ডেনিস কম্পটন, যার পরিচয় একজন ক্রিকেটার, একজন ফুটবলার। ইংল্যান্ডের হয়ে তিনি যেমন রানের বন্যা বইয়ে দিয়েছেন তেমনি ফুটবলের মাঠেও তিনি দেখিয়েছেন সমান দাপট। ইংল্যান্ডের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন ডেনিস কম্পটন।

ক্রিকেটার হওয়ার শুরুর গল্প ও অভিষেক
মাত্র ১৪ বছর বয়সে লর্ডসে খেলতে নেমে এলিমেন্টারি স্কুলের হয়ে ১১৪ করেন এবং প্লাম ওয়ার্নারে নজরে পড়ে যান ডেনিস কম্পটন। পরের বছর লর্ডসে গ্রাউন্ড স্টাফ হিসেবে যোগ দেন তিনি। এই সময় ইয়ং প্রফেশনাল দের হয়ে পরপর দুই বছর দুটি ম্যাচ খেলেন ইয়ং আমেচার দলের বিরুদ্ধে। এরপর এম সি সির হয়ে ইন্ডিয়ান জিমখানা ও সিভিল সার্ভিস দলের বিরুদ্ধে দুটি ম্যাচ খেলেন ১৯৩৫ সালে। পরের বছর সাফোকের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরি করেন দ্বিতীয় ইনিংসে ১৫০ মিনিটে। এদিকে মিডলসেক্সের দ্বিতীয় দল তাঁকে ১৯৩৫ ও ১৯৩৬ সালে দুটি করে মোট চারটি মাইনর কাউন্টি ম্যাচ খেলায়। ১৯৩৬ সালেই মিডলসেক্সের হয়ে সাসেক্সের বিরুদ্ধে লর্ডসে প্রথম শ্রেণির খেলায় অভিষেক ঘটে। কোনও অজ্ঞাত কারণে তিনি এগারো নম্বরে নামেন (গাবি অ্যালোন দশ নম্বরে নামেন)। তবে সেই শুরু। এরপর ২৮ বছর ধরে তিনি প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট খেলেন। পরের বছরেই ১৯৩৭ সালে নিউজিল্যান্ডের বিরুদ্ধে ক্যারিয়ারের অভিষেক টেস্ট খেলতে নামেন তিনি।

ব্র্যাডমানের প্রশংসা
১৯৩৮ সালে ডন ব্র্যাডম্যানের সফরকারী অস্ট্রেলিয়া দলের বিপক্ষে মাত্র ১৯ বছর বয়সে ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি করেন কম্পটন। একই সিরিজে লর্ডসে অপরাজিত ৭৬ রান করে দলকে আসন্ন পরাজয়ের হাত থেকে রক্ষা করেন তিনি। এই ইনিংসটি বৃষ্টিতে আক্রান্ত পীচে করেছিলেন যার কারণে পরবর্তীতে ব্র্যাডম্যানের কাছ থেকে তিনি প্রশংসা কুড়িয়েছিলেন তিনি। ১৯৩৯ সালে প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে এক মৌসুমে ২,৪৬৮ রান করেছিলেন ডেনিস কম্পটন।
লর্ডসের অনার্স বোর্ডে নাম লেখানোর কীর্তি
১৯৩৯ সালে ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিপক্ষে লর্ডসে তিনি ১২০ রানের ইনিংস খেলে অনার্স বোর্ডে নাম লেখান। তার সমসাময়িক অন্য ক্রিকেটারদের মতো তার ক্যারিয়ারে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কালো ছায়া পড়ে। যার কারণে প্রায় অর্ধযুগ আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের বাইরে থাকতে হয়েছিল তাকে।
লম্বা বিরতির পর আবারো প্রত্যাবর্তন
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্বের পর কম্পটন ফিরলেন আরো ভয়ংকর রূপে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে অনেক প্রতিভাবান ক্রিকেটার তাদের ক্যারিয়ারের বড় একটি অংশ হারিয়ে ফেলেছিলেন। তার মধ্যে ডেনিস কম্পটনও একজন। ১৯৪৬ সালে আবারো আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মাঠে ফিরে। লর্ডসে ভারতের বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে ডেনিস কম্পটন তার ক্যারিয়ার পুনরায় শুরু করেন। প্রথম ম্যাচের স্মৃতি খুব একটা সুখকর ছিল না। প্রথম ইনিংসে প্রথম বলে আউট হয়ে সাজঘরে ফেরার পর দ্বিতীয় ইনিংসে ব্যাটিংয়ে নামার আগেই ইংল্যান্ড জিতে যায়।
নিজেকে ফিরে পেতে খুব বেশি সময় নেননি কম্পটন। পরের টেস্টেই ভারতের বিপক্ষে জোড়া অর্ধশতক হাঁকান। ১৯৪৬ সালে ভালো মন্দে কাটিয়ে দেন কম্পটন। এরপর থেকেই শুরু হয় তার ক্যারিয়ারের স্বর্ণযুগ। ১৯৪৭ সালের শুরুতেই অ্যাশেজ সিরিজ খেলতে অস্ট্রেলিয়া সফরে যায় ইংল্যান্ড। অ্যাডিলেডে সিরিজের দ্বিতীয় টেস্টে জোড়া শতক হাঁকান ডেনিস কম্পটন। অ্যাশেজের পর বছরের মাঝামাঝি সময়ে ক্রিকেটের ভরা মৌসুমে ইংল্যান্ড সফরে আসে দক্ষিণ আফ্রিকা। দক্ষিণ আফ্রিকার বোলাররা ডেনিস কম্পটনের সামনে রীতিমত অসহায় ছিল। সিরিজের প্রথম টেস্টে নটিংহ্যামে ৬৫ ও ১৬৩ রানের ইনিংস খেলার পর লর্ডসে পরের টেস্টে ক্যারিয়ারের প্রথম দ্বিশতক তুলে নিয়ে ২০৮ রানের ইনিংস খেলেন।

