এখন থেকে ৭৫ বছর আগের কথা। ১৯৪৫ সালের ৬ই আগস্ট। জাপানের হিরোশিমা শহরে সূর্য উঠেছে কিছু পূর্বে। আর দশটা সকালের মতো নতুন দিনের প্রস্তুতি শুরু হয়েছে হিরোশিমাজুড়ে। ছোট ছোট বাচ্চারা স্কুলের জন্য তৈরি হচ্ছে, কর্মজীবীরা ব্যস্ত গন্তব্যস্থলে পৌঁছাতে। স্বাভাবিক প্রাণচাঞ্চল্যে মুখর হয়ে উঠছিল ৩৪৭ বছরের পুরনো হিরোশিমা শহর। সবকিছু ঠিকঠাকই চলছিল। হঠাৎ এক মার্কিন বিমান উড়ে গেল হিরোশিমার আকাশ দিয়ে। বিমানটির নাম ছিল ‘ইনোলা গে’। বিশালাকৃতির বোমাসদৃশ কিছু একটা ফেলা হলো ইনোলা গে বিমান থেকে। তখনও বোঝার উপায় ছিল না সামনে কী ভয়াবহতা অপেক্ষা করছে। পারমাণবিক বোমাটি মাটিতে পড়ার সাথে সাথেই বিস্ফোরিত হয়। কয়েক মুহুর্তের মধ্যেই পুরো হিরোশিমা শহর লণ্ডভণ্ড হয়ে যায়। মানুষের পালানোরও কোনো উপায় ছিল না। যে যেখানে ছিল, সেখানেই তাৎক্ষণিক মৃত্যুবরণ করে। মাত্র কয়েক মিনিটের ব্যবধানে সাজানো শহর হিরোশিমা ঢেকে যায় ছাই এর আস্তরণে। শহরটির গতিপথ থমকে যায় দীর্ঘ সময়ের জন্য।
হিরোশিমায় ফেলা বোমাটির নাম ছিল ‘লিটল বয়’। এটিই মানব ইতিহাসে ব্যবহৃত প্রথম পারমাণবিক বোমা। পারমাণবিক বোমার আঘাতে তাৎক্ষণিকভাবে ৮০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে, পরবর্তীতে আরো পঞ্চাশ হাজারের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করে। বিস্ফোরণের তাণ্ডবে আহত হয় লক্ষাধিক। হিরোশিমা শহর এদিন প্রায় নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এর ঠিক ৭২ ঘণ্টা পর, ৯ই আগস্ট জাপানের আরেকটি শহর তছনছ হয়ে যায় পারমাণবিক বোমার আঘাতে৷ সেই শহরটির নাম নাগাসাকি। ৯ই আগস্ট সকালে নাগাসাকির ওপর ফেলা হয় ‘ফ্যাট ম্যান’ । ফ্যাট ম্যানের আঘাতে আনুমানিক ৭০ হাজার মানুষের মৃত্যু ঘটে। হাজার হাজার মানুষ আহত হয় এবং পঙ্গুত্ব বরণ করে। এই দুই শহরে পারমাণবিক হামলার মাধ্যমেই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের চূড়ান্ত অবসান ঘটে। কিন্তু হামলার দুঃসহ স্মৃতি বিশ্ববাসী, বিশেষ করে এই দুই শহরের বাসিন্দারা আজও বয়ে বেড়াচ্ছে।

পারমাণবিক বোমা দু’টির আঘাতে হিরোশিমা ও নাগাসাকি শহর শুধু ধ্বংস-ই হয়নি, বরং একটি গভীর ক্ষত এ শহর দু’টিকে চিরদিনের জন্য আঁকড়ে ধরে। বোমার আঘাতে অসংখ্য পরিবার পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়, সর্বশান্ত হয় আরো লক্ষাধিক৷ বোমার তেজস্ক্রিয়তা ছড়িয়ে পড়ে পুরো অঞ্চলজুড়ে। অফিস, আদালত, কল-কারখানাগুলো বিকল হয়ে পড়ে। তেজস্ক্রিয়তার ফলে ফসলও বিনষ্ট হয়। আহত ব্যক্তিদের দীর্ঘদিনের চিকিৎসার পরেও পুরোপুরি সুস্থ করে তোলা সম্ভব হয়নি। বিজ্ঞানীরা জানান, পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তা বছরের পর বছর ধরে সক্রিয় থাকে। হিরোশিমা, নাগাসাকিতেও এমনটি ঘটেছে।
