মহরম হিজরি সনের প্রথম মাস। যা আল্লাহ তায়ালার নিকট সম্মানিত চার মাসের এক মাস। ইসলামি ক্যালেন্ডার হিসেবে হিজরি সনের প্রথম মাস বা আমরা যেটাকে নবর্বষ বলে থাকি হিজরি সনের সেই প্রথম মাসটির নাম হচ্ছে মহরম। ১০ই মহরম পবিত্র আশুরা। মুসলিম বিশ্বে এ দিনটি ত্যাগ ও শোকের প্রতীকের পাশাপাশি বিশেষ পবিত্র দিবস হিসেবে পালন করা হয়। কারণ আরবি ‘আশারা’ থেকে এর উৎকলণ। যার অর্থ হচ্ছে দশ। তাই এ মাসের দশ তারিখকে পবিত্র আশুরা বলে অবহিত করা হয়।
আদিকাল থেকেই যুগে যুগে আশুরার এই দিবসে বহু স্মরণীয় ও ঐতিহাসিক ঘটনা সংঘটিত হয়েছে, যা আমরা পবিত্র কোরআনে ও হাদিস শরীফ থেকে জানতে পাই। হাদিসে এসেছে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন যেদিন আকাশ, বাতাস, পাহাড়-পর্বত, নদী-নালা, জান্নাত-জাহান্নাম, লাওহে মাহফুজ ও যাবতীয় সৃষ্টিজীবের আত্মা সৃজন করেছেন সে দিনটি ছিল ১০ই মহারম তথা পবিত্র আশুরা দিবস। আবার এ দিনেরই কোনো এক জুমাবারে হযরত ইসরাফিল (আঃ) এর ফুঁৎকারে নেমে আসবে মহা প্রলয়। পবিত্র কোরআনের ভাষায় যাকে বলা হয় কেয়ামত। নেয়ামতের শোকর আদায় করার শিক্ষা গ্রহণ করাই হলো এই দিনের শিক্ষা।
আশুরা এর তাৎপর্য ও ফযীলতঃ
হাদীস শরীফে এ মাসকে “শাহরুল্লাহ” তথা আল্লাহর মাস বলে আখ্যায়িত করা হয়েছে। এ ছাড়াও এ মাসে আমলের ফযীলত সম্পর্কে হাদীসে বর্ণিত হয়েছে যে, হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত নবীয়ে কারীম সা. বলেন; রামাযানুল মুবারকের রোযার পর সব চেয়ে উত্তম রোযা হলো মুহাররাম মাসের রোযা। (তিরমিযী)
হযরত আব্দুল্লাহ ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত নবীয়ে কারীম সা. বলেন; যে ব্যক্তি মুহাররাম মাসে এক দিন রোযা রাখবে তাকে প্রত্যেক রোযার পরিবর্তে ত্রিশটি রোযা রাখার সওয়াব দান করা হবে।
হযরত ইবনে আব্বাস রা. থেকে বর্ণিত তিনি বলেন; আমি নবী সা. কে আশুরার দিন এবং রামাযান মাস ব্যতীত কোন ফযীলতপূর্ণ দিনের রোযার খুব গুরুত্ব দিতে দেখিনি। অর্থাৎ নফল রোযার ক্ষেত্রে যে পরিমাণ গুরুত্ব তিনি আশুরার রোযার ক্ষেত্রে দিতেন অন্য কোন রোযার ক্ষেত্রে এ পরিমাণ দিতেন না। (বুখারী, মুসলিম)
হযরত আবু কাতাদা রা. থেকে বর্ণিত রাসূল সা. বলেন; আমি আল্লাহর কাছে আশা রাখি যে, আশুরার দিনে রোযা রাখলে পূর্বের এক বছরের গুনাহ মাফ হয়ে যাবে। (মুসলিম, ইবনে মাজাহ)
হযরত আবু হুরায়রা রা. থেকে বর্ণিত নবী সা. বলেন; যে ব্যক্তি আশুরা এদিনে নিজের পরিবার-পরিজনের জন্য ভাল খাবারের ব্যবস্থা করবে আল্লাহ তাকে সারা বছর ভাল খাবারের ব্যবস্থা করে দিবেন। (বায়হাকী, আত তারগীব)
১০ই মহরম আশুরা এদিনের উল্লেখযোগ্য ঘটনাসমূহঃ
