প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাসে স্থবির পুরো বিশ্ব। বৈশ্বিক এই মহামারী হানা দিয়েছে মানুষের স্বাভাবিক জীবনে। জীবনযাত্রায় এসেছে অভূতপূর্ব পরিবর্তন। স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়, হাট-বাজার, দোকান-পাট সবখানেই আজ বিরাজ করছে শুধু নীরবতা, নেই কারো পদচিহ্ন।
সারা বিশ্ব যখন করোনা ভাইরাসের ভয়াবহতায় নিমজ্জিত, এমনই এক সময়ে সকলের সামনে এলো এক চাঞ্চল্যকর শিক্ষার্থী হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। গত পহেলা মে, জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিন্যান্স এন্ড ব্যাংকিং বিভাগের ২০১৫-১৬ শিক্ষাবর্ষের (১০ম ব্যাচ) শিক্ষার্থী তৌহিদুল ইসলাম (২৪) ময়মনসিংহ শহরের একটি মেসের নিজ কক্ষে ভোররাত আনুমানিক ৩.০০ ঘটিকায় ময়মনসিংহের তিনকোণা পুকুরপাড় এলাকায় সন্ত্রাসী কর্তৃক আঘাত প্রাপ্ত হয়ে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন।
সেহরির খাবারটি টেবিলেই সাজানো ছিল। কিন্তু সময় পেরিয়ে গেলেও ঘাতকের বর্বরতায় সেই খাবার খাওয়ার সুযোগ হয়নি তৌহিদের! কি নির্মম, নিষ্ঠুর, বর্বর এই জঘন্য সন্ত্রসীরা।
ময়মনসিংহের ত্রিশাল উপজেলায় বিশ্ববিদ্যালয় হলেও প্রায় বাইশ কিলোমিটার দূরে ময়মনসিংহ শহরের একটি মেসে ভাড়া থাকতেন তৌহিদ। তার মতো সহস্রাধিক শিক্ষার্থীও ক্লাস শেষে ফিরতেন ময়মনসিংহে। সহপাঠীরা জানায়, “নিজের ফেসবুক আইডি ডিএক্টিভেট করে পুরোদমে বিসিএস এর প্রস্তুতি নিচ্ছিলো সে।”
এরই মধ্যে তৌহিদুল ইসলামকে হত্যার প্রতিবাদে ও অপরাধী দ্রুত শনাক্ত করে আইনের আওতায় এনে বিচারের দাবিতে পৃথক পৃথক জায়গায় মানববন্ধন করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা। করোনা পরিস্থিতিতে যারা ক্যাম্পাসে অনুপস্থিত, তারাও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সক্রিয় ছিলেন, ছিলেন প্রতিবাদমুখর।
এছাড়া মানববন্ধনে মুঠোফোনের মাধ্যমে একাত্মতা জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য এ এইচ এম মোস্তাফিজুর রহমান। সেইসাথে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের পক্ষ থেকে ময়মনসিংহ জেলা ও বিভাগীয় প্রশাসনের সর্বোচ্চ ব্যক্তিদের সাথে যোগাযোগ করে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীর সর্বোচ্চ শাস্তি নিশ্চিতের ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বলা হয়।

প্রশাসনের তৎপরতায় রবিবার (৩ মে) সার্কেল এস পি আল আমিনের নেতৃত্বে তৌহিদ হত্যার সাথে জড়িত প্রধান আসামী আতিকুজ্জামান আশিককে (২৭) গ্রেপ্তার করা হয় এবং পরদিন সোমবার (৪ মে) বিকাল সাড়ে ৩টায় পুলিশ সুপার কার্যালয়ের মিডিয়া সেন্টারে সংবাদ সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়।
সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত শেষে খুনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে জেলা পুলিশ সুপার মোঃ আহমার উজ্জামান বলেন, “খুনি আশিক মৃত সোহেল মিয়ার ছেলে। সে পেশাদার চোর ও মাদক সেবী। ঘটনার দুই দিন আগে তৌহিদের সাথে বাড়ির সামনে সিগারেট খাওয়া নিয়ে আশিকের বাকবিতণ্ডা হয়। এরপর থেকেই তৌহিদের মোবাইল চুরি করার চেষ্টা করে আশিক। ঘটনার দিন শুক্রবার (১ মে) আনুমানিক রাত ৩ টার পর বাসার ছাদ দিয়ে মোবাইল চুরি করতে আসলে তৌহিদ আসামী আশিককে ধরে ফেলে। এক পর্যায়ে উভয়ের মধ্যে ধস্তাধস্তি হলে পাশে থাকা রড দিয়ে তৌহিদকে আঘাত করে পালিয়ে যায় আশিক। এরপর মেস মালিক এসে তৌহিদকে ময়মনসিংহ মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে মৃত ঘোষণা করেন।”

প্রাথমিকভাবে সংঘটিত ঘটনাটি চুরি সম্পর্কিত হওয়ায় পুলিশ এবং ডিবি যৌথ অভিযানের ভিত্তিতে তথ্য প্রযুক্তি ব্যবহার করে মূল আসামী আতিকুজ্জামান আশিককে (২৭) ঘটনার দুদিন পর রবিবার (৩ মে) বিকেলে শহরের আকুয়া বোর্ডঘর এলাকা থেকে গ্রেফতার করে এবং তার বয়ান মতে হত্যাকাণ্ডের সময় পরিহিত রক্তমাখা প্যান্ট ও টিশার্ট গাজীপুরের শ্রীপুর এমসি বাজার থেকে এবং হত্যায় ব্যবহৃত রডটি ওই মেসের পাশের পুকুর থেকে উদ্ধার করে পুলিশ।

