ঢাকা নিয়ে কিছু লিখতে হলে যে দুটি নাম সর্বাগ্রে চলে আসে তা হলো বুড়িগঙ্গা ও রমনা। বুড়িগঙ্গা ইতিহাসের বহু ঘটনা, ট্র্যাজেডি আর পরিবর্তনের সাক্ষী এ নদী। কলকল রবে সতত বহমান এর স্রোতধারা নিরন্তর ছুটে চলেছে শেষ গন্তব্যে তথা সমুদ্র পানে। ঢাকার আরেক নাম যদি বলতে হয় তবে বুড়িগঙ্গাই হবে সেই উপযুক্ত নাম। আজ যে ঢাকা রাজধানী হিসেবে গৌরবান্বিত তার অন্যতম অংশীদার বুড়িগঙ্গা।
বুড়িগঙ্গার সৌন্দর্য্যে মুগ্ধ হয়ে কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার লিখেছেন :
“সমালয় সন্নিহিত
—কবি কৃষ্ণচন্দ্র মজুমদার
বুড়িগঙ্গা প্রবাহিত
বান্দাঘাট শোভিত যাহাতে
সেখানে বসিয়ে গিয়া
জুড়ায়া সন্তপ্ত হিয়া
সলিল শিকারসিক্ত রাতে।”
ইতিহাসবিদ নীহাররঞ্জন রায় বাঙ্গালীর ইতিহাস আদিপর্বে লিখেছেন – “বাঙলার ইতিহাস রচনা করিয়াছে বাঙলার ছোট-বড় অসংখ্য নদ – নদী। এই নদনদীগুলোই বাঙলার প্রাণ। ইহারাই বাঙলাকে গড়িয়াছে। বাঙলার আকৃতি প্রকৃতি নির্ণয় করিয়াছে যুগে যুগে, এখনও করিতেছে।”
বুড়িগঙ্গার উৎপত্তি নিয়ে রয়েছে নানা মত। যত দূর জানা যায় বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরীর একটি শাখা নদী। সাভারের দক্ষিণে ধলেশ্বরী নদী থেকে বের হয়ে (কলাতিয়া এর উৎপত্তিস্থল) ফতুল্লার দক্ষিণে আবার ধলেশ্বরীর সঙ্গে মিশে গেছে। এ বর্ণনা দিয়েছেন মোকারম হোসেন তার ‘বাংলাদেশের নদী’ গ্রন্থে। আবার প্রকৌশলী আব্দুল ওয়াজেদ তার ‘বাংলাদেশ নদীমালা’ গ্রন্থে লিখেছেন – মুন্সীগঞ্জ জেলার রিকাবী বাজারের উজানে এবং হরপাড়ার ভাটিতে বুড়িগঙ্গা ধলেশ্বরী নদীতে পড়েছে। বর্তমানে এর উৎসমুখ ভরাট হয়ে গেছে। তুরাগ নদী কামরাঙ্গীরচর নামক স্থানে বুড়িগঙ্গা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে। কার্যত: বর্তমানে বুড়িগঙ্গা তার মূল স্রোতধারা তুরাগ নদী হতে পেয়ে থাকে। সমুদ্রের সাথে সংযোগ থাকায় এটি জোয়ার – ভাটা দ্বারা প্রভাবিত। জোয়ার ভাটার প্রভাবে পানির উত্থান পতন ও এর সামগ্রিক সৌন্দর্যে মুঘল শাসকেরা মুগ্ধ হয়েছিল।
উৎপত্তি নিয়ে ঢাকা কোষ গ্রন্থে বলা হয়েছে এটি গঙ্গা (পদ্মা) নদীর প্রবাহ পথ। পূর্বে বুড়িগঙ্গা নদী পথেই পদ্মা বা গঙ্গা নদী প্রবাহিত হতো বলে ধারণা করা হয়। পদ্মা নদী গতি পথ পরিবর্তন করে দক্ষিণে সরে গেলে গঙ্গার পরিত্যক্ত ক্ষীণ ধারাটি বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিতি পায়। ভূগোলবিদদের মতে দুইশত বছর পূর্বে যমুনা নদীর আকস্মিক গতি পরিবর্তনের কারণে বুড়িগঙ্গার প্রবাহমান স্রোত ভিন্নমুখী হয়ে পড়ে এবং এরপর থেকে বুড়িগঙ্গার সাথে পদ্মার সম্পর্কচ্ছেদ ঘটে। নীহাররঞ্জন রায় বর্ণনা করেছেন বুড়িগঙ্গা প্রাচীন পদ্মার খাত ছিলো বলেই একে বুড়িগঙ্গা বলে অভিহিত করা হয়।
