“এই বাকরখানি রুটি লাগবো নাকি, সুস্বাদু বাকরখানি রুটি, মজাদার রুটি, রুটি, রুটি এই বাকরখানি রুটি” এটি আমাদের শৈশব কৈশোরের অনেক চেনা হাকডাক। সেসময়ে দেখতাম চারদিকে স্বচ্ছ কাচ দিয়ে ঘেরা চতুর্ভূজ আকৃতির দুটি বাক্স যাতে থাকতো বাকরখানি রুটি তা নিয়ে ঘুরে বেড়াতো ফেরিওয়ালারা। বাক্স দুটি ফালি করা বাঁশের দণ্ডের দুই মাথায় ঝুলিয়ে উচ্চ স্বরে হাকডাক ছাড়তে ছাড়তে ফেরিওয়ালারা বিভিন্ন মহল্লায় ঘুরে বেড়াত। বাকরখানির পাশাপাশি বাক্সে আরো থাকতো শুকনো মিষ্টি যা বাকরখানি সহযোগে খাওয়া হতো। নোনতা ও মিষ্টি এ দুধরনের বাকরখানি মিলতো সেসময় ফেরিওয়ালাদের কাছে। তাদের খদ্দের ছিলো পাড়ার শিশু – কিশোর সহ সকল শ্রেণী পেশার মানুষ। আমরা ছোটরা ২টি বাকরখানি ও একটি শুকনো মিষ্টি দেড়/দুই টাকায় কিনতে পারতাম। আমার শৈশবের একটা দীর্ঘ সময় কেটেছে ঢাকার মগবাজারে। তখন তাদের আমাদের মহল্লায় দেখতাম প্রায়শইঃ। সেটা ১৯৮৩-৮৪ সালের কথা।
ইতোমধ্যে পঞ্জিকার পাতা উল্টেছে অনেকবার। পরিবর্তন এসেছে আমাদের খাদ্যাভ্যাসে। ফাষ্টফুড আর নানা নিত্য নতুন খাবারের আবির্ভাবে ঢাকার ঐতিহ্যবাহী শিরমাল রুটি, বাকরখানি আর চাপাতি সহ অন্যান্য রকমের খাবার প্রায় বিলুপ্তির পথে। তারপরও এখনও বাকরখানি টিকে আছে প্রায় নিবু নিবু হয়ে।পুরনো ঢাকাসহ খিলগাঁও, সিপাহীবাগ, অন্যান্য এলাকায় এখনও বাকরখানির সন্ধান মিলে। আমি সম্প্রতি নদীর ওপারে জিঞ্জিরা এলাকাতে গিয়েও বাকরখানি রুটির তন্দুরসমেত দোকান দেখেছি। বাকরখানি রুটির রয়েছে এক সমৃদ্ধ ও রোমাঞ্চকর অতীত। ঢাকায় এর বিকাশ ঘটে মুঘল আমলে। ইংরেজ আমলে পায় পূর্ণতা আর পাকিস্তান আমলেও এর জৌলুস ছিল। বাংলাদেশ আমলের প্রথম ভাগে ঠাট -বাট বজায় থাকলেও পরবর্তীতে এটি ক্রমশঃ ম্রীয়মান হতে থাকে। বর্তমানে প্রায় তলানিতে এসে ঠেকেছে।
এবার আসি এর ইতিহাস কথনে। এ বিষয়ে জানা যায় কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থের লেখক নাজির হোসেনের লেখনীতে। তিনি লিখেছেন বাকরখানি রুটির সাথে যার নাম ওতপ্রোত ভাবে জড়িত তিনি হলেন আগা বাকের ও আরামবাগের নর্তকী খনি বেগম। আগা বাকের ছিলেন তুর্কিস্তানের মতান্তরে ইরানের অধিবাসী। তিনি শিয়া মুসলিম ছিলেন। ভাগ্যন্বেষণে তিনি ভারতবর্ষে আগমন করেন এবং মুর্শিদকুলী খার বিশেষ স্নেহ ও আশ্রয় লাভ করেন এবং নিজ দক্ষতায় তার