ছোট থেকে শুরু করে বড় গেম খেলতে কার না ভালো লাগে!!আমরা সবাই কমবেশি গেম খেলে থাকি। কিন্তু বর্তমান সময়ে এই গেমই একটি জাতির ভবিষ্যৎ অর্থাৎ ছাত্র সমাজের অবক্ষয়ের অন্যতম কারণ!! স্বাস্থ্য সংস্থা এই প্রথমবারের মত ভিডিও গেমে আসক্তিকে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার তালিকাভুক্ত করেছে ২০১৮ সালের জুন মাসে। আন্তর্জাতিক পর্যায়ে রোগব্যাধির শ্রেণি বিন্যাসের তালিকায় এই আসক্তিকে ”গেমিং রোগ” বলে চিহ্নিত করা হয়েছে।
গেম এডিক্টেড হওয়ার কারণ
- বাংলাদেশ আয়তনে ছোট হলেও বিপুল পরিমাণ জনগোষ্ঠী নিয়ে গঠিত। যার কারণে মানুষের বসবাসের জন্য প্রতিনিয়ত গড়ে ওঠে অ্যাপার্টমেন্ট। এতে করে খেলার মাঠ পর্যাপ্ত পরিমাণে না থাকায় ছাত্ররা তাদের অবসর সময় কাটায় গেম খেলে।
- অনেকে পারিবারিক দ্বন্দ্বের কারণে মা ও বাবার অনাদর এর কারণে গেমকে বন্ধু হিসেবে বেছে নেয়। এভাবেই তারা গেম এডিক্টেড এ পরিনত হয়
- সন্তানকে শান্ত রাখতে মুঠোফোন তাদের হাতে তুলে দেন ব্যস্ত মা–বাবারা। এতে করে কম বয়সেই তারা গেমের দেখা পায়।
সাইফুল ইসলাম বলেন, "শহরের কোলাহলে সন্তানের বিনোদনের জন্য প্লে-জোনই আমাদের একমাত্র ভরসা। কিন্তু বেশিরভাগ প্লে-জোনের সার্ভিসম্যানদের নেই কোনো প্রশিক্ষণ। তারা জানেন না কোন বয়সের শিশুদের জন্য কোন গেম উপযোগী। তাদের কাজ হল কোনো বিবেচনাবোধ ছাড়াই যে কোনো বয়সের শিশুদের যে কোনো গেমস খেলতে উদ্বুদ্ধ করা। "
একজন মা তার সন্তানদের সম্পর্কে বলেন, ‘আমি আমাদের ছেলেদের অনেক ভালো ভালো লেখকদের বই কিনে দেই। আমি চাই ওরা বই পড়ে শিখুক। কিন্তু না, তাদের কথা হলো—তাদের সব বন্ধুরা গেম খেলছে, তারাও খেলবে।’
গেমিং এর ইতিবাচক দিক
- বর্তমানে অনেক ছাত্ররা তাদের পড়াশুনার ও পরিবারের ভরণপোষণের জন্য ইউটিউবে বিভিন্ন গেম নিয়ে ব্লগ করছে এতে করে তাদের আর্থিক উপার্জন হচ্ছে।
- ছাত্ররা ছাড়াও অনেকে কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে গেম এর মাধ্যমে বিভিন্ন ব্রেইন গেমস এর মাধ্যমেও ছাত্ররা তাদের মেধাকে কাজে লাগাতে পারে এতে করে তাদের ব্রেইন শার্প হয়।
- একটি গবেষণায় দেখা গেছে ছাত্রদেরকে বইয়ের প্রতি আগ্রহী করতেও ভিডিও গেম প্রভাব বিস্তার করতে পারে। গবেষণা মতে, ‘এইজ অব মিথোলজি’ নামক একটি ভিডিও গেম খেলার পর কিছু ছাত্র মিথোলজির প্রতি আকৃষ্ট হয়ে মিথোলজি বা পৌরাণিক বই পড়তে কিংবা পৌরাণিক বিভিন্ন চরিত্র নিয়ে আলোচনা করতে আগ্রহী হয়ে ওঠে।
- উন্নত বিশ্বে ক্লাসরুমে ভিডিও গেমের মাধ্যমে গ্রামার, ভোকাবুলারি এবং অঙ্ক শিক্ষাও দেওয়া হচ্ছে। সেই সঙ্গে গেম খেলার মাধ্যমে লিসেনিং এবং রিডিং স্কিল বাড়ানো সম্ভব।
- ক্রুসেডার কিং, ভিক্টোরিয়া, মেডিয়েভাল, এনসিয়েন্ট রোম, নেপোলিয়নসহ বিভিন্ন ভিডিও গেম খেলার মাধ্যমে পৃথিবীর বিভিন্ন সময়ের ইতিহাস সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করা সম্ভব।