ড. আবদুল করিম তার ‘মোগল রাজধানী ঢাকা ‘ গ্রন্থে লিখেছেন – “বাংলার একটি গুরুত্বপূর্ণ ভৌগলিক বৈশিষ্ট্য হচ্ছে নদীর গতি পরিবর্তন। সপ্তদশ শতাব্দীর সূচনালগ্নে যখন ইসলাম খান ঢাকায় তার স্থায়ী নিবাস স্থাপন করেন এবং ঢাকায় একটি রাজধানী শহরের মর্যাদা লাভ করে, তখন সম্ভবত পূর্ববাংলার নদীগুলোর অবস্থান আজকের চাইতে ভিন্ন ছিল। এন. কে ভট্টশালী দেখিয়েছেন যে, ফতুল্লা (প্রাচীনকালের ধাপা) থেকে দক্ষিণ পশ্চিম দিকে প্রবাহমান বুড়িগঙ্গার যে ধারা ধলেশ্বরী নদীর সাথে যুক্ত হয়েছে, প্রাথমিক মোঘল যুগে এবং প্রকৃতপক্ষে সপ্তদশ শতকে তার কোনো অস্তিত্ব ছিল না। তখনকার দিনে বুড়িগঙ্গা বর্তমান নামে পরিচিত ছিল কিনা বলা খুবই কঠিন। কারণ বাহারিস্তান -ই -গাইবীর লেখক মির্জা নাথন বুড়িগঙ্গাকে দোলাই নামে উল্লেখ করেছেন। কিন্ত এ দুটি নদীর সংযোগস্থলের অস্তিত্ব পরে বিদ্যমান না থাকলেও বুড়িগঙ্গা নদীর পরবর্তী গতিপ্রবাহ তার স্বাক্ষর বহন করে, যেখানে তা দুটি শাখা দ্বারা লক্ষ্যা নদীর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে এবং এ দুটি শাখায় তা বিভক্ত হয়েছে ঢাকার পূর্ব-প্রান্ত ছাড়িয়ে। প্রধান শাখাটি খিজীরপুরের নিকটে এবং অন্য শাখাটি চার মাইল উজানে ডেমরার নিকটে লক্ষ্যা নদীর সাথে মিলিত হয়েছে।”
বাংলাপিডিয়ার বর্ণনা মতে ঢাকা শহরে ভূপৃষ্ঠে অথবা ভূপৃষ্ঠের অতি স্বল্প গভীরতায় ক্ষয়রোধকারি মধুপুর কর্দমশীলা পাওয়া যায়, ফলে বুড়িগঙ্গার নদীপ্রবাহ ঢাকায় খুবই সুস্থিত।
মুঘল আমলে ১৬৪৫ সালে বুড়িগঙ্গার উপর সেতু তৈরি হয়েছিল। সেই স্থানটি এখন পাগলার পুল নামে পরিচিত। এছাড়া নির্মাণ করা হয় বাংলাদেশ চীন মৈত্রী সেতু যা ১৯৮৯ সালে যাতায়াতের জন্য খুলে দেয়া হয়। তারপর মিটফোর্ড হাসপাতালের কাছে ২য় বুড়িগঙ্গা সেতু নির্মিত হয়েছে।
বুড়িগঙ্গা নাব্য। সারা বছরই নৌ চলাচল করে । এর দৈর্ঘ্য নিয়ে মতভেদ আছে। কারো মতে ২৭ কি মি, কারো মতে ২৬, আবার কারো মতে ৩০ কি মি.। গড় গভীরতা ১০ মিটার এবং প্রস্থে ৪০০ মিটার। ১৯৮৪ সনে এর পানি প্রবাহের পরিমাপ গ্রহণ করা হয়। তাতে সর্বোচ্চ ২৯০২ ঘণমেক পানির প্রবাহ লক্ষ্য করা গেছে।