ইসলামের অনেক ঐতিহাসিক ঘটনার সূত্রপাত হয়েছে এ আশুরাতেই। যেমন – আদি পিতা হযরত আদম আঃ কে সৃষ্টি করা হয় এই দিনে এই দিনেই হযরত আদম (আঃ) কে জান্নাতে প্রবেশ করানো হয় আবার ভুলের কারণে তাদেরকে পৃথিবীতে প্রেরণের পর এ দিনই তাঁর তাওবা কবুল করা হয়। এমনিভাবে এই দিনে জাতির পিতা হযরত ইব্রাহিম (আঃ) এই দিনে জন্মগ্রহণ করেন, আবার এই দিনেই নমরুদের বিশাল অগ্নিকুন্ড হতে মুক্তিলাভ করেন। এই আশুরাতেই তুর পাহাড়ে আল্লাহর সাথে হযরত মুসা আঃ কথোপকথন হয় ও আসমানী কিতাব ‘তাওরাত’ লাভ করেন, আবার এই ১০ই মহরমেই জালেম ফেরাউনের দলবলসহ নীল দরিয়ায় সলিল সমাধি হয়। তদ্রূপ এই দিনে হযরত নুহ আঃ ও তাঁর সঙ্গী-সাথীদের মহাপ্লাবন হতে মুক্তি লাভ করেন এছাড়াও মাছের পেট হতে হযরত ইউনুস আঃ এর পরিত্রাণ পান, আসমান হতে বৃষ্টি বর্ষণের সূচনা এ সব কিছুই সংঘটিত হয়েছে ১০ই মহরম অর্থাৎ পবিত্র আশুরা এর দিনে। মোট কথা এই ১০ই মহরম যেন ইতিহাসের এক জ্বলন্ত সাক্ষী।
পবিত্র আশুরাতে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য কারবালার ঘটনাঃ
বর্তমানে মুসলমানদের কাছে এই দিনটি হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) শাহাদাৎ বর্ষিকী হিসেবে বেশি স্মরণীয়। প্রায় এক হাজার ৩৩২ বছর আগে ৬১ হিজরির ১০ই মহররম ফোরাত নদীর তীরবর্তী কারবালা প্রান্তরে শাহাদাত বরণ করেন মহানবী হজরত মুহাম্মদ (সাঃ)-এর প্রিয় দৌহিত্র ইমাম হুসাইন (রাঃ) ইসলামের ঐতিহাসিক বিবরণী থেকে জানা যায়, খোলাফায়ে রাশেদীনের তৃতীয় খলিফা হযরত উসমান বিন আফফান (রাঃ) এর নির্মম হত্যাকাণ্ডকে কেন্দ্র করে চতুর্থ খলিফা হযরত আলী (রাঃ) ও সিরিয়ার প্রাদেশিক শাসনকর্তা হযরত মুয়াবিয়ার (রাঃ) এর মধ্যে যে সিফফিনের যুদ্ধ হয় এরই পরিপ্রেক্ষিতে খারেজিদের পাঠানো গুপ্তঘাতক আবদুর রহমান বিন মুলজিমের হাতে হযরত আলী (রাঃ) শাহাদৎবরণ করেন এরপর হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) খলিফা পদে আসীন হন। হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) খলিফা হওয়ার কিছু দিন পর হযরত মুগীর (রাঃ) এর পরামর্শে হযরত আলী (রাঃ) এর বড় ছেলে হযরত ইমাম হাসান (রাঃ) এর সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি ভঙ্গ করে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর পরিবর্তে তার নিজ পুত্র ইয়াজিদকে পরবর্তী খলিফা হিসেবে ঘোষণা করেন মুয়াবিয়া। ৬৮০ খ্রিষ্টাব্দে ইয়াজিদ খলিফা পদে আসীন হলে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) তাকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করেন। তিনি হযরত মুয়াবিয়া (রাঃ) এর রাজতান্ত্রিক উত্তরাধিকার মনোনয়নকে প্রত্যাখ্যান করেন