- বাড়ন্ত বয়সি অনেক ছেলেমেয়ে আজকাল খারাপ সঙ্গ, আড্ডা কিংবা মাদকের মতো ভয়াবহ দিকে ঝুঁকে পড়ছে। বিভিন্ন এলাকায় গড়ে তুলছে কথিত গ্যাং বা মাস্তান বাহিনী। এক্ষেত্রে ভালো ভালো গেম খেলার মাধ্যমে তারা বিনোদন ও জ্ঞানলাভের পাশপাশি এসব ঝুঁকি থেকে নিরাপদ দূরত্বে থাকতে পারে।
গেমিং এর নেতিবাচক দিক
- খসড়া একটি নথিতে ভিডিও গেমে আসক্তিকে একটা আচরণগত সমস্যা হিসাবে উল্লেখ করে বলা হয়েছে এই আচরণে আসক্তির সব লক্ষ্মণ রয়েছে অর্থাৎ বারবার এই খেলার প্রবণতা দেখা যায় এবং এর থেকে সরে আসা কঠিন বলেও দেখা যায়। এছাড়াও ‘‘জীবনের অন্যান্য সব কিছু ছাপিয়ে প্রাধান্য পায়’‘ এই গেমিং-এর নেশা।
- মনোরোগ বিশেষজ্ঞরা বহু দিন ধরে বলছিলেন, “ভিডিও গেমের অতিরিক্ত আসক্তিতে এক দিকে যেমন শিশু-কিশোরদের সামাজিকীকরণ বাধাগ্রস্ত হয়, তেমনি মেধা বিকাশেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ে।”
- বিষয়টিকে নজরে নিয়ে ব্রিটেনসহ কয়েকটি দেশ বিশেষ ক্লিনিক স্থাপনের পাশাপাশি পর্যাপ্ত মনিটরিং শুরু করলেও এক্ষেত্রে অনেকটাই পিছিয়ে বাংলাদেশ। প্লে-স্টেশনে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপটে তৈরি করা একটা গেমের প্রায় পুরোটা জুড়েই দেখা যায়, যুদ্ধ সহিংসতা আর রক্তপাত। এই খেলাগুলো আসলে শিশুদের ওপর কেমন প্রভাব ফেলে?
- ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক ড. নাসরিন ওয়াদুদ বিবিসিকে বলেন, “প্রতিনিয়ত এসব ভিডিও গেম খেললে শরীরে এক ধরনের হরমোন নিঃসারণ হয়। এতে শিশু সবকিছু নিয়েই উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাবা-মায়ের অবাধ্য হয়ে যায়। মেজাজ খিটমিটে হয়ে যায়।”
- “গেমিং ডিজঅর্ডার” এর এমন বিভিন্ন লক্ষণের ব্যাপারে ড. ওয়াদুদ বলেন, “লক্ষ্য রাখতে হবে শিশু কতটুকু সময় ধরে গেম খেলছে। মা-বাবা খেলা বন্ধ করতে বললে সে কেমন প্রতিক্রিয়া দেখায়। কিছু কিছু বাচ্চা আছে যাদের গেম খেলতে নিষেধ করলে তারা ভীষণ রেগে যায়, ভীষণ চ্যাঁচামেচি করে। সেক্ষেত্রে বুঝতে হবে সে হয়তো গেমে আসক্ত। ”
- অতিরিক্ত গেমিং এর ফলে অনেক ছাত্ররা পরিক্ষায় ভালো স্কোর করতে পারছে না।
প্রতিকার
দক্ষিণ কোরিয়ায় তো সরকার এমন আইন করেছে যাতে ১৬ বছরের কম বয়সি শিশুরা মধ্যরাত থেকে ভোর ছয়টা পর্যন্ত অনলাইন গেম খেলতেই না পারে। জাপানে কেউ যদি একটি নির্দিষ্ট সময়ের বেশি গেম খেলে তাকে সতর্কবার্তা পাঠানো হয়। চীনের ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠান টেনসেন্ট শিশুরা কতক্ষণ গেম খেলতে পারে তার সময় বেঁধে দিয়েছে।
বাংলাদেশে এখনো এমন কোনো উদ্যোগ নেই। মিসেস মতিন বলেন, সেই সঙ্গে সংকুচিত হচ্ছে বাইরে খেলাধুল বা বিনোদনের সুযোগ। ‘সরকার বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ যারা আছেন তারা যদি এই বাচ্চাদের কথা ভেবে কিছু উদ্যোগ নেন তাহলে হয়তো পরিস্থিতি বদলে যাবে। এই যে আশেপাশে কিছু মাঠ আছে সেগুলো যদি সংস্কারের সুযোগ করে দেয়। সিনেমা হলগুলোতে যেন বাচ্চাদের নিয়ে ভালো ছবি দেখতে পারি।’