বুড়িগঙ্গার দু’তীরে গড়ে উঠেছে গুরুত্বপূর্ণ ভবনাদি, স্থাপনা ও স্থান । উত্তর পাড়ে নির্মিত হয়েছে পোস্তা প্রাসাদ (এখন বিলীন ), লালবাগ কেল্লা, রূপলাল হাউস, নর্থ ব্রুক হল, আহসান মঞ্জিল, বাকল্যান্ড বাঁধ, মিলব্যারাক, সদরঘাট নৌবন্দর, জীবন বাবুর বাড়ি, পুরান কেল্লা (জেলখানা), চক বাজার, সাত মসজিদসহ নানাবিধ সরকারি বেসরকারি ভবন ও স্থাপনা। আর ওপারে জিঞ্জিরা প্রাসাদ। যার আরেক নাম নওঘরা আবার কেউ বলে নন্ডঘরা। ১৮৬৪ সালে তৎকালীন বিভাগীয় কমিশনার সি টি বাকল্যান্ড উত্তর পাড়ে নির্মাণ করেন বাকল্যান্ড বাঁধ; (নাজির হোসেনের মতে এর আগেও এ বাধটি ছিল, বাকল্যান্ড এটি পুন:সংস্কার করেন)। যার উদ্দেশ্য ছিল নদী ভাঙন থেকে ঢাকাকে রক্ষা করা ও ঘাটমুখে পলি জমা রোধ করা।
বুড়িগঙ্গার নামকরণ নিয়েও আছে নানা মত। ‘বাংলাদেশের নদীমালা’ গ্রন্থের বর্ণনা মতে বুড়িগঙ্গার অন্য নাম নলিনী ও এন্টিবল । রামায়ণে বর্ণিত গঙ্গার পূর্বগামি তিনটি শাখা যথা হলদিনী, পাবনি, নলিনির সাথে টলেমি বর্ণিত কামবেরিখন, সিওভেস্টমন এবং এন্টিবলের সাদৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। সুতরাং এ বর্ণনা হতে যা পাওয়া যায় তা হলো রামায়ণে বর্ণিত নলিনি ও টলেমি বর্ণিত এন্টিবল হলো বুড়িগঙ্গার অন্য নাম।
বুড়িগঙ্গা নামের আগে বুড়ি শব্দের প্রয়োগ নিয়েও বিবিধ বর্ণনা দেন ঐতিহাসিকরা। ড. অশোক বিশ্বাস তার বাংলাদেশের ‘নদী কোষ’ গ্রন্থে লিখেছেন- “সমগ্র দেশে অতীতের বৃহৎ নদী মৃতপ্রায় বা অপেক্ষাকৃত ছোট নদী খাতে পরিণত হলে লোকমুখে সেগুলো বুড়াবুড়ি নদী নাম ধারণ করে, যেমন – বুড়িগঙ্গা, বুড়াগৌরাঙ্গ, বুড়ামাতামুহুরী, বুড়িতিস্তা, বুড়িভদ্রা, বুড়িশ্বর ইত্যাদি এ জাতীয় নদীর নাম।” বুড়িগঙ্গা নাম নিয়ে আরেকটি জনশ্রুতির কথা জানান ড. বিশ্বাস। তিনি লিখেছেন – “প্রাচীন কালে গঙ্গা নদীর একটি প্রবাহ ধলেশ্বরীর মাধ্যমে বঙ্গোপসাগরে পতিত হতো। ধীরে ধীরে এ প্রবাহটি তার গতিপথ পরিবর্তন করার ফলে একসময় গঙ্গার সঙ্গে প্রাচীন খাতটি সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে।পরবর্তীকালে বিচ্ছিন্ন এই প্রাচীন বা আদি খাতটিই বুড়িগঙ্গা নামে পরিচিতি পায়।” এ বিষয়ে ড. বিশ্বাস ইতিহাসবিদ সুভাষ মুখোপাধ্যায় ‘বাঙালির ইতিহাস’ গ্রন্থের উদ্বৃতি দিয়ে জানান – বুড়িগঙ্গা নামকরণের পেছনে একটি ইতিহাস রয়েছে। এখন গঙ্গা বলতে আমরা যা বুঝি, প্রায় পাঁচশ বছর আগে কৃত্তিবাসের আমলে গঙ্গার সেই দক্ষিণবাহী প্রবাহকে বলা হতো বড় গঙ্গা যাকে আমরা পদ্মা বলি। পদ্মার একটি প্রাচীনতম পথ রাজশাহী, রামপুর, বোয়ালিয়া হয়ে চলনবিলের ভেতর দিয়ে ধলেশ্বরী খাত দিয়ে ঢাকাকে পাশে রেখে মেঘনা খাড়িতে গিয়ে সমুদ্রে মিশতো; তাই ঢাকার পাশের এ নদীটির নাম বুড়িগঙ্গা।