সেনাবাহিনীর উচ্চপদে আসীন হন। তিনি চট্টগ্রামের ফৌজদার নিযুক্ত হয়েছিলেন। তার ছেলের নাম আগা সাদেক যার নামে পুরনো ঢাকাতে একটি সড়কের নামও রয়েছে। আর খনি বেগম সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায়না । যতটুকু জানা যায় তা হলো – তিনি আরামবাগের নর্তকী ছিলেন। এই খনি বেগমকে নিয়ে অনেক জলঘোলা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ হয়েছে তদসাথে প্রাণহানিও । যাহোক, আগা বাকের ও খনি বেগম একে অপরকে গভীরভাবে ভালোবাসতেন । বাকেরের এই প্রেমের সম্পর্কে প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন উজিরেআলা জাহান্দর খার দুশ্চরিত্র পুত্র কোতোয়াল জয়নুল খা। এসব ব্যাপারে মুর্শিদকুলী খা কিছু জানতেন না। একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে খনি বেগমের সতীত্ব নষ্ট করতে চেষ্টা করেন কোতোয়াল জয়নুল খা। সংবাদ পেয়ে আগা বাকের বাঁধা দিলেন ফলতঃ উভয়ের মাঝে যুদ্ধ বেঁধে যায়। যুদ্ধে হেরে জয়নুল খা পালিয়ে যান। জয়নুলের বন্ধুগন এটাকে অন্যরূপ দিয়ে গুজব ছড়িয়ে দিল যে বাকের জয়নুলকে হত্যা করে মৃতদেহ গুম করে দিয়েছে। এ অভিযোগ নবাবের দরবারে গেলে ন্যয়পরায়ণ মুর্শিদকুলী খা পূত্রবৎ বাকেরকে মৃত্যুদণ্ড দিয়ে বাঘের খাঁচায় ঢুকিয়ে দেন । দমবার পাত্র ছিলেন না বাকের। বাঘের সঙ্গে লড়াই করে বাঘটিকে হত্যা করে বিজয়ীর বেশে খাচা হতে বেরিয়ে আসেন। এদিকে জয়নুল সুযোগ বুঝে জোরপূর্বক খনি বেগমকে অপহরণ করে দক্ষিন পূর্ব বঙ্গের ভাটি অঞ্চলের এক গভীর অরণ্যে পালিয়ে যান। জয়নুল শত চেষ্টা করেও খনি বেগমকে বশে আনতে না পেরে তাকে চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে (বাকেরগঞ্জ/বরিশাল) বন্দী করে রাখেন। এ খবর আগা বাকেরের কানে পৌঁছালে তিনি সেনাপতি কালা গাজীকে নিয়ে ছুটে যান চন্দ্রদ্বীপ রাজ্যে। জয়নুলের পিতাও তার চরিত্রহীন ছেলের কার্যকলাপে অতিষ্ট হয়ে ছেলেকে শিক্ষা দেয়ার জন্য তথায় হাজির হলেন এবং পুত্রকে বন্দী করে শাস্তিস্বরূপ নিজ তরবারি দিয়ে আঘাত করলেন। অসির আঘাতে মরণাপন্ন জয়নুল দেখল যে সে আর বাঁচবে না; এবং খনিকেও পাবে না; তাই সুযোগ বুঝে সে খনি বেগমের বুকে অসি বসিয়ে দিল প্রতিশোধস্বরূপ। এ আঘাতে খনি বেগম যখন মৃত্যু পথযাত্রী তথায় হাজির হন আগের বাকের। মৃত্যমুখী খনি বেগমকে বুকে তুলে নিয়ে