এখানেই থেমে থাকেননি তিনি। টানা তৃতীয় ইনিংসে শতক তুলে নেন ম্যানচেস্টারে ১১৫ রানের ইনিংস খেলার মধ্য দিয়ে। সিরিজের শেষ টেস্টে ‘দ্য ওভালে’ ৫৩ এবং ১১৩ রানের ইনিংস খেলে সিরিজ শেষ করেন তিনি। পুরো মৌসুম জুড়েই তিনি বোলারদেরকে ব্যাট হাতে শাসন করে গেছেন। ১৯৪৭ সালে তিনি ৩,৮১৬ রান করেছিলেন। যা এখন পর্যন্ত প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে এক পঞ্জিকাবর্ষে সর্বোচ্চ ব্যক্তিগত সংগ্রহ। এই রান সংগ্রহ করতে তিনি ১৮টি শতক হাঁকিয়েছিলেন। এটাও বিশ্বরেকর্ড। স্যার জ্যাক হবসের ১৬টি শতকের রেকর্ড ভেঙ্গে এই রেকর্ড গড়েন তিনি।
আগের মৌসুমে রেকর্ডের খাতাকে নতুনভাবে লেখানোর পর পরের মৌসুমও শুরু করেন আগের মতো করেই। ১৯৪৮ সালে নটিংহ্যাম টেস্টে ডন ব্রাডম্যানের অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার বিপক্ষে একাই লড়ে যান ডেনিস কম্পটন। কিথ মিলারের বলে ভারসাম্য হারিয়ে ‘হিট উইকেটে’ আউট হওয়ার আগে করেন ১৮৪ রান। তার অনবদ্য ইনিংসের কল্যাণে ইনিংস হার এড়াতে সক্ষম হয়েছিল ইংল্যান্ড। কিন্তু অপরাজেয় অস্ট্রেলিয়ার কাছে ঠিকই বড় ব্যবধানে হারতে হয়েছিল ইংল্যান্ডের।
ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস

ডেনিস কম্পটন তার ক্যারিয়ার সেরা ইনিংস খেলেন পহেলা জুলাই, ১৯৫৪ সালে। নটিংহ্যামে পাকিস্তানের বিপক্ষে তিনি মাত্র ২৮৭ মিনিট ক্রিজে থেকে ৩৪টি চার এবং ১টি ছয়ের মারে ২৭৮ রান করেন। দিনের দ্বিতীয় সেশনে তিনি ১৭৩ রান যোগ করেছিলেন, যা এখন পর্যন্ত টেস্ট ম্যাচের দ্বিতীয় সেশনে সর্বাধিক ব্যক্তিগত সংগ্রহ।
ক্রিকেট থেকে বিদায়ের ঘোষণা
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে ডেনিস কম্পটন তার বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ারের ইতি টানেন ১৯৫৭ সালে। মার্চের ১ তারিখে পোর্ট এলিজাবেথে দক্ষিণ আফ্রিকার বিপক্ষে ম্যাচ দিয়ে তিনি আন্তর্জাতিক ক্রিকেটকে বিদায় জানান।
ক্রিকেট ক্যারিয়ার
ডেনিস কম্পটন ক্যারিয়ারে ৭৮ টি টেস্টে ৫০.০৬ গড়ে ১৭ টি শতক সহ করেন ৫৮০৭ রান। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে ১২৩ টি শতরান সহ প্রায় ৫২ গড়ে ৩৮৯৪২ রান করেন। সর্বোচ্চ ৩০০(১৮১ মিনিটে , দ্রুততম ত্রিশতরান ,শেষটা ৩৭ মিনিটে)। কম্পটন ভারতের রঞ্জি খেলেছেন হোলকারের হয়ে। হোলকারের ব্যক্তিগত সর্বোচ্চ রান (২৪৬) তারই করা। ১৯৪৫ সালের ২৫শে জানুয়ারি ইডেনে আর্মির হয়ে মাত্র ১ ঘন্টায় শতরান করেন তিনি। প্রথম শ্রেণির ক্রিকেট ইতিহাসে ১০০ টা সেঞ্চচুরি করা ২৫ জন ব্যাটসম্যানদের মধ্যে তিনি একজন। বোলিংয়েও ছিলেন সমান পারদর্শী প্রথম শ্রেণির খেলায় পেয়েছেন ৬২২ টি উইকেট।
ডেনিস কম্পটনের ফুটবল ক্যারিয়ার