নামকরণ নিয়ে তৈফুর তার Glimpses of Old Dhaka গ্রন্থে লিখেছেন – “The name Booriganga as applied to Dhaka river seems to have come after British occupation. In Persian histories this river has been termed as Dulai river or Nahr-e- Gang ……..it is said that in the Hindu scripture of Kalikapuran, this river has been termed as Briddha Ganga ( meaning Booriganga).” অর্থাৎ বুড়া বা বয়সী অর্থে বুড়ি শব্দ গঙ্গার সাথে যুক্ত হয়ে বুড়িগঙ্গা হয়েছে। এখানে বুড়ি শব্দ দ্বারা প্রাচীনত্বকে বুঝানো হয়েছে এবং গঙ্গার সাথে সম্পর্কযুক্ত করা হয়েছে । আমরা এখানে তৈফুরের লেখায় বুড়িগঙ্গার আরেক নাম দোলাই নদী পাই। মির্জা নাথান তার ‘বাহারিস্তান- ই- গায়বী’ গ্রন্থেও বুড়িগঙ্গাকে দোলাই নদী বলে উল্লেখ করেছেন। তবে সব নাম ছাপিয়ে এখন বুড়িগঙ্গা নামটিই টিকে আছে।
এছাড়া ড. বিশ্বাস নামকরণ নিয়ে লোকমুখে প্রচলিত একটি পৌরাণিক কাহিনীর কথাও জানান। তার বর্ণনার সার কথা এই যে, বহুকাল আগে এক ঋষির পরশুরাম নামে এক ছেলে ছিল। তার মন পাঁচেক ওজনের একটি কুঠার ছিল।সে কুঠারের আঘাতে পাথর কেটে ব্রহ্মপুত্রকে হিমালয় থেকে বের করে আনল। ব্রহ্মপুত্র ভৈরব গর্জনে সমুদ্রের পানে ছুটে চললো। এরি মাঝে সে শুনতে পেল শীতলক্ষ্যার অপরূপ রূপের কথা। অমনি ব্রহ্মপুত্র প্রবল বেগে পাড় ভাঙতে ভাঙতে বিশাল গর্জনে শীতলক্ষ্যার দিকে এগিয়ে গেল। খবর শুনে শীতলক্ষ্যার তখন ভয়ে বুক দুরুদুরু। তার মন এ দুরন্ত বরকে গ্রহণ করতে চাইছিল না। সে তখন মন্ত্র পড়ে এক বুড়ি সেজে বসে রইলো। ব্রহ্মপুত্র এসে হাঁক ছাড়ল কোথায় শীতলক্ষ্যা ? সুন্দরী শীতলক্ষ্যা বললো আমাকেই লোক শীতলক্ষ্যা বলতো, আমি বুড়ো হয়ে বুড়িগঙ্গা হয়েছি। ব্রহ্মপুত্র বললো চালাকি চলবে না , বিয়ে আমি তোমাকেই করবো। তখন ব্রহ্মপুত্র আর শীতলক্ষ্যার মিলন হলো। কিন্ত লোকে শীতলক্ষ্যার খানিক অংশকে বুড়িগঙ্গাই বলতে লাগলো। অন্যদিকে ইতিহাসবিদ নাজির হোসেন এটির ভিন্ন বর্ণনা দিয়েছেন। তিনি লিখেছেন মহামুনি জমোদাগ্নীর আদেশে পরশুরাম কুঠারাঘাত করে মাতৃহত্যা করলে সেই পাপে কুঠারটি তার হাতে আটকে যায়। তারপর নানা ঘটনা পেরিয়ে ব্রহ্মপুত্র নদীর পবিত্র পানির পরশে (হিমালয়ের হ্রদে) তার পাপমোচন হয় এবং