সাধারণ মানুষ ইমাম হুসাইনকে (রাঃ) চেয়েছিলেন। ইসলামী শরীয়ায় বংশানুক্রমিক শাসন হারাম তাই ইয়াজিদের কাছে বাইয়্যাত (আনুগত্য স্বীকার) নিতে অস্বীকৃতি জানান ইমাম হুসাইন (রাঃ) । ইতোমধ্যে ইরাকের কুফার অধিবাসীরাও ইয়াজিদকে খলিফা হিসেবে মেনে নিতে অস্বীকার করে তার বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণের জন্য হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর কাছে প্রায় ৫০০টি চিঠি পাঠান। ইয়াজিদের শাসনের প্রতিবাদে ইমাম হুসাইন (রাঃ) মদীনা ছেড়ে মক্কায় চলে যান। পরে মক্কা থেকে কুফার উদ্দেশ্যে হিজরত করেন।
কুফাবাসীর কথায় আস্তা রেখে ইয়াজিদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণে সম্মত হোন হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) । তিনি এ লক্ষ্যে কুফার প্রকৃত অবস্থা অবগত হওয়ার জন্য তার চাচাতো ভাই মুসলিম বিন আকিলকে কুফায় পাঠান। মুসলিম কুফায় পৌঁছানের আগেই কুফাবাসী ও হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর অস্ত্রধারণের বিষয়টি ইয়াজিদ জেনে যান। ফলে তিনি কুফার শাসন-কর্তাকে বহিষ্কার করে আবদুল্লাহ বিন জিয়াদকে শাসক নিযুক্ত করেন। জিয়াদ দায়িত্ব গ্রহণ করেই কুফাবাসীকে অর্থের বিনিময়ে বিকল্পে ভয় দেখিয়ে ইয়াজিদের প্রতি আনুগত্য প্রকাশে বাধ্য করেন। এছাড়া কুফাবাসীর চারিত্র্যিক বৈশিষ্ট্যও এর জন্য কম দায়ী ছিল না।
সৈয়দ আমির আলী তার ‘এ শর্ট হিস্ট্রি অব স্যারাসিনস’ গ্রন্থে বলেছেন,
“দূরাকাঙ্ক্ষী, হিংস্র ও উদ্যমী কুফাবাসীদের চরিত্রে অধ্যবসায় ও স্থিরতার চূড়ান্ত অভাব ছিল। তারা দিন থেকে দিনান্তরে নিজেদের মনের খবরই জানত না। কিছু কারণ বা ব্যক্তি বিশেষের জন্য তারা এই মুহূর্তে আগুনের মতো প্রজ্বলিত তো পর মুহূর্তে আবার বরফের মতো শীতল এবং মড়ার মতো উদাসীন।”
হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর ক্ষেত্রেও একই ঘটনা ঘটেছিল। ফলে হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) যখন কুফাবাসীদের সাহায্য করার জন্য ইরাক সীমান্তে হাজির হন তখন তিনি ইয়াজিদ প্রেরিত সৈন্য ছাড়া কোনও কুফাবাসীর অস্তিত্ব খুঁজে পেলেন না। এমতাবস্থায় তিনি প্রতিশ্রুত সাহায্য প্রাপ্তির আশায় ফোরাত নদীর তীরে কারবালায় শিবির স্থাপন করে অপেক্ষা করতে লাগলেন। কিন্তু শেষপর্যন্ত কুফাবাসীদের ছায়াও খুঁজে না পেয়ে তিনি ইয়াজিদের বাহিনীর নিকট তিনটি প্রস্তাব করেনঃ
১। তাকে মদিনায় ফেরত যেতে দেওয়া হোক।
২। তুর্কি সীমান্তের দুর্গে প্রেরণ করা হোক, যেন তিনি জিহাদে অংশগ্রহণ করতে পারেন।
অথবা
৩। তাকে নিরাপদে ইয়াজিদের সাক্ষাৎ লাভের সুযোগ করে দেওয়া হোক।
কিন্তু ইয়াজিদ বাহিনী তার কোনও অনুরোধই রাখলো না। ইয়াজিদের সৈন্যদের অবরোধে ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর শিবিরে খাদ্য ও পানি সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। নারী-শিশু সবাই পানির জন্য কাতর হয়ে পড়েন। কিন্তু ইমাম হুসেইন (রাঃ) আত্মসমর্পণে অস্বীকৃতি জানান। অবশেষে হিজরি ৬১ সনের ১০ মহররম ইয়াজিদের বাহিনীর আগ্রাসনের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলেন ইমাম হুসাইন (রাঃ)।