অঝোর ধারায় কাদতে থাকেন বাকের। এক পর্যায়ে খনি বেগম মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়েন। খনির মৃত্যুতে প্রায় উন্মাদ হয়ে যান বাকের । রাজ্য ও মসনদের সকল আকর্ষন পরিত্যাগ করে সেই অঞ্চলেই থেকে যান তিনি। শুরু হয় তার জীবনের নতুন অধ্যায়। পরবর্তীতে বুজুর্গ উমেদপুরের জমিদারি লাভ করার পর সেলিমাবাদ ও চন্দ্রদ্বীপ পরগনা দখল করে নেন। বহু দ্বীপ নিয়ে গঠিত বাখলা চন্দ্রদ্বীপের জমিদারি লাভ করেন আগা বাকের। পরবর্তীতে ১৭৯৭ সালে ইংরেজ সরকার যখন পৃথক জেলা গঠন করেন তখন এই জনপ্রিয় ব্যাক্তির নামটিকে অস্বীকার না করে তার নামেই নামকরণ করা হয় বাকেরগঞ্জ জেলা। এরপর মুর্শিদ কুলী খার আদেশে আগা বাকের এক সম্ভ্রান্ত পরিবারে বিয়ে করেন। সে ঘরে জন্ম লাভ করে আগা সাদেক ও মির্জা মাহদী নামে দুই পুত্র।
আগা বাকের নবাব সিরাজউদ্দোলার দুর্দিনে তার পাশেই ছিলেন। নবাব বিরোধী শিবির রাজবল্লভ ও ঘসেটি বেগমের বিরুদ্ধেও তিনি ভীষণ সরব ছিলেন। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনকভাবে ঢাকার নায়েব নাজিম হোসেন উদ্দিন খানের হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে আগা বাকের নিহত হন। রাজবল্লভ তার দেহ টুকরো টুকরো করে ফেলেন। বাকেরের এই খণ্ডিত দেহ পরে আগা সাদেক ময়দানে সমাহিত করা হয়
আগা বাকের অন্য নারীকে বিয়ে করলেও তার মন থেকে খনি বেগমের স্মৃতি মুছে যায়নি। তার প্রমাণ – বিশেষভাবে তৈরি তার প্রিয় খাদ্য তথা রুটির নাম তার প্রেম কাহিনীর উপর ভিত্তি করেই নামকরণ করা হয়েছিল ” বাকর – খনি ” রুটি যা কিছুটা অপভ্রংশ হয়ে হয়েছে বাকরখানি রুটি। এটি টিকে আছে শতাব্দীর পর শতাব্দী ধরে। পুরনো ঢাকার আদি খাবারগুলোর মধ্যে এটি একটি অন্যতম খাবার। বাকরখানি পুরান ঢাকাবাসীর সকালের নাস্তা হিসেবে প্রচলিত ছিল আদিতে। আনিস আহমেদ তার ঢাকাইয়া আসলি গ্রন্থে লিখেছেন – বাকরখানি মূলতঃ মুঘল আমলের খাবার। শুরুতে দুরকম বাকরখানি প্রচলিত ছিল যথা – গোলা বাকরখানি ও গাওজোবান বাকরখানি। গাওজোবান ফার্সী শব্দ। গাও অৰ্থ গরু এবং জোবান অর্থ জিহ্বা। গরুর জিহ্বা আকৃতির বাকরখানিই গাওজোবান বাকরখানি। তিনি আরো জানাচ্ছেন – লোকে ভোরবেলা বাড়ি থেকে খাটি ঘি, ময়দা ও পানির নিয়ে বাকরখানি রুটির দোকানে গিয়ে দাড়িয়ে থেকে চাহিদা মতো বাকরখানি তৈরি করে নিয়ে আসতো। বাকরখানি খাওয়া হতো কোরমা, কোফতা, গরুর শিক কাবাব, দুধ, তেককা বা মিষ্টি সহযোগে । আর বর্তমানে এ খাবারের অনুষঙ্গ হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে চা আর দুধ।