কুঠারটি হাত থেকে খসে পড়ে। এরপর তিনি লাঙ্গলের ফলার আঘাতে পথ তৈরি করে সেই পানিকে সমভূমিতে নিয়ে আসেন। লাঙ্গলবন্দ এসে লাঙ্গল আটকে গেলে পরশুরাম বুঝতে পারেন তার উদ্দেশ্য সফল হয়েছে এবং ব্রহ্মপুত্র নদের ধারা সেখানেই থেমে গেল। তারপর ব্রহ্মপুত্র যখন শীতলক্ষ্যার রুপযৌবনের কথা জানতে পারলো তখন সে তাকে পাবার আশায় শীতলক্ষ্যার দিকে ধাবিত হলো। বাকি ইতিহাস উপরের বর্ণনার অনুরূপ বিধায় পুনরুল্লেখ করলাম না।
বুড়িগঙ্গা নানা নিষ্ঠুর ও মর্মান্তিক ঘটনার সাক্ষী। কিংবদন্তির ঢাকা গ্রন্থে নাজির হোসেন লিখেছেন – পলাশীর যুদ্ধের পর নবাব সিরাজউদ্দৌলার পরিবারের বেশিরভাগ সদস্যদের জিঞ্জিরা প্রাসাদে বন্দী করে রাখা হয়। যাদের মধ্যে ঘসেটি বেগম ও নবাব মাতা আমিনা বেগমও ছিলেন। এদেরকে পরে মীরজাফর পুত্র মিরণের নির্দেশে নৌকা করে নিয়ে বুড়িগঙ্গা ও শীতলক্ষ্যার মিলনস্থলে নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। বুড়িগঙ্গার বুকচিরেই ঢাকা আসতো পর্তুগীজ/ মগ/আরাকানী জলদস্যুরা। তারা লুটতরাজের পাশাপাশি মানুষদের ধরে নিয়ে ক্রীতদাস বানাতো এবং বিক্রি করতো। তাদের প্রতিহত করতে বৃহত্তর ঢাকার বিভিন্ন স্থানে যেমন – মুন্সীগঞ্জে (ইদ্রাকপুরে) ও নারায়ণগঞ্জে (হাজীগঞ্জে) মুঘল আমলে জলদুর্গ নির্মাণ করা হয়েছিল।
বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে গেছে মীর জুমলার শাসনামলের বিখ্যাত দুটি কামানের একটি; যার নাম ‘কালে জমজম’ বা কালে খা। অন্য একটি তথা ‘বিবি মরিয়ম’ এখন আছে ওসমানী উদ্যানে। জেমস রেনেল ও লিন্ডসের লেখনী হতে কামান দুটির বিস্তারিত বর্ণনা পাওয়া যায়। দৈর্ঘ্যে ২২ ফুট মতান্তরে ৩৬ ফুট দীর্ঘ কালে জমজম এর ওজন ছিল ৬৪,৮১৪ পাউন্ড। মীর জুমলার সময়ে বিবি মরিয়মকে বড় কাটরার সামনে আর কালে জমজমকে বড় কাটরার উল্টোদিকে বুড়িগঙ্গা নদীর ওপারে একটি চরে; ধারণা করা হয় মোগলানির চরে, স্থাপন করা হয়। সেখান থেকেই এটি ১৭৮০ সালের দিকে বুড়িগঙ্গায় তলিয়ে যায়। পুরান ঢাকার মুরব্বিদের কাছ হতে একটি কথা জানা যায় যে, মাঝে মাঝে নাকি বুড়িগঙ্গা হতে গুরুগম্ভীর নিনাদ শুনা যেত। প্রবীণদের ধারণা এটি কালে খার গর্জন যার মাধ্যমে সে তার সঙ্গিনী বিবি মরিয়মকে ডাকতো। হারিয়ে যাওয়ার পর থেকে কেউ আর উদ্যোগ নেয়নি কামানটিকে উদ্ধারে। বুড়িগঙ্গার তলদেশেই কালে খা ঘুমিয়ে আছে বলে ধারণা করা হয়। সরকারের তরফ থেকে উদ্যোগ নিয়ে একে উদ্ধার করা গেলে তবে তা হবে আমাদের প্রত্নসম্পদে এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন।