ফলে কারবালার প্রান্তরে মাত্র ৩০ জন অশ্বারোহী, ৪০ জন পদাতিক এবং ১৭ জন নারী-শিশু নিয়ে তিনি ইয়াজিদ বাহিনীর মোকাবিলায় অস্ত্র হাতে তুলে নিলেন। যুদ্ধে বীরত্বের সঙ্গে লড়াই করে ৭২ জন সহযোদ্ধাসহ তিনি শাহাদাৎ বরণ করেন। শিমার ইবনে জিলজুশান নিজে কণ্ঠদেশে ছুরি চালিয়ে ইমাম হুসাইনকে (রাঃ) হত্যা করেন।
ইয়াজিদ বাহিনীর নিষ্ঠুরতা আজও গোটা বিশ্ববাসীকে তাক লাগিয়ে দেয়। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর সাথে আসা শিশু বাচ্চাগুলো যখন তৃষ্ণায় কাতর হয়ে ছিলো এবং ফোরাত নদীর পানি পান করার জন্য ছটফট করছিলো তারা ঐ ফুলের মত মাসুম বাচ্চা গুলোকেও একফোটা পানি পান করতে দেয় নি। তাছাড়াও তারা হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর দেহ থেকে মাথা ছিন্ন করে কুফায় দুর্গে নিয়ে যায়। উবায়দুল্লাহ ওই ছিন্ন মস্তককে বেত্রাঘাত করে উল্লাস প্রকাশ করেন। ওই নিষ্ঠুরতা দেখে একজন কুফাবাসী ‘হায়!’ বলে চেঁচিয়ে ওঠেন। সেদিন থেকে শিয়া বা আলী (রাঃ) এর সমর্থকরা ‘হায় হুসেন’ বলে আশুরার দিন মাতম করেন।
যদিও আশুরার মূল শিক্ষা হচ্ছে ধৈর্য্য ও ত্যাগের মহিমায় উদ্ভাসিত হওয়া। হযরত ইমাম হুসাইন (রাঃ) এর আর্দশে উজ্জীবিত হয়ে মানবতাবিরোধী অপরাধ থেকে বিরত থাকা সত্য ও সুন্দরকে প্রতিষ্ঠিত করায় আত্মনিয়োগ করা।
শান্তি ও সম্প্রীতির ধর্ম ইসলামের সুমহান আদর্শকে সমুন্নত রাখতে তাদের এই আত্মত্যাগ মানবতার ইতিহাসে সমুজ্জ্বল হয়ে রয়েছে। কারবালার এই শোকাবহ ঘটনা ও পবিত্র আশুরা শাশ্বত বাণী সকলকে অন্যায় ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হতে অনুপ্রেরণা যোগায়। সত্য ও সুন্দরের পথে চলার প্রেরণা যোগায়।
এই পবিত্র দিনকে নিয়ে আমরা অনেকে অনেক কুসংস্কারে লিপ্ত হয়ে যায় যা আমাদের বর্জন করে চলা উচিত যেমনঃ
হযরত হুসাইন (রাঃ) এর কথা স্মরণ করে কারবালার কথা স্মরণ করে যা কিছু করা হচ্ছে, যেমনঃ মাতম করা হচ্ছে, বুক চাপড়ানো হচ্ছে, হায় হুসাইন হায় হুসাইন, ইয়া আলী! বলে আবেগ জাহির করা হচ্ছে, শোক মিছিল করা হচ্ছে, তাযিয়া বের করা হচ্ছে, এগুলো মানুষের সৃষ্টি করা কুসংস্কার। কুরআন ও হাদীসে এর কোন ভিত্তি নেই। বিশেষ করে শিয়া সম্প্রদায় অনুসারীরাের সাথে বেশি লিপ্ত আর তাদের দেখাদেখি অন্যান্য সম্প্রদায়ের মানুষগুলোর মধ্যেও এগুলো চালু হয়েছে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদেরকে এগুলো থেকে হেফাযত করুন এবং আশুরার ফযীলত অর্জন করার তাওফীক দান করুন। আমীন। মুসলিম বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো আমাদের বাংলাদেশেও যথাযোগ্য মর্যাদায় পবিত্র আশুরা পালিত হয়ে থাকে।