ক্রিকেটের পাশাপাশি ডেনিস কম্পটন প্রফেশনাল ফুটবলারও ছিলেন। ১৯৩২ সালে মাত্র ১৪ বছর বয়সে আর্সেনালের জুনিয়র ক্লাবে যোগদান করেন। ১৯৩৬ সালে ইংলিশ ক্লাব আর্সেনালের হয়ে ক্লাব পর্যায়ে খেলেন কম্পটন। আর্সেনালের হয়ে ৫৪ ম্যাচ খেলে করেছেন ১৫ টি গোল। রাইট উইঙ্গার হিসেবে ছিলেন সুপরিচিত। আর্সেনালের হয়ে ১৯৪৮ সালে লীগ শিরোপা এবং ১৯৫০ সালে এফএ কাপ জিতেন তিনি। ইংল্যান্ডের ফুটবল দলের হয়ে বিশ্বযুদ্ধ মধ্যবর্তী সময়ে ১২ টা ম্যাচ খেলেছিলেন তিনি । ইসলিংডন করিন্থিয়ান দলের হয়ে ভারত সফরও করেন তিনি। হোলকারের হয়ে ক্রিকেট আর ইসলিংডন করিন্থিয়ানের হয়ে ফুটবল, কলকাতা তার ফুটবল ক্রিকেট দুইই দেখেছে।
মৃত্যু
ইংল্যান্ডের হয়ে ৭৮টি টেস্ট ম্যাচ খেলা ডেনিস কম্পটন এই পৃথিবীতে ছিলেন ৭৮ বছর। ১৯৯৭ সালের ২৩ এপ্রিলে তিনি মৃত্যুবরণ করেন।

পুরস্কার ও সম্মাননা
- ১৯৩৯ সালে উইজডেন কর্তৃক অন্যতম বর্ষসেরা ক্রিকেটার মনোনীত হন। পরবর্তীতে ২০১৩ সালে তার নাতি নিক কম্পটনও এই পুরস্কারের অধিকারী হন।
- ২০০৯ সালে রিচি বেনো, গ্রাহাম গুচ, ফ্রাঙ্ক ওলি, হ্যারল্ড লারউডের সাথে তাকেও আইসিসি ক্রিকেট হল অব ফেমে মরণোত্তর অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
- হার্টফোর্ডশায়ারের শেনলি ক্রিকেট সেন্টারে অবস্থিত প্রধান ক্রিকেট মাঠটি ১৯৯৩ সালে উদ্বোধন করেন ও তার সম্মানে প্রধান মাঠটি ডেনিস কম্পটন ওভাল নামে পরিচিতি পায়। এছাড়াও, লর্ড’স ক্রিকেট গ্রাউন্ডের একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়।
- ডেনিস কম্পটনের নামে “ডেনিস কম্পটন ওভাল”
- ২০০৫ সালে ইসিবি ও ক্রিকেট অস্ট্রেলিয়া কর্তৃপক্ষ যৌথভাবে অ্যাশেজ সিরিজের জন্য নির্ধারিত সিরিজের সেরা খেলোয়াড়ের পরিবর্তে কম্পটন-মিলার পদক নির্ধারণ করে। বিখ্যাত সাবেক অস্ট্রেলীয় অল-রাউন্ডার কিথ মিলারের সাথে তার বন্ধুত্ব এবং প্রতিপক্ষের ভূমিকাকে মর্যাদা দিতেই এ নামকরণ করা হয়েছে।
আরো পড়তে পারেন