বুড়িগঙ্গার বুকে নৌদুর্ঘটনায় পানিতে ডুবে মারা গেছেন ঢাকায় নিযুক্ত সুবেদার মুকাররম খান (১৬২৬-১৬২৭ খ্রি.)। তিনি নিয়োগপ্রাপ্তির ছয় মাসের মাথায় দিল্লীর সম্রাট কর্তৃক নতুন খেতাবে ভূষিত হন । সম্রাটের এই ফরমান নিয়ে একদল রাজকর্মচারী ঢাকার পথে আসতে থাকে। মুকাররম খা সম্রাটের এই ফরমান যথাযথ সম্মান ও মর্যাদার সঙ্গে গ্রহণ করার জন্য বিশাল ও সুশোভিত নৌবহর নিয়ে বুড়িগঙ্গার বুকে এগুতে থাকেন। পরে নামাজের জন্য সুবেদারকে বহনে ব্যবহৃত নৌকাটি দ্রুত তীরে ভেড়াতে গেলে তা ডুবে যায় এবং সুবেদারসহ অনেকের সলিল সমাধি ঘটে।
ঢাকার অন্যতম প্রাসাদ ছিলো পোস্তা প্রাসাদ। ঢাকার সুবেদার আজিমুদ্দিন বা আজিম-উজ-শান ( ১৭০০ – ১৭০৩ পর্যন্ত ঢাকায় ছিলেন) এটি নির্মাণ করেন। এটি লালবাগ দুর্গের অদূরে অবস্থিত ছিল। বুড়িগঙ্গার ভাঙনে এটি বিলীন হয়ে গেছে। তৈফুর শুষ্ক মৌসুমে এ প্রাসাদের ভিত্তি নদীগর্ভে দেখেছেন বলে উল্লেখ করেছেন। বিশপ হেবারও তার রোজনামচায় এ প্রাসাদের কথা বর্ণনা করেছেন। অর্থাৎ বুড়িগঙ্গা অনেক গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা নদীগর্ভে নিয়ে গেছে।
তৈফুরের মতে ইসলামপুর, পাটুয়াটুলির দক্ষিণভাগ যেখানে আহসান মঞ্জিলসহ অনেক অট্রালিকা নির্মিত হয়েছে তার সবটাই ছিলো বুড়িগঙ্গা। একই ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া যায় হৃদয়নাথ মজুমদারের আত্মজীবনীতে। তিনি জানান – ” বিলের দক্ষিন অংশ, বংশালের দক্ষিন এবং তাতিবাজার ও কামারনগরের উত্তরাংশ মনে হয় গড়ে উঠেছিল পরবর্তী সময়ে। অনেকের ধারণা শহরের মাঝখানে ঐ বিল ছিল একসময়ে বুড়িগঙ্গা নদী, পরে নদী দক্ষিণে সরে গেলে চর পড়েছিল এই জায়গায় এবং তা অন্তর্গত হয়ে গিয়েছিল শহরের।” তিনি আরো লিখেছেন – “১৮৬৪ সালে যখন আমি প্রথম বুড়িগঙ্গা দেখেছিলাম তখন তা বয়ে যেত লালবাগ কেল্লা, চৌধুরী বাজার ও পিলখানা ঘাটের ধার দিয়ে।” বুড়িগঙ্গার যে চরের কথা লিখেছেন হৃদয়নাথ, সেই চর কালক্রমে পরিণত হয়েছিল শহরের একটি অংশে।
বুড়িগঙ্গা আজকে আমরা যা দেখি তার প্রশস্ততা সবসময় একরকম ছিল না। ১৮৬৬ সালে এক পত্রিকার রিপোর্টে বলা হয় বুড়িগঙ্গার মুখে চড়া পড়াতে এর জলের স্বল্পতা হতো। এ খবরের চল্লিশ বছর আগে নীলকর ওয়াইজ নাকি বলেছিলেন, বুড়িগঙ্গায় হাঁটুজল থাকে। প্রায় একই সময়ে কবি নবীনচন্দ্র সেন ও লিখেছেন, বুড়িগঙ্গার জল স্বল্পতা দেখে তার হাসি পেয়েছিল । তিনি লিখেন, “পূর্ববঙ্গবাসী গামলায় করিয়া পার হয় বলিয়া দীনবন্ধু মিত্র যে বিদ্রুপ করিয়াছিলেন, তাহা পূর্বে বুঝিতে পারি নাই । তখন বসন্তকাল, শ্রীমতির কলেবর এতো সংকীর্ণ যে, তখন তাহাকে অতিক্রম করিবার জন্য গামলারও প্রয়োজন ছিলনা।”