পারমাণবিক তেজস্ক্রিয়তার কারণে মাটির উর্বরতা নষ্ট হয়ে গিয়েছিল, কয়েক বছর পর্যন্ত অঞ্চলগুলোতে ফসল উৎপাদন সম্ভব হয়নি। শহর দু’টির আবহাওয়াও বিষাক্ত হয়ে গিয়েছিল সে সময়। প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে বিকলাঙ্গ শিশুর জন্ম হয়েছে এ দু’টি বোমার ফলে। ফ্যাট ম্যান ও লিটল বয়ের আঘাতে পুরো জাপানেই বড় ধরনের মানবিক সংকট দেখা দেয়। বেঁচে যাওয়া সহায়-সম্বল হারানো, আহত মানুষগুলো প্রচণ্ড দুঃসময় পার করছিল।
শহর দু’টিকে পুনরুজ্জীবিত করতে জাপান সরকারকেও নানা প্রতিকূলতার মুখোমুখি হতে হয়। আবার, প্রত্যক্ষদর্শী এবং আঘাতপ্রাপ্ত ব্যক্তিরা দীর্ঘসময় ধরে ট্রমায় ভুগছিল, অনেকের মানসিক বিকৃতিও ঘটে৷ হিরোশিমা-নাগাসাকি ট্র্যাজেডি জাপানিদের স্বাভাবিক জীবনাচরণ এবং জাতির ইতিহাসকেই বদলে দিয়েছে। এ ট্র্যাজেডির ভয়াবহতা জাপানবাসীকে যেমন আলোড়িত করে, সমানভাবে বিশ্ববাসীকেও আতংকগ্রস্ত করে তোলে। পারমাণবিক শক্তির যে ভয়াবহতা পৃথিবীর মানুষ প্রত্যক্ষ করেছে, তার রেশ এখনো কাটেনি।
হিরোশিমা-নাগাসাকি ট্র্যাজেডির মধ্য দিয়েই পারমাণবিক যুগে প্রবেশ করে পৃথিবী। পরবর্তী সময়ে পারমাণবিক বোমার বিধ্বংসী প্রভাবে নিয়ে বিশ্বজুড়ে আলোচনা সৃষ্টি হলেও পরমাণু শক্তির অপব্যবহার ও মানবঘাতক বোমা তৈরি কমেনি, বরং বেড়েছে৷ এই ভয়াবহতা দেখার পর পারমাণবিক দৌরাত্ম্য নতুন গতি লাভ করে। পৃথিবীর দেশগুলোর শক্তিমত্তার মানদণ্ডে পরিণত হয় ধ্বংসাত্মক পারমাণবিক বোমা। বিশ্বের প্রাধান্য বিস্তারকারী দেশগুলো শক্তি প্রমাণের এই ভয়ানক খেলায় মেতে ওঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে পরমাণু শক্তি নিয়ে জোরালো গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষা শুরু হয়। এর সাথে পাল্লা দিয়ে পারমাণবিক শক্তিধর দেশের তালিকাও দীর্ঘতর হয়েছে। ইউরোপ, আমেরিকার মতো দক্ষিণ এশিয়ারও কয়েকটি দেশ পরমাণু অস্ত্র তৈরিতে মনোযোগী হয়ে ওঠে এবং কয়েক বছরের মধ্যে অস্ত্র তৈরিতে সক্ষম হয়। এখনও বিশ্বের অনেক দেশ নিজেদেরকে পরমাণু শক্তিধর হিসেবে গড়ে তোলার আপ্রাণ চেষ্টা করছে। বিপজ্জনক এই প্রতিযোগিতায় উন্মাদ হয়ে পৃথিবীর বড় বড় দেশগুলো মানবজাতিকে ভয়ংকর হুমকির মুখে ঠেলে দিয়েছে। পরমাণু শক্তিসম্পন্ন দেশগুলোর কাছে যে পরিমাণ পারমাণবিক অস্ত্র মজুত রয়েছে; তার একটি ক্ষুদ্র অংশও যদি ব্যবহৃত হয়, তবে পুরো পৃথিবীকেই ধ্বংস করে ফেলা যাবে।