বাকরখানি মূলতঃ আদি ঢাকা তথা পুরনো ঢাকাবাসীর একটি ঐতিহ্যবাহী খাবার। পরবর্তীতে এটি বিভিন্ন এলাকায় ছড়িয়েছে। সকাল ও বিকেলের নাস্তায় এটি একসময় পুরনো ঢাকাবাসীর কাছে তুমুল জনপ্রিয় ছিল। এখনও পুরান ঢাকার বিভিন্ন এলাকায় বাকরখানি রুটির পুরনো দোকান ও তন্দুর সগৌরবে টিকে আছে।
এবার আসি বাকরখানি তৈরির পদ্ধতিতে । হাকিম হাবিবুর রহমান তার ‘ ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে’ গ্রন্থে এ বিষয়ে বিস্তারিত বর্ণনা করেছেন। তিনি লিখেছেন ” এটি ময়দা থেকে প্রস্তুত হয়; এবং মাওয়া মিলিয়ে আটা এভাবে ছানা হয় যে পৌষের শীতের রাতেও ছানা লিপ্ত ব্যাক্তি ঘামে জবজব হয়ে যায়। প্রকৃতপক্ষে উত্তম ময়দা, এবং কঠিনভাবে ছানার উপরই এর সৌন্দর্য নির্ভরশীল। ………….এই পেশায় নিয়োজিত শিষ্যরা ওজন করে লই বানিয়ে রুটি প্রস্তুতকারীর কাছ পর্যন্ত পৌঁছে দেয়।রুটি প্রস্তুতকারী খুবই দ্রুত পিঁড়ির উপরে বেলুনের সাহায্য ছাড়াই লই কিছুটা বড় করে ( হাতের চাপের সাহায্যে) অতঃপর ঘি লাগিয়ে ময়দা যাকে বুরা বলে , সহযোগে ভাঁজ করতে থাকে কিন্ত প্রত্যেক ভাজে এই ঘি ময়দার প্রয়োগ অব্যাহত থাকে। অতঃপর লই বানিয়ে পৃথক ভাবে রাখা হয়। যখন ১০০ বা ৫০ টা লই তৈরি হয়ে যায় তখন অপর ব্যাক্তি অথবা ঐ ব্যাক্তি পিঁড়ির উপর পছন্দসই পরিমাণের রুটি তৈরি করে এবং ঐ রুটির উপর পরিষ্কারকৃত তিল ছিটাতে থাকে এবং তৃতীয় ব্যাক্তি উক্ত রুটি তন্দুরে স্থাপন করে অতঃপর কমপক্ষে দইুবার দুধের ছিটা দেয়।” আর এভাবেই বাকরখানি তৈরি হয়।
বর্তমানে বাকরখানি তৈরিতে এসেছে স্বল্প প্রক্রিয়া। এর মূল কারন উপাদানে পরিবর্তন। আমি এর কারিগরদের সাথে কথা বলে জানতে পেরেছি বর্তমানে বাকরখানিতে ঘি, পনির, মাওয়া এবং দুধের ব্যবহার উঠে গেছে। তার জায়গায় এসেছে সুপার অয়েল, ময়দা, চিনি, লবণ ও পানি – এই পাঁচ উপকরণেই এখনকার বাকরখানি তৈরি হয়। বর্তমানে প্রথমে ময়দা, পানি, লবণ, তৈল ও চিনি সহযোগে খামির তৈরি করা হয়। অতঃপর তা ২/৩ ঘণ্টার জন্য ফেলে রাখা হয় মজবার বা মিশ্রিত হবার জন্য। তারপর খামির থেকে তৈরি হয় বুরা যা বেলুন দিয়ে বেলে পাতলা রুটির