পৃথিবী যেন বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যেসব জায়গা মানুষের পদচারণায় মুখর থাকে, সেগুলো এখন মানুষ শূণ্য। প্রতিদিনের চলাচলের উপর নিষেধাজ্ঞা, স্কুল বন্ধ, ভ্রমণের উপর নিষেধাজ্ঞা, গণ-জমায়েতের উপর বিধিনিষেধ – এসব কারণে এ পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে। কোভিড-১৯ বর্তমান বিশ্বে ভয়াবহ আকার ধারণ করছে। আমাদের দেশেও এখন এটি আক্রমণ করেছে। এখনই যদি আমরা সচেতন হই তাহলে এটা প্রতিরোধ করা সম্ভব। একটি রোগে ঠেকানোর ক্ষেত্রে পুরো বিশ্ব যেভাবে প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে, সেটি নজিরবিহীন। কিন্তু এর শেষ কোথায়? মানুষ কবে নাগাদ তাদের স্বাভাবিক দৈনন্দিন জীবনে ফিরতে পারবে?
আমাদের দেশ এখন কোভিড-১৯ এর স্টেজ-২ এর মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, এর মানে এখনও ভাইরাস রোগীর থেকে তার কাছাকাছি এর মধ্যেই ছড়াচ্ছে। এর পরের স্টেজ-৩ শুরু হলে ভাইরাস সবার মাঝে ছড়াতে শুরু করবে এবং সেটা হবে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে (এই রোগটা মারাত্মক রকম ছোঁয়াচে)। ঠিক এমনটাই হয়েছে ইতালি ও ইরানে। দুই সপ্তাহের মধ্যে রোগীর সংখ্যা দেড়’শ থেকে প্রায় দশ হাজার হয়ে গেছে।
কোভিড-১৯ স্টেজ-২ তেই আটকে না রাখতে পারলে আগামী এক মাসের মধ্যেই আমাদের দেশেও রোগীর সংখ্যা ১৭ থেকে লক্ষাধিক হয়ে যাবে। তখন পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। যদিও করোনা ভাইরাসে মানুষ মারে কম, কিন্তু এতো বেশী সংখ্যক রোগীর চিকিৎসা দেওয়ার মতো পরিকাঠামো রাতারাতি তৈরী করা অসম্ভব।
আমাদের দেশের কোভিডের স্টেজ-২ থেকে-৩ তে যাওয়া আটকাতে শুধু সরকার বা প্রশিক্ষিত স্বাস্থ্যকর্মী যথেষ্ট নয়। এটা পারি আমি, আপনার মতো আমরা সকলে। এই রোগটি একজন কয়েক’শ জনের মধ্যে, কয়েক’শ কয়েক হাজারের মধ্যে ছড়াতে পারে।
ব্রিটেনের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসন বলেছেন, “আগামী ১২ সপ্তাহের মধ্যে করোনাভাইরাসের ‘ঢেউ উল্টোপথে ঘুরিয়ে’ দিতে সক্ষম হবে ব্রিটেন।”
তবু সঙ্কার বিষয় এই যে, আগামী তিনমাসের মধ্যে আক্রান্তের সংখ্যা কমে আসলেও করোনাভাইরাসের সংক্রমণ পুরোপুরি শেষ হতে অনেক সময় বাকি। সম্ভবত কয়েকবছর পর্যন্ত লাগতে পারে।
এটা পরিষ্কার যে যেভাবে বড় বড় শহর বন্ধ রাখা হচ্ছে এবং মানুষের দৈনন্দিন চলাফেরারা উপর বিধি আরোপ করা হচ্ছে, সেটি দীর্ঘমেয়াদি চালিয়ে যাওয়া সম্ভব নয়। এভাবে সবকিছু বন্ধ থাকলে সামাজিক এবং অর্থনৈতিক প্রভাব হবে মারাত্মক।
এ অবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার জন্য দেশগুলোকে একটি কৌশল খুঁজে বের করতে হবে। বিধিনিষেধগুলো প্রত্যাহার করে স্বাভাবিক জীবনে ফিরে আসার উপায় খুঁজতে হবে। একথা ঠিক যে বিধিনিষেধ আরোপের ফলে করোনাভাইরাসের বিস্তার ঠেকিয়ে রাখা সম্ভব হয়েছে। এসব বিধিনিষেধ তুলে দিলে সংক্রমণের সংখ্যা অনেক বৃদ্ধি পাবে।
এখান থেকে বেরিয়ে আসার জন্য কৌশল কী হবে এবং সেখান থেকে আমরা কিভাবে বের হয়ে আসবো?