বিশ্বব্যাপী পরমাণু বোমা বৃদ্ধির সাথে মানুষের আতংক ও উৎকণ্ঠাও বেড়েছে সমানতালে। পৃথিবীর যে প্রান্তেই হোক, দু’টি দেশের মধ্যে উত্তেজনার সৃষ্টি হলে, পারমাণবিক হামলার শংকা মানুষের মনে জেগে ওঠে। বিশ্বের যুদ্ধপীড়িত অঞ্চলের মানুষেরা এই ভয় নিয়েই নির্ঘুম রাত কাটায়। আমাদের গ্রহের প্রতিটি মানুষের দিন কাটে পারমাণবিক অস্ত্র নিক্ষেপের অনিশ্চয়তার মাঝে। এই অনিশ্চয়তা, আতংক আর উৎকণ্ঠার বেড়াজাল থেকে মানুষকে মুক্তি দিতে হলে পরমাণু শক্তিধর দেশগুলোকেই প্রথমে এগিয়ে আসতে হবে। পরমাণু অস্ত্র নিরোধ সংক্রান্ত যে সকল চুক্তি ও সমঝোতা দেশগুলোর মাঝে সাক্ষরিত হয়েছে, তার যথাযথ ও কার্যকরী প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে৷ পারমাণবিক ঝুঁকি ও তা থেকে পরিত্রাণের উপায় খুঁজতে প্রতিটি দেশকে একতাবদ্ধ হতে হবে। এক্ষেত্রে বিশ্বমিডিয়ার সরব আলোচনা শক্তিশালী ভূমিকা রাখতে পারে৷ পৃথিবীবাসীর শান্তি নিশ্চিতকরণের লক্ষ্যে প্রয়োজনে নতুন চুক্তি সম্পাদন ও বাস্তবায়ন করতে হবে। একটি নির্দিষ্ট প্রক্রিয়া মেনে ও সম্মিলিত সিদ্ধান্তের মাধ্যমে পারমাণবিক অস্ত্রের পরিমাণ কমাতে হবে এবং এক পর্যায়ে তা শুন্যে নামিয়ে আনতে হবে৷ বিশ্বশান্তি রক্ষা এবং আগামী প্রজন্মের জন্য একটি বাসযোগ্য ও নিরাপদ পৃথিবী তৈরির প্রশ্নে বিশ্বের ৭৮০ কোটি মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসের বিকল্প নেই। সেজন্য বিশ্বনেতৃবৃন্দের পাশাপাশি পৃথিবীর আপামর জনগণেরও একতাবদ্ধ হওয়া প্রয়োজন।

বিশ্বের প্রতিটি শান্তিকামী মানুষ পরমাণু অস্ত্রমুক্ত একটি সুন্দর আগামীর স্বপ্ন দেখে। পারমাণবিক শক্তিকে অস্ত্র তৈরিতে বা যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহার না করে বরং শিল্পক্ষেত্র ও বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ব্যবহার করা যায়। এতে করে শিল্পের দ্রুত উন্নতি ও উৎপাদন ক্ষমতা যেমন বৃদ্ধি পাবে, তেমনিভাবে বিপুল পরিমাণ শক্তির সুষ্ঠু ব্যবহার নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। জাপানের নিহতদের স্মরণে হিরোশিমা পিস মেমোরিয়াল পার্কে একটি মশাল জ্বালানো হয়৷ ১৯৬৪ সালের ১লা আগস্ট থেকে অবিরাম জ্বলছে এই মশাল। পৃথিবীর সর্বশেষ পরমাণু অস্ত্রটি যেদিন ধ্বংস করা হবে এবং ‘পারমাণবিক অস্ত্র’ নামক রূপকথার দৈত্য পৃথিবীর বুক থেকে বিদায় নিবে, সেদিনই এই মশালের অগ্নিশিখা নেভানো হবে। বিশ্বের শান্তিকামী জনগণ চায় অতি দ্রুত হিরোশিমা মশালের আগুন নিভে যাক, অবসান হোক পৃথিবীর ভয়াল পারমাণবিক যুগের।
আরো পড়ুন,