আকৃতি দেওয়া হয়। এরপর ময়দা ও সুপার অয়েল ছিটিয়ে দেওয়া হয় বুরার উপর। পরবর্তী ধাপে বুরাকে গুটিয়ে/মিশিয়ে ফেলে পুনরায় লই বানানো হয়। সেই লই থেকে আবার ছোট ছোট গোল্লা বা গুটি তৈরি করা হয় হাতের তালুর চাপে। পরে সেই গুটি বেলুনে পিষে নিয়ে ছোট রুটির সাইজের আকার দিয়ে তাতে তিনটি কাটা দাগ দেওয়া হয় ছুরির সাহায্যে। তারপর দেয়া হয় তন্দুরে। তাতে রাখা হয় ৭/৮ মিনিট। আর এভাবেই তৈরি হয় হালের বাকরখানি বা নিমসূূখা রুটি।
বর্তমানে বাকরখানি রুটিকে সুখা বা নিমসুখা রুটি বলা হয়। নোনতা ও মিষ্টি ( চিনির) এ দু-স্বাদের বাকরখানি পাওয়া যায় কেজি প্রতি দাম পড়বে ১২০- ১৫০ টাকা। পুরান ঢাকার পাশাপাশি খিলগাঁও, সিপাহীবাগসহ নতুন ঢাকার অন্যান্য এলাকায় কিছুসংখ্যক বাকরখানির দোকান চোখে পড়ে। ক্রেতা কম হলেও এটি যে এখনও টিকে আছে সেটাই আশার কথা । বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক সম্পাদিত ঢাকাই খাবার গ্রন্থ থেকে জানা যায় – আগা বাকেরের আগেও কাশ্মিরীরা ঢাকায় এধরনের রুটির প্রচলন করেছিল। তারা বাকরখানি তৈরিতে পারদর্শী ছিল। পাঞ্জাবের অমৃতসর থেকে কাশ্মিরীরা ঢাকায় বাকরখানি প্রচলন করে। ঢাকার ঐতিহ্যবাহী বাকরখানি আগ্রার মুঘল দরবারে ও লক্ষ্যৌতে সমাদৃত হয়েছিল। নবাবী আমলে মুর্শিদাবাদে ঢাকার বাকরখানি ছড়িয়ে পড়েছিল। প্রকৃতপক্ষে বাকরখানি রুটি এসময় সমগ্র ভারতবর্ষে এতোটাই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, ঢাকা বলতেই অনেকের চোখের সামনে বাকরখানি ভেসে উঠতো। মুঘল ও মুঘল পরবর্তী সময়ে বাকরখানি ঢাকা থেকে বাংলার বিভিন্ন স্থানে উপঢৌকন হিসেবে পাঠানো হতো।
ঢাকায় কয়েকপ্রকার বাকরখানির প্রচলন ছিল। এর মধ্যে খাছগি বাকরখানি এবং বছমি বাকরখানি ছিল উন্নতমানের । মুঘল আমলের বাকরখানিতে ঘি ও দুধের ব্যবহার ছিল। মুঘলরা আসার পর ঢাকায় ঘিয়ের ব্যবহার বেড়ে যায়। ঢাকায় পনির দিয়েও একপ্রকার বাকরখানি তৈরি করা হতো। এ রুটি পনির রুটি নামেও পরিচিত ছিল। এর যোগান আসতো ময়মনসিংহ অঞ্চল থেকে। জাহাজী ও দূরের যাত্রীদের মাঝে বাকরখানির ব্যবহার ছিল। কারণ বৈয়মে বাকরখানি মাসাধিককাল টাটকা রাখা যেত। সংরক্ষণের জন্য ঢাকার বাকরখানিতে কাপড় ব্যাবহারের কথাও জানা যায়। আবার সুজির মোহনভোগ দিয়ে একপ্রকার বাকরখানি তৈরি হতো। নবাবী আমলে এ বাকরখানি ছিল ঢাকার মজাদার রুটি।
