মৃত্যুবরণ করেছেন ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির -লুইস পদ্ধতির একজন যৌথ উদ্ভাবক টনি লুইস। গত রাতে ইংল্যান্ড অ্যান্ড ওয়েলস ক্রিকেট বোর্ড (ইসিবি) তাঁর মৃত্যুর সংবাদের কথা জানিয়েছে। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৮। ১৯৯৭ সালে ডাকওয়ার্থ লুইস মেথডের সূচনা করেছিলেন ফ্র্যাঙ্ক ডাকওয়ার্থ (Frank Duckworth) ও টনি লুইস। দু’বছর পর তা গ্রহণ করেছিল আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল (ICC)।
ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির বা ডি/এল মেথড (ইংরেজি: Duckworth-Lewis method) এর প্রেক্ষাপট?
ক্রিকেট প্রেমীদের কাছে অত্যন্ত পরিচিত এবং জনপ্রিয় ক্রিকেটীয় পরিভাষা ও পদ্ধতি হচ্ছে ডি/এল ম্যাথড (ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি)। সাধারণত বৃষ্টিবিঘ্নিত কিংবা দিনের আলোকস্বল্পতাজনিত কারণে একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বা টুয়েন্টি২০ খেলায় ফলাফল আনয়ণকল্পে স্বচ্ছ এবং সঠিক পদ্ধতি হিসেবে রানকে ঘিরে পরবর্তীতে ব্যাটিং করা দলকে পুণরায় জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করা হয়। স্বাভাবিকভাবে খেলার পরিসমাপ্তি না হলে অথবা ফলাফল নির্ধারণে ব্যর্থ হলে এ পদ্ধতি অনুসরণপূর্বক প্রয়োগ করা হয়। ডি/এল মেথড বা ডার্কওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি ধারণাটির প্রবর্তক হচ্ছেন দুই ইংরেজ পরিসংখ্যানবিদ – ফ্রাঙ্ক ডাকওয়ার্থ এবং টনি লুইস।
যদিও বা ১৫ বছর পর ২০১৪ সালে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির নাম পরিবর্তন করে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন বা ডিএলএস পদ্ধতি রাখা হয়। অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক স্টিভেন স্টার্ন মূল পদ্ধতির হিসাব হালনাগাদ করায় এই পরিবর্তন আনা হয়।
ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির প্রধান উপাদান হচ্ছে রিসোর্স বা সম্পদ। প্রত্যেক দল দুইভাবে সম্পদ বৃদ্ধি করতে পারে। তন্মধ্যে যতটুকু সম্ভব রান বৃদ্ধি করার লক্ষ্যে –
একটি দলের নির্দিষ্টসংখ্যক ওভারকে যথাযথভাবে কাজে লাগানো এবং দলে কয়টি উইকেট বর্তমান রয়েছে।
ইনিংসের যে-কোন সময় দলের রান করার সক্ষমতা নির্ভর করে এ দু’টি বিষয়ের উপর। পূর্বেকার খেলাগুলো বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে যে, ওভার এবং উইকেটের সাথে একনিষ্ঠ সম্পর্কের উপর নির্ভর করে দলের মোট রান সংখ্যা নির্ধারিত হয়। এই একনিষ্ঠ সম্পর্ক বা ঐক্যসূত্রের কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে ডাকওয়ার্থ-লুইসের কার্যাবলী।
এই পদ্ধতির প্রথম ব্যবহার ঘটে ১৯৯৬-৯৭ মৌসুমে জিম্বাবুয়ে বনাম ইংল্যান্ডের মধ্যকার একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট সিরিজে। ঐ খেলায় জিম্বাবুয়ে ৭ রানে জয়ী (ডি/এল মেথড) হয়।
২০০১ সালে ক্রিকেট খেলার নিয়ন্ত্রকারী সংস্থা হিসেবে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট কাউন্সিল বা আইসিসি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করে। প্রধান মানদণ্ড হিসেবে বৃষ্টিবিঘ্নতাজনিত কারণে ও একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় ফলাফলের লক্ষ্যমাত্রা ধার্য্যকরণের হিসাব-নিকাশে এ পদ্ধতির গুরুত্বকে বিশেষভাবে বিবেচনায় আনে আইসিসি।
পূর্বে অনুসৃত ওভারের সেরা রানের পদ্ধতি প্রয়োগের ফলে ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ ক্রিকেটে দক্ষিণ আফ্রিকাকে এক পর্যায়ে ১ বলে ২১ রান করার জন্য লক্ষ্যমাত্রা দেয়া হয়। অথচ, ১ বলের মাধ্যমে সর্বোচ্চ ৬ রান তোলা যায়। বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় এ বিতর্কের অবসান ঘটেছে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি উদ্ভাবনের ফলে। নির্দিষ্ট সময়ে খেলা শেষ করার পূর্ব মুহুর্তে দক্ষিণ আফ্রিকার প্রয়োজন ছিল ১৩ বলে ২২ রানের। কিন্তু সংক্ষিপ্ত বৃষ্টি পর্বের ফলে পুণরায় তাদেরকে ২১ রান করতে বলা হয় মাত্র ১ বলে যা ছিল বিশ্বকাপের ইতিহাসে সবচেয়ে বড় বিতর্কের বিষয়। যদি ডি/এল মেথড প্রয়োগ করা হতো তাহলে ঐ খেলায় দক্ষিণ আফ্রিকাকে জয়লাভের জন্য ৫ রানের দরকার হতো।
কীভাবে প্রয়োগ করা হয় ডাকওয়ার্থ-লুইস মেথড?