এই কৌশল ঠিক করা বড় ধরণের বৈজ্ঞানিক এবং সামাজিক চ্যালেঞ্জ।
- ১. টিকা দেয়া
- ২. বহু মানুষের মধ্যে ভাইরাস সংক্রমণের ফলে তাদের মধ্যে এ নিয়ে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠবে
- ৩. অথবা স্থায়ীভাবে মানুষ এবং সমাজের আচার-আচরণে পরিবর্তন নিয়ে আসা
টিকা আসতে সময় লাগবে ১২ থেকে ১৮ মাস। এই টিকা গ্রহণ করলে করোনাভাইরাসের সংস্পর্শে আসলেও তারা অসুস্থ হবে না। যত বেশি সংখ্যক মানুষকে টিকা দেয়া যাবে ততই ভালো। যদি মোট জনসংখ্যার ৬০ শতাংশকে টিকা দেয়া হয়, তাহলে এই ভাইরাস ছড়িয়ে পড়বে না। করোনাভাইরাসের টিকা আবিষ্কারের জন্য বেশ দ্রুত গতিতে কাজ চলছে। কিন্তু এটি সফল হবে কিনা কিংবা বিশ্বজুড়ে এই টিকা দেয়া যাবে কি না – সে নিশ্চয়তা নেই। তাই প্রাকৃতিকভাবে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা গড়ে উঠার উপর নির্ভর করছে।
ইতোমধ্যে আমেরিকায় এক ব্যক্তির দেহে পরীক্ষামূলক-ভাবে করোনাভাইরাসের টিকা দেয়া হয়েছে। যে কোন টিকা আবিষ্কার করলে সেটি প্রথমে পরীক্ষা-নিরীক্ষার করা হয় যে কোন প্রাণির উপর। এক্ষেত্রে বিশেষ অনুমোদন নিয়ে প্রথমেই মানুষের উপর প্রয়োগ করা হয়েছে।
করোনাভাইরাসের সংক্রমণ মোকাবেলার জন্য জন্য ব্রিটেন যে কৌশল নিয়েছে সেটি হচ্ছে, আক্রান্তের সংখ্যা যতটা সম্ভব কমিয়ে আনা যাতে হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ না হয়ে যায়। হাসপাতালগুলো রোগীতে পরিপূর্ণ হয়ে গেলে আইসিইউতে জায়গা পাওয়া যাবে না। ফলে মৃতের সংখ্যা বাড়তে থাকবে।

কিন্তু এ কৌশলের মাধ্যমে গড়ে ওঠা রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা কতদিন টিকবে সেটি নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। অতীতে করোনাভাইরাসের অন্যান্য ধরণের যেসব সংক্রমণ হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে রোগ প্রতিরোধ ব্যবস্থা খুব ভালো কাজ করেনি। অনেকে মানুষ তাদের জীবনে বেশ কয়েকবার আক্রান্ত হয়েছে।
বিকল্প আর কী উপায় আছে?
এই পিরিস্থিতি মোকাবেলায়, আমাদের আচার-আচরণে স্থায়ী পরিবর্তন নিয়ে আসা যার ফলে সংক্রমণের মাত্রা বেশি না হয়।
হাসপাতালে চিকিৎসা দেবার মাধ্যমে এই রোগের মাত্রা কমিয়ে আনা যাতে আইসিইউ বা নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্রের উপর চাপ কমে। এটি করা সম্ভব হলে সবকিছু বন্ধ করে দেয়া বা লকডাউনের আগে দেশগুলো বেশি রোগী সামাল দিতে পারবে।
এছাড়া হাসপাতালের নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র বা আইসিইউতে বেশি শয্যার ব্যবস্থা করে অধিক সংখ্যক রোগী সেবা দেয়া সম্ভব। পরিস্থিতি মোকাবেলার জন্য এটিও একটি উপায়।
তাই টিকা দেয়াটাই হচ্ছে দীর্ঘ মেয়াদে সমাধান।
কোভিড-১৯ না ছড়ানোর জন্য আপনার আমার যা করতে হবে।
১. সরকারের সমস্ত উপদেশ ও নির্দেশিকা মেনে চলতে হবে। |
২. একান্ত প্রয়োজন না থাকলে সামাজিক অনুষ্ঠানে যাবেন না। নিজের কোনো সামাজিক অনুষ্ঠান থাকলেও সেটা পিছিয়েদিন। সামাজিক মেলামেশা থেকেই সবার মাঝে এই রোগ ছড়ানোর বড় কারণ। যদি কাউকে এই সব অনুষ্ঠানে যেতেই হয়, সরকারি নির্দেশিকা অনুসারে প্রটেকশন নিন (বার বার হাত ধোয়া, কনুই দিয়ে মুখ ঢেকে কাশা ইত্যাদি)। |
৩. খুব প্রয়োজন না থাকলে, বাইরে যাওয়া বর্জন করুন। |
৪. কাশি, জ্বর, শ্বাসকষ্ট হলে সাথে সাথে ডাক্তারের পরামর্শ নিন। নিজে নিজে চিকিৎসা বা ডায়াগনসিস করার চেষ্টা করবেন না। |
৫. ডাক্তার আপনাকে আইসোলেশনে যেতে বা হোম কোয়ারেন্টিনে থাকতে পরামর্শ দিলে যথাযত ভাবে তা মেনে চলতে হবে। |
আপনার, আমার সচেতনতাই পারে কোভিড-১৯ কে রুখে দিতে।
আইইডিসিআরের যোগাযোগের জন্য ০১৯৪৪৩৩৩২২২ অথবা ১০৬৫৫ নম্বরে যোগাযোগের পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এখান থেকে হান্টিং নম্বরের মাধ্যমে অন্যান্য নম্বরে টেলিফোনটি চলে যাবে। এছাড়া ১৬২৬৩ নম্বরেও যোগাযোগ করা যাবে।
আজ বুধবার ২৫ মার্চ এখন পর্যন্ত, বাংলাদেশে করোনাভাইরাসে মোট সংক্রমিত হয়েছেন ৩৯জন। তাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। আর সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন সাতজন।