আগের দিনে নিত্য যাতায়াতের অন্যতম বাহন ছিল নৌকা। নাজির হোসেন জানান বুড়িগঙ্গার বুকে রাতদিন বিচিত্র সাজের নৌকা চলাচল করতো । সে সময় নদী পথে চলাচলের জন্য গহেনা না বা গহনা নৌকাই ছিলো প্রধান বাহন। এখন সচরাচর গহনা নৌকা চোখে না পড়লেও ক্ষুদ্রাকৃতির ডিঙ্গি জাতীয় নৌকা দেখা যায় বুড়িগঙ্গার বুকে উল্লেখযোগ্য সংখ্যায়। এপার ওপার খেয়া পার করে তারা জীবিকা নির্বাহ করে । জনপ্রতি ৫ টাকা আর রিজার্ভে গেলে ২০ টাকা গুনতে হয় যাত্রীদের। এখন প্রচুর সংখ্যক লঞ্চ দেখা যায় বুড়িগঙ্গার বুকে। যার বেশিরভাগ যাতায়াত করে বরিশাল, ফরিদপুর ও চাঁদপুর অঞ্চলে। একটা বিষয় উল্লেখ করতে চাই- সরদার ফজলুল করিম তার ‘চল্লিশের দশকের ঢাকা’ গ্রন্থে লিখেছেন – ব্রিটিশ আমলে বাদামতলী ঘাটে বা কাছাকাছি জায়গায় সন্ধ্যার পরে লঞ্চ বা স্টিমারের হুইসেল বাজানো নিষেধ ছিল পাছে নবাবের ঘুমে ব্যাঘাত ঘটে।
বুড়িগঙ্গায় আমজনতা স্নানে যেত সেসময়। এখনকার মতো জল সেসময়ে এতো অপরিষ্কার ছিল না। স্বচ্ছ জলে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি বারবনিতারাও স্নানে যেতো। উল্লেখ্য সেসময়ে জিন্দাবাহার, মালিটোলা ( ইংলিশ রোড ), ইসলামপুর, সাচিবন্দর, ও বাদামতলীতে পতিতালয় ছিল। এ সমস্ত পাড়ার বারবনিতারা বুড়িগঙ্গায় গোসল করতে যেতো। পরিতোষ সেন তার ‘ জিন্দাবাহার’ গ্রন্থে লিখেছেন- ” আমাদের পাড়ার বারবনিতারা প্রতিদিন সকালে দল বেঁধে বুড়িগঙ্গায় স্নান করতে যায়। তাদের স্নানে যাবার পথটি আমাদের বাড়ির সামনে দিয়েই । ভেজা কাপড়ে ফেরবার পথে কালি মন্দিরের দরজায় প্রণাম করে আমাদের গলির মুখে আবার দেখা দেয়। সকালবেলার এ মনোরম দৃশ্যটি আমাদের পাড়ার পুরুষদের চোখকে বেশ তৃপ্তি দেয়। তাদের মন মেজাজ খোশ রাখে। দিনটি ভালো কাটে।”
একসময় ঢাকায় বাইজিদের বসতি ছিল। উপরে বর্ণিত স্থানগুলো ছাড়াও নানা জায়গায় তাদের নিবাস ও ডেরা ছিল। বিশেষকরে রঙমহল ও বাগানবাড়িতে তাদের আনাগোনা ছিল বেশী। এরকম একটি বাইজি বাড়ি গঙ্গা্জলির সন্ধান আমরা পাই নাট্যকার সাঈদ আহমদের ‘জীবনের সাত রং’ গ্রন্থে। তিনি লিখেছেন -“সূর্যোদয়ের আগে প্রায় সব বাইজিই ওয়াইজঘাটে স্নান করতে যেত। ওরা সূর্যদেবের পূজারী। নদীর পানিতে ডুব দিত পবিত্র হবার জন্য। সারিবদ্ধভাবে গামছা পেচিয়ে ঘরে ফিরে যেত। ভেজা কাপড়ে উন্মুখ হয়ে ফুটে উঠতো তাদের সুডৌল দুটি স্তন। সেই স্তন দুলিয়ে তাদের পথ চলার দিকে আমি আর আমার বন্ধুরা মন্ত্র মুগ্ধের মত তাকিয়ে থাকতাম। “
