যাদের কিডনি রোগের ঝুঁকি আছে তাদের অবশ্যই নিয়মিত কিডনি পরীক্ষা করানো উচিত।
টুকিটাকি ওয়ার্কআউট চলতে থাকুক
সারাদিন অফিস, ক্লাস কিংবা কাজের মাঝে ব্যাস্ত থাকি। কখনও টানা এক জায়গাতেই বসে থাকি ঘণ্টার পর ঘণ্টা এতে শরীরে এক ধরণের অলসতা, অসাড়তা চলে আসে। আর দিনের পর দিন এভাবে চলতে থাকলে শরীরের জন্যও তা খারাপ কিছু বয়ে নিয়ে আসতে পারে। তাই প্রতি সপ্তাহে অন্তত ১.৩০ ঘণ্টা টুকিটাকি ওয়ার্কআউট করা উচিত। যেমন একটু হাঁটাহাঁটি, কিংবা জগিং, কিংবা বন্ধুদের সাথে সাইক্লিং করা, আর সুযোগ থাকলে সাঁতারের চেষ্টা করা। সপ্তাহে মাত্র ১.৩০ ঘণ্টা, দিনে ২০-২২ মিনিট ওয়ার্কআউট কি খুব বেশি? অথচ প্রতিদিনের একটুখানি এই ওয়ার্কআউট আপনাকে রাখবে অ্যাকটিভ ও ফিট। যা কিডনিকে ভালো রাখতে সহায়ক ভুমিকা পালন করবে।
কিডনি সমস্যাজনিত কিছু কথা
ক্রনিক কিডনি ডিজিজ বা দীর্ঘমেয়াদি স্থায়ী কিডনি রোগের শেষ ধাপের রোগীদের জীবনভর ডায়ালাইসিস করতে হয় অথবা কিডনি প্রতিস্থাপনের প্রয়োজন পড়ে। কিন্তু এগুলো ব্যয়সাপেক্ষ। তাই ক্রনিক কিডনি ডিজিজ প্রতিরোধই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। এ ক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে, বিশ্বজুড়ে কিডনি বিকলের অন্যতম কারণ হলো ডায়াবেটিস। দীর্ঘদিনের ডায়াবেটিস, বিশেষত অনিয়ন্ত্রিত ডায়াবেটিসে কিডনির কার্যকারিতা কমে গিয়ে প্রস্রাবের সঙ্গে প্রোটিন বা আমিষ যেতে শুরু করে। এ সমস্যাকে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি বলে। এর শেষ ধাপ হলো এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজ।
বংশগত কারণে আমাদের দেশে ডায়াবেটিক নেফ্রোপ্যাথি হওয়ার প্রবণতা বেশি। কাজেই ডায়াবেটিস ধরা পড়ার প্রথম থেকেই কিডনির বিষয়ে সচেতন হতে হবে। ৬ থেকে ১২ মাস অন্তর রক্তের ক্রিয়েটিনিন ও প্রস্রাবের আমিষ পরীক্ষা করতে হবে। এসব পরীক্ষা খুবই অল্প খরচে করা যায়। নিয়মিত এসব পরীক্ষায় ডায়াবেটিসজনিত কিডনি রোগ শুরুতেই নির্ণয় করা সম্ভব। আর শুরুতে ধরা পড়লে, আর খুব ভালো করে ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ করতে পারলে এন্ড স্টেজ রেনাল ডিজিজ প্রতিরোধ করা যায়।
মূত্রতন্ত্রের নানা বাধাজনিত কারণে, বারবার সংক্রমণে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করলে এবং বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগে কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে।
উচ্চ রক্তচাপ কিডনি বিকলের আরেকটি অন্যতম কারণ। অনেক রোগীই মনে করেন, উচ্চ রক্তচাপ থাকলে ঘাড়ে বা মাথায় ব্যথা হবে। কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, হাইপারটেনশন বা উচ্চ রক্তচাপ মূলত নীরব ঘাতক। অর্থাৎ রক্তচাপ অনেক বেশি হলেও রোগী অনেক সময় উপসর্গ অনুভব করেন না। অনিয়ন্ত্রিত উচ্চ রক্তচাপের রোগীরাও একসময় কিডনি রোগে আক্রান্ত হন। কাজেই উচ্চ রক্তচাপের রোগীর জীবনযাপন প্রণালি, খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন, নিয়মিত রক্তচাপ পরিমাপ ও প্রয়োজনীয় ওষুধ গ্রহণ করে যেতে হবে। বয়স হলে রক্তচাপ একটু বাড়তি থাকে—এমনটা ভেবে অনেকেই বিষয়টিকে অবহেলা করেন। অনেকে ওষুধ শুরু করেও বন্ধ করে দেন। কিন্তু উপসর্গ থাকুক বা না থাকুক, উচ্চ রক্তচাপ ধরা পড়লে এর ওষুধ সারা জীবন খেয়ে যেতে হয়। চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী, বিশেষ ক্ষেত্র ছাড়া এক দিনের জন্যও ওষুধ বন্ধ করা উচিত নয়।
গ্লোমেরুলোনেফ্রাইটিস কিডনির একটি রোগ। এ রোগের প্রধান লক্ষণ শরীর, হাত-পা ফুলে যাওয়া। হেপাটাইটিস-বি ও সি ভাইরাস যকৃতের অসুখ। এই দুটি ভাইরাসসহ অনেক ভাইরাসই কিডনিকেও আক্রান্ত করে। এ ছাড়া মূত্রতন্ত্রের নানা বাধাজনিত কারণে, বারবার সংক্রমণে, চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া ওষুধ সেবন করলে এবং বিভিন্ন দীর্ঘমেয়াদি রোগে কিডনি জটিলতা দেখা দিতে পারে। কাজেই যেকোনো সমস্যায় অবহেলা না করে চিকিৎসকের পরামর্শে চিকিৎসা নিতে হবে।
কিডনি রোগ প্রতিরোধে কিডনি সম্পর্কে জানুন, কিডনির যত্ন নিন, ডায়াবেটিস ও রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণে রাখুন, স্বাস্থ্যকর জীবনযাপন করুন।