বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি নির্ভর আমাদের দৈনন্দিন জীবনে টেলিভিশন আশীর্বাদস্বরূপ। মূলত বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে বহুল ব্যবহৃত এই গণমাধ্যমটি শিক্ষাক্ষেত্রে আনতে পারে অকল্পনীয় বিবর্তন।
১৯২৫ সালে আবিষ্কৃত দূরদর্শন যন্ত্রটি প্রথম ব্যবহৃত হয় ১৯৩০ সালে ইংল্যান্ডে। ১৯৬৪ সালে বাংলাদেশে অর্থ্যাৎ তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ১৯৬৪ সালের ২৫ ডিসেম্বরে উদ্বোধন হয় পাকিস্তান টেলিভিশনের ঢাকা কেন্দ্রের। পরবর্তীতে ১৯৬৮ সালে সরকারিভাবে রামপুরা টিভি সম্প্রচার কেন্দ্র চালু করা হয় এবং ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠার পর ১৭ ডিসেম্বরে পাকিস্তান টেলিভিশন রূপান্তরিত হয় বাংলাদেশ টেলিভিশনে।
একসময়ে উচ্চবিত্তদের ঘরে বিলাসদ্রব্য হিসেবে শোভা পেলেও আজ সহজলভ্যতার কারণে টেলিভিশন শোভা পাচ্ছে সকলের ঘরেই। বিনোদন মাধ্যমের পাশাপাশি দেশ-বিদেশের নানা অজানা তথ্যের ভান্ডার হিসেবে কাজ করে যাচ্ছে এই দূরদর্শন যন্ত্রটি। শুধু তথ্যপ্রদানেই এটি সীমাবদ্ধ থাকে না,বরং দৃশ্যত তথ্যগুলোর প্রমাণ ফুটে তোলায় টেলিভিশনের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে।
করোনা নামক মহামারীতে আজ পৃথিবী তটস্থ। থমকে আছে বিশ্ব মানবতা। এমতাবস্থায় বেশ একঘেয়েমি অবসর কাটাতে হচ্ছে আমাদের শিক্ষার্থীদেরও।এই অস্বাভাবিক পঙ্গুত্ব থেকে পরিত্রাণের পথ হয়ে দাড়াতে পারে টেলিভিশন।
বাংলাদেশের প্রায় ৮০ শতাংশ ঘরে আজ টেলিভিশন রয়েছে। সংস্কৃতি, বিনোদন, সংবাদ প্রচারের পাশাপাশি শিক্ষা প্রসারেও ভূমিকা রাখতে পারে এই যন্ত্রটি। শুধু দরকার কিছু বাস্তবমুখী পরিকল্পনা এবং তার বাস্তবায়ন।
বিশ্বের অনেক দেশে অনলাইনে শিক্ষাদানের পাশাপাশি টেলিভিশন চ্যানেলের মাধ্যমে শিক্ষাদান কর্মসূচিকে এগিয়ে নেওয়াকে সম্ভাবনাময় গণ্য করা হয়েছে।শিক্ষামূলক উপকরণ হিসেবে এই যন্ত্রটির ব্যবহার উপলব্ধি করা হয় যুক্তরাষ্ট্রে। ১৯৩২ সালের যুক্তরাষ্ট্রের আইওডব্লিওএ এর স্টেট ইউনিভার্সিটি দ্বারা বিশ্বমেলায় পরীক্ষামূলকভাবে প্রকাশিত হয় বিষয়টি। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে এই পরীক্ষামূলক কার্যক্রমে মন্থরতা দেখা দেয় এবং আগ্রহ থাকা সত্ত্বেও অনেক প্রতিষ্ঠানই টেলিভিশনকে শিক্ষামাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করতে পারেনি।পরবর্তীকালে শিক্ষা প্রসারে টেলিভিশনের গুরুত্ব উপলব্ধি করে ১৯৫২ সালে অলাভজনক ও অবাণিজ্যিক হিসেবে শিক্ষামূলক সম্প্রচারের জন্য ২৪২ টি ফ্রিকোয়েন্সি সংরক্ষণ করেছিল “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ফেডারেল যোগাযোগ কমিশন “।
দূরবর্তী শিক্ষার অগ্রদূত হল দ্যা ইউ কে ওপেন ইউনিভার্সিটিকে। তারাই টেলিভিশনের শিক্ষামূলক দিকে আলোকপাত করেন। ‘৬০ এর দশকে টেলিভিশন স্টেশনগুলির সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পায় এবং ১৯৭২ সালে তা বেড়ে দাড়ায় ২৩৩ টিতে। অন-ক্যাম্পাস এবং অফ-ক্যাম্পাস উভয় ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের জন্য নেটওয়ার্ক তৈরিতে পথপ্রদর্শক হিসেবে কাজ করেছে ওহিও বিশ্ববিদ্যালয়, টেক্সাস বিশ্ববিদ্যালয় এবং মেরিল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়।
পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেও টেলিভিশনকে শিক্ষা ও উন্নয়নের মাধ্যম হিসেবে গ্রহণ করা হয়েছে। প্রাথমিক থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণেও শিক্ষাদানের মাধ্যম হিসেবে গণ্য করা হচ্ছে টেলিভিশনকে। ইউজিসি-উচ্চশিক্ষা টেলিভিশন প্রকল্প, ১৯৮৪ এর আওতায় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা উপকারভোগী ছিল।এই কর্মসূচির আওতায় বিভিন্ন বিষয়ে এক ঘন্টা ইংরেজিতে তথ্য সম্প্রচারিত হয়,যা শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী উভয়ের মাঝেই জনপ্রিয়।
ওপেন ইউনিভার্সিটি অফ জাপান প্রতি সেমিস্টারে ১৫ বার প্রতিটি ৪৫ মিনিটের লেকচার সম্প্রচার করে টেলিভিশন ও রেডিওর মাধ্যমে। কেউ বিশেষ কোন কারণে লেকচারে অংশ নিতে না পারলে একটি স্টাডি সেন্টারে তার পর্যালোচনা করতে পারেন।তাছাড়াও টেলিভিশন পাঠদান এবং রেডিও সম্প্রচার ইন্টারনেটের মাধ্যমে উন্মুক্ত করা হয়।
চীনে ৪৪ টি টিভি ও রেডিও বিশ্ববিদ্যালয় রয়েছে।ইন্দোনেশিয়ার টারবুকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং ভারতের ইন্দিরা গান্ধী ন্যাশনাল ওপেন ইউনিভার্সিটি টেলিভিশনে শিক্ষাদানের বিষয়টিকে স্বাগত জানিয়েছে। জাপান বিশ্ববিদ্যালয় টেলিভিশনের জন্য ১৬০ টি এবং রেডিওর জন্য ১৬০ টি কোর্স চালু করেছে ২০০০ সালে।
বাংলাদেশের মত দেশে টেলিভিশনে শিক্ষাদান কার্যক্রম নতুন দিগন্তের সন্ধান এনে দিতে পারে। যেখানে দেশের বিভিন্ন প্রান্তে এখনো মোবাইল নেটওয়ার্ক ঠিকঠাক পৌছুতে পারেনি সেসকল এলাকাতেও বিদ্যুতের সংযোগ রয়েছে। ফলে টেলিভিশনে শিক্ষাগ্রহণ বাধাগ্রস্ত হওয়ার কোন অবকাশ নেই। বর্তমানের মহামারী কবলিত সময়ে বাংলাদেশ সরকার টেলিভিশনে শিক্ষাদানের বিষয়টি আমলে নেয়। থমকে যাওয়া কোমলমতি স্কুলগামী শিক্ষার্থীদের পড়ালেখায় যেন ছেদ না পড়ে এই বিবেচনায় “সংসদ বাংলাদেশ টেলিভিশনে” প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জন্য বিষয়ভিত্তিক পাঠদানের কর্মসূচী “ঘরে বসে শিখি” গ্রহণ করা হয়েছিল।
বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে এ ধরণের পদক্ষেপ নতুন সম্ভাবনার দেখা দিতে পারে। প্রায় আড়াই মাস যাবৎ স্থবিরতায় ঘেরা এই সময়ে টেলিভিশনে শিক্ষাদানের বিষয়টি আশার সঞ্চয় করতে পারে শিক্ষার্থীদের মনে। টেলিভিশনে শিক্ষাদান এবং শিক্ষালাভ উভয়ই লাভজনক।এক্ষেত্রে সকল শিক্ষার্থী দেশের সর্বোত্তম শিক্ষকদের কাছে শিক্ষাগ্রহণ করতে পারবে এবং পাশাপাশি সকলের জন্য নিশ্চিত হবে প্রথম সারির একটি আসন,যা ক্লাসরুমে কোনভাবেই সম্ভব নয়।
টেলিভিশনে শোনার পাশাপাশি দেখারও সুযোগ থাকে।তাই যেকোন তথ্য সুন্দরভাবে বোঝার পাশাপাশি মস্তিষ্কে স্থায়ীও হয় বেশিক্ষণ। ইন্টারনেট ব্যবহার করে অনলাইন ক্লাসে উপস্থিত হতে নেট খরচের নামে বেশ মোটা অংক গুণতে হয় শিক্ষার্থীদের।পাশাপাশি নেটওয়ার্ক সংযোগে ত্রুটির দরুন মিস হয়ে যেতে পারে কোন দরকারি লেকচার।
অপরপক্ষে টেলিভিশনে সম্প্রচারে একবার লেকচার মিস হয়ে গেলে পুনঃপ্রচার দেখে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে পারবে শিক্ষার্থীরা,পাশাপাশি নেট খরচের নামে তাদের বেশ মোটা অংকের টাকাও গুণতে হবে না।বাংলাদেশের সামগ্রিক দিক বিবেচনায় শিক্ষার প্রচারে টেলিভিশনে শিক্ষামূলক চ্যানেলের সংখ্যা বাড়াতে হবে। শিক্ষার্থীদের করে তুলতে হবে টেলিভিশন মাধ্যমে শিক্ষামুখী।