শেষের কথা- বুড়িগঙ্গা এখন আর আগের মতো নেই। যে বুড়িগঙ্গার জল আগে স্বচ্ছ আর মাছের বিচরণ ক্ষেত্র ছিল; সে বুড়িগঙ্গার এখন করুন হাল। ক্রমাগত দূষণে এর পানি এখন কালচে আকার ধারণ করে পানের অযোগ্যতো বটেই মাছের বিচরণের জন্যেও অনুপযোগী হয়ে পড়েছে। যে কারণে বুড়িগঙ্গায় এখন আর আগের মতো মাছের সন্ধান মেলে না। তার উপর যুক্ত হয়েছে অবৈধ দখলদারিত্ব। সব মিলিয়ে বুড়িগঙ্গার অবস্থা এখন নাজুক। আমরা আশা করি সরকার এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নিবে।
তথ্যসূত্রঃ
১) Glimpses of Old Dhaka, Syed Muhammed Taifur, publisher – Lulu Bilquis Banu and Others, Dhaka, 1950.
২) জীবনের সাত রং, সাঈদ আহমদ, সাহিত্য প্রকাশ, ঢাকা, ২০০৭ ইং।
৩) জিন্দাবাহার, পরিতোষ সেন, প্যাপিরাস, কলকাতা, ১৩৯০ বঙ্গাব্দ।
৪) ইতিহাস ও স্থাপত্য ঐতিহ্যের নগর ঢাকা, মো. রেজাউল করিম, গতিধারা, ঢাকা, ২০১৬ ইং।
৫) কিংবদন্তির ঢাকা, নাজির হোসেন, থ্রিস্টার কোওপারেটিভ মাল্টিপারপাস সোসাইটি লিমিটেড, ঢাকা,১৯৯৫ ইং।
৬) ঢাকার হারিয়ে যাওয়া কামান, মুনতাসীর মামুন, ঢাকা নগর জাদুঘর, ঢাকা, ১৯৯১ ইং।
৭) ঢাকা স্মৃতি বিস্মৃতির নগরী, ( অখণ্ড), মুনতাসীর মামুন, অনন্যা, ঢাকা, ২০১৫ ইং।
৮) বাঙালির ইতিহাস, আদি পর্ব, নীহাররঞ্জন রায়, দেজ পাবলিশিং, কলকাতা, ১৪০৭ বঙ্গাব্দ।
৯) বাংলাদেশের নদী কোষ, ড. অশোক বিশ্বাস, বেঙ্গল পাবলিকেশনস , ঢাকা, ২০১৮ ইং।
১০) বাংলাদেশের নদীমালা, প্রকৌশলী আবদুল ওয়াজেদ, পালক পাবলিশার্স, ঢাকা, ২০১১ ইং।
১১) বাংলাদেশের নদী, মোকাররম হোসেন, ঐতিহ্য, ঢাকা, ২০০০ ইং।
১২) ঢাকা কোষ, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ঢাকা, ২০১৬ ইং।
১৩) চল্লিশের দশকের ঢাকা, সরদার ফজলুল করিম, কথা প্রকাশ, ঢাকা, ২০১২ ইং।
১৪) বাংলাপিডিয়া, বাংলাদেশ এশিয়াটিক সোসাইটি, ২০১৫ ইং, ( অনলাইন সংস্করণ, তথ্য সংগ্রহের তারিখ ৪/১/২০২০)।
১৫) মোগল রাজধানী ঢাকা, ড. আবদুল করিম, অনুবাদ – ড. মোহাম্মদ মুহিবউল্যাহ ছিদ্দিকী, বাংলা একাডেমি, ঢাকা, ২০০৩ ইং।
১৬) ফটো ক্রেডিট : প্রথমোক্ত দুটি, আলোকচিত্রে সেকালের ঢাকা, বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘর, ঢাকা, ২০১২ ইং।