এ বিষয়ে প্রক্টর ড. উজ্জ্বল কুমার প্রধান বলেন, “পুলিশ প্রশাসনের চেষ্টা এবং পরিশ্রমের ফলে দ্রুততম সময়ে আমাদের সন্তানকে যে হত্যা করেছিল তাকে গ্রেফতার করা গেছে। খুনীকে গ্রেফতারের বিষয়ে পুলিশ প্রশাসন এর সাথে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রেখেছেন বিশ্ববিদ্যালয়য়ের উপাচার্য স্যার। এখন দ্রুত শাস্তি নিশ্চিত করার জন্যে কাজ করতে হবে।”
এদিকে গ্রেপ্তারের পর পুলিশের দেয়া বক্তব্যকে ঘিরে দেখা দিয়েছে মিশ্র প্রতিক্রিয়া। নিহত তৌহিদ এর মামা ফারুখ আহমেদ বলেন, “আমরা এই তদন্তে সম্পূর্ণভাবে সন্তুষ্ট নই। একা এ কাজ সম্ভব নয়। আরও কেউ যুক্ত আছে। আমি আরও ভালো করে তদন্তের দাবি জানাই। সেই সাথে পুলিশ সংবাদ সম্মেলনে রড দিয়ে আঘাত এর কথা বললেও তৌহিদ এই কথা বলে যায়নি।”
তার কথা অনুযায়ী পুলিশের দেয়া বক্তব্য এবং তৌহিদের কথার সাথে অনেকটা অমিল রয়েছে। এদিকে পুলিশের তদন্তকে অস্বচ্ছ দাবি করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। হত্যাকাণ্ডের সে সব সূত্র পাওয়া গেছে, সেগুলো এড়িয়ে যাওয়া হয়েছে বলেও অভিযোগ করেন তারা।
গভীর রাতে মেসে ঢুকে সন্ত্রাসী হামলার পর প্রশ্ন উঠছে বৃহত্তর ময়মনসিংহ শহরের নিরাপত্তাব্যবস্থাকে নিয়ে। ২০১৫ সালের ১৪ সেপ্টেম্বর দেশের অষ্টম বিভাগ হিসেবে ময়মনসিংহ, নেত্রকোনা, জামালপুর, শেরপুর – এই চারটি জেলা নিয়ে গঠিত হয় ময়মনসিংহ বিভাগ। এই শহরে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, মেডিকেল কলেজ, জাতীয় কবির নামকরণে বিশ্ববিদ্যালয়, ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, বর্ষীয়ান কলেজসহ অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান রয়েছে। প্রতিবছর দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে শিক্ষার্থীরা এই শহরে আসেন শিক্ষা অর্জনের জন্য।
কিন্তু শিক্ষার্থীরা কতটুকু নিরাপদ, আবরার হত্যার পর এই প্রশ্ন আবার সামনে এলো তৌহিদ হত্যাকাণ্ডের মাধ্যমে।
গতবছর ৭ই অক্টোবর বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় (বুয়েট) এর মেধাবী ছাত্র আবরার হত্যাকাণ্ডের রেশ কাটতে না কাটতেই প্রাণ গেল তৌহিদের। দুটি হত্যাকাণ্ডের কারণ খুব সামান্য বললে ভুল হবে না। আবরারকে হত্যার কারণ ফেসবুক পোস্ট (তথ্যসূত্র: উইকিপিডিয়া) আর তৌহিদের বেলায় সামান্য তর্ক এবং ফোন চুরি থেকেই খুন।
তথ্য প্রযুক্তির এই যুগে সাইবার নিরাপত্তা জোরদার হওয়ায় ইন্টারনেটে আমরা নিরাপদ। কিন্তু বাস্তবে? বাস্তবে আসলেই কি আমরা নিরাপদ? সেটাই আজ ভাববার বিষয়। গতকাল আবরার, আজ তৌহিদ, আগামীকাল? হয়তো আগামীকাল আপনার-আমার নামই ভেসে উঠবে শত-শত পত্রিকার শিরোনামে, টেলিভিশনের দুপুর-সন্ধ্যার বুলেটিনে। এখনই শক্ত হাতে এসব অন্যায়ের বিরুদ্ধে না দাঁড়ালে, দুদিন পর হেডলাইনের বিষয় হতে পারেন আপনিও!
শেষ কথায় আসি, বাংলাদেশের খেটে-খাওয়া মানুষ থেকে শুরু করে উচ্চবিত্ত পরিবার পর্যন্ত প্রত্যেক বাবা-মা’র স্বপ্নই থাকে, নিজের সন্তানকে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ানোর। তাদের স্বপ্নই থাকে নিজের সন্তানকে গাড়ি করে বাড়ি ফিরতে দেখবে, লাশবাহী গাড়িতে নয়। আজ আধুনিক বিশ্ব হয়তো মেধা দিয়ে বিচার করা হয় কিন্তু মানবতার বিশ্ব নয়। শুধু মুখে আর কাগজে নয়, এবার বাস্তবিক সুষ্ঠু বিচার দেখার অপেক্ষায় লক্ষ-হাজার চোখ!