বাকরখানি রুটির কথা এসেছে নানাজনের স্মৃতিকথায়। তাদেরই একজন কবি শামসুর রহমান। তিনি তার ‘স্মৃতির শহর’ গ্রন্থে লিখেছেন – “বাকরখানি রুটির একটি দোকান ছিল সাত রওজার কাছে । চমৎকার রুটি বানানো হতো সেই দোকানটায় । মাঝে মাঝে সকাল বেলায় হাজির হতাম সেখানে রুটি কেনার জন্য। এক পয়সায় একটি রুটি হতে দিলেই দে ছুট। বাসায় গিয়ে পেট পুরে খাও। আহ! কি মজাই না লাগতো বাকরখানি রুটি খেতে । মাঝে মাঝে আব্বা ফরমায়েশ দিয়ে পনিরী রুটি বানাতেন আমাদের জন্য। বাকরখানির গা জুড়ে বসানো থাকতো পনিরের কুচি। মনে হতো বাদামী আকাশ ভরা তারা। দেখেই চোখ জুড়ায়। দেখার সুখ ফুরোয়না কিছুতেই।”
সৈয়দ আলী আহসান তার ‘ষাট বছর আগে ঢাকা গ্রন্থে ‘ লিখেছেন – ” পনিরের টুকরো বসানো বাকরখানি রুটি বাজারে পাওয়া যেত। রুটি বেলার পর তন্দুরে দেবার আগে রুটিতে পনিরের টুকরো বসিয়ে দেয়া হতো।”
লেখার শেষভাগে বলতে চাই যদিও মূল বাকরখানি রুটির অস্তিত্ব আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে তবুও নিমসুখা রুটি হিসেবে এটি যে টিকে আছে তাই – ই আমাদের কাছে সান্তনা ও ভালো লাগা। প্রকৃতপক্ষে যারা এ পেশায় জড়িত তাদের বেশিরভাগই অপরিচ্ছন্ন পরিবেশে এ রুটি বানান বলে এর খদ্দেরের সংখ্যা কমতির দিকে। ভালো মানের বাকরখানি উন্নত পরিবেশে তৈরি হলে; এটি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে বলে আমার বিশ্বাস।
তথ্যসূত্রঃ:
১) কিংবদন্তির ঢাকা, নাজির হোসেন, জাতীয় গ্রন্থ কেন্দ্র, ঢাকা, ১৯৯৫ ইং, পৃষ্ঠা – ২৮৯।
২) ঢাকা পঞ্চাশ বছর আগে, হাকিম হাবিবুর রহমান, অনুবাদ – ড. মোহাম্মদ রেজাউল করীম, প্যাপিরাস, ঢাকা , ২০০৫ ইং, পৃষ্ঠা – ৪৬।
৩) ঢাকাই খাবার, সম্পাদনা – বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, প্রবন্ধ – মুঘল আমলে ঢাকাই খাবার, প্রবন্ধকার – কে. এম. মোহসীন, ও দেলওয়ার হাসান, ঢাকা, ২০১০ ইং, পৃষ্ঠা – ৮০।
৪) স্মৃতির শহর, কবি শামসুর রহমান, জাতীয় গ্রন্থ প্রকাশন, ঢাকা, ২০০০ ইং, পৃষ্ঠা – ৫০।
৫) ষাট বছর আগে ঢাকা, সৈয়দ আলী আহসান, বাতায়ন প্রকাশন ( ২ য় সংস্করণ), ঢাকা, ২০১৫ ইং, পৃষ্ঠা ৪৫।
৬) ঢাকাইয়া আসলি, আনিস আহমেদ,বাংলা একাডেমী, ঢাকা, ২০১৬ ইং, পৃষ্ঠা – ১৮৮।
৭) ব্যাক্তিগত সাক্ষাত্কার, ঢাকার সিপাহীবাগ ও জিঞ্জিরা এলাকার বাকরখানি রুটির কারিগরদের সাথে।