স্বাভাবিকভাবে খেলা শেষ না হলে কিংবা কোনো ফল না এলে এ পদ্ধতি অনুসরণ করে ফল নির্ধারণ করা হয়।নিয়মানুযায়ী, বৃষ্টিবিঘ্নিত ক্রিকেট ম্যাচে পরে ব্যাট করা দলের লক্ষ্য কত হতে পারে তা মেথডটির ফর্মুলা দিয়ে নির্ধারণ করা হয়।
ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগের জন্য; পূর্ব থেকেই প্রস্তুতকৃত একটি টেবিল বা ছক এবং কিছু সাধারণ গাণিতিক হিসাব-নিকাশের প্রয়োজন রয়েছে। স্বল্প বৃষ্টিবিঘ্নিত খেলায় ফলাফল নির্ণয়কল্পেই এ পদ্ধতির সফলতা প্রধান বিবেচ্য বিষয় ও নির্ভরশীল।
স্বচ্ছ এবং সঠিক পদ্ধতি হিসেবে প্রথম দলের রানকে ঘিরে পরবর্তী সময় ব্যাটিং করা দলকে পুনরায় জয়ের জন্য লক্ষ্যমাত্রা প্রদান করা হয়।
এক্ষেত্রে ৫০ ওভারের একদিনের আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলায় ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতি প্রয়োগ করতে হলে প্রত্যেক দলকে কমপক্ষে ২০ ওভার বলের মুখোমুখি হতে হবে।
আধুনিক ক্রিকেটের নব সংযোজন টুয়েন্টি২০ ক্রিকেট খেলায় এ পদ্ধতি অনুসৃত হতে হলে উভয় দলকে কমপক্ষে ৫ ওভার বা ৩০ বল খেলতে হবে।
লুইসের এ পদ্ধতিটি পরে টি-টোয়েন্টি ক্রিকেটেও ব্যবহার শুরু হয়। তবে ২০১৪ সালে অস্ট্রেলিয়ার অধ্যাপক স্টিভেন স্টার্ন লুইসের এ পদ্ধতির হিসাব হালনাগাদ করে কিছুটা পরিবর্তন আনেন।এর পর থেকে এতে তার নামও জুড়ে দেয়া হয়। সেদিন থেকে ডাকওয়ার্থ-লুইস পদ্ধতির নাম পরিবর্তন করে ডাকওয়ার্থ-লুইস-স্টার্ন বা ডিএলএস পদ্ধতি রাখা হয়।
সদ্য সমাপ্ত অনূর্ধ্ব-১৯ বিশ্বকাপের ফাইনালে ভারতের বিপক্ষে বাংলাদেশের ম্যাচটা যখন দুলছিল। তখন একপশলা বৃষ্টি এসে ম্যাচের দৈর্ঘ্য কমে আসে। ডাক-ওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে রান কমে নতুন টার্গেট যা দাড়ায়, তা সহজেই পেরিয়ে বিশ্বকাপের ট্রফি উচিয়ে ধরে আকবরা।
শুধু এই ম্যাচ নয়, বিশ্ব ক্রিকেটে এমন অনেক গুরুত্বপূর্ণ ম্যাচের ফলাফল গড়ায় ডাক-ওয়ার্থ লুইস পদ্ধতিতে। যা না থাকলে হয়তো বিপদে পড়তো দল গুলো। এমন যুগান্তকারী নিয়মের প্রবর্তক যিনি, তিনি ইংলিশ গনিতবিদ টনি লুইস মহাকালের পথে পাড়ি জমিয়েছেন।করোনার কারণে নয়, বার্ধক্যজনিত কারণে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন ৭৮ বছর বয়সে। বুধবার (১ এপ্রিল) ইংলিশ ক্রিকেট বোর্ডের পক্ষ থেকে লুইসের মৃত্যুর খবর জানিয়ে তার বিদেহী আত্মার প্রতি সম্মান জানিয়েছে। লুইসের সেই পদ্ধতি আবিস্কৃত না হলে হয়তো এর সুফল ক্রিকেট বিশ্ব পেত না। তাই যত দিন রবে ক্রিকেট ততদিন রয়ে যাবে তার নাম। বিদায় লুইস। ক্রিকেট আপানার প্রতি কৃতজ্ঞ।