পেগাসাস স্পাইওয়্যারের নির্মাতা ইসরায়েলি প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপ। পেগাসাস মূলত পৌরানিক এক পক্ষীরাজ ঘোড়ার নাম। ভারতীয় ও গ্রিক পুরানে উল্লেখ আছে এই পক্ষীরাজ ঘোড়ার। সেই পৌরানিক ঘোড়ার নামেই নিজেদের তৈরি এই হ্যাকিং সফটওয়্যারের নাম দিয়েছে এনএসও গ্রুপ।
বর্তমান বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় নির্মাতাদের অন্যতম এনএসও গ্রুপ। তাদের পেগাসাস স্পাইওয়্যার এমনভাবে তৈরি করা হয়েছে, যাতে সেটা সহজেই আইফোন ও অ্যানড্রয়েড ফোনে প্রবেশ করে তথ্য হাতিয়ে নিতে পারে। ২০১০ সালে প্রতিষ্ঠিত এই কোম্পানির ৪০ দেশে ৬০টি গ্রাহক রয়েছে। গত বছর তাদের আয় ছিল ২৪ কোটি ডলারের বেশি। এই কোম্পানির বেশির ভাগ মালিকানায় রয়েছে লন্ডনভিত্তিক বেসরকারি আর্থিক প্রতিষ্ঠান নোভালপিনা ক্যাপিটাল।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার সম্পর্কে যেভাবে জানতে পারে বিশ্বঃ
পেগাসাস ব্যবহার করে তথ্য হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বা চেষ্টা করা হয়েছে এমন ৫০ হাজারের বেশি ফোন নম্বরের তথ্যভান্ডার পেয়েছিল প্যারিসভিত্তিক অলাভজনক সংবাদ সংস্থা ফরবিডেন স্টোরিজ। পরে মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সহযোগিতা নিয়ে ওই নম্বরগুলো ধরে অনুসন্ধান চালায় বিভিন্ন দেশের ১৭টি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যম। কয়েক মাস ধরে চলা এ অনুসন্ধানে যুক্ত ছিলেন ৮০ জনের বেশি সাংবাদিক। কিছু নম্বর নিয়ে পরীক্ষা চালানো হয় অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাবে।
বিশ্লেষণে দেখা গেছে, ইসরায়েলি প্রতিষ্ঠান এনএসও গ্রুপের অন্তত ১০টি গ্রাহক সংস্থা ২০টি দেশের ১৮০ জন সাংবাদিকের ফোন নম্বর লক্ষ্যবস্তু করেছে। এসব গ্রাহকের মধ্যে বাহরাইন, মরক্কো ও সৌদি আরবের মতো কর্তৃত্ববাদী দেশ থেকে শুরু করে আছে যুক্তরাজ্য, ভারত ও মেক্সিকোর মতো গণতান্ত্রিক দেশের সরকারি সংস্থাও। এই নজরদারি ছড়িয়েছে বিশ্বজুড়ে, ইউরোপের হাঙ্গেরি ও আজারবাইজান থেকে শুরু করে আফ্রিকার টোগো ও রুয়ান্ডার মতো সব দেশেই তা করা হয়েছে। নজরদারির আওতায় শুধু সাংবাদিক নন, রয়েছেন রাজনৈতিক নেতা, মানবাধিকারকর্মী, আইনজীবী, ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের নির্বাহী, ধর্মীয় নেতা, গবেষক, এনজিও কর্মী, সরকারি কর্মকর্তা। এমনকি কোনো কোনো দেশের ক্ষমতাসীন পরিবারের সদস্য, সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধানদের ওপরও নজরদারি চালানো হয়েছে।
স্মার্টফোনে আড়ি পাতার এই ঘটনা গত মাসে একযোগে প্রকাশ করেছে ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম গার্ডিয়ান, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ওয়াশিংটন পোস্ট ও ভারতের ওয়্যারসহ বিশ্বের ১৭টি সংবাদমাধ্যম। তাদের দেওয়া তথ্যমতে, ৫০টির বেশি দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের স্মার্টফোনে আড়ি পাতা হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। মূলত দেশগুলোর সামরিক বাহিনী, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা ও গোয়েন্দা সংস্থা সফটওয়্যারটি ব্যবহার করে হাজার হাজার মানুষকে নজরদারির জালে আটকেছে। গোপনীয়তার নীতিমালা অনুযায়ী, সফটওয়্যারটির নির্মাতা এনএসও গ্রুপ গ্রাহকের তথ্য প্রকাশ করে না।
একবার কোনো ফোনে (স্মার্টফোন) পেগাসাস স্পাইওয়্যার ঢুকে গেলে এনএসওর গ্রাহক পুরো ফোনের নিয়ন্ত্রণ পেয়ে যায়। এমনকি হোয়াটসঅ্যাপ, টেলিগ্রাম, সিগন্যালের মতো এনক্রিপটেড মেসেজিং অ্যাপের বার্তাগুলোও পড়তে পারে।
অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনালের সাইবার সিকিউরিটি ল্যাব পরিচালনাকারী ক্লডিও গার্নিয়েরি
যেভাবে ফোন হ্যাক করে পেগাসাসঃ
পেগাসাস খুব সহজেই যে কারো ফোনে প্রবেশ করানো যায়। যে পদ্ধতিতে ফোনগুলিকে হ্যাক করা হতো, তাকে বলা হতো স্পিয়ার ফিশিং। কোনো লিংকের মাধ্যমে এই ম্যালওয়্যার আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে পাঠানো যায়। সেই লিংক ফোনের ব্যবহারকারী ক্লিক করলেই তার ফোনে সক্রিয় হয়ে যায় এই স্পাইওয়্যার। আবার ভয়েস কলের মাধ্যমেও এই সক্রিয় করা যায়। তবে বর্তমানে আরও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এনএসও গ্রুপের তৈরি এই সফটওয়্যার। এখন আর ব্যবহারকারীকে কোনও লিঙ্ক পাঠানো হয় না। টার্গেটের অনুমতি ছাড়াই ফোনে নজর রাখতে পারে পেগাসাস স্পাইওয়্যার। এই পদ্ধতিকে বলা হয় জিরো ক্লিক (জিরো ক্লিক)। যার মানে কোনও লিঙ্কে ক্লিক করার প্রয়োজন পড়ে না আজকাল।
এই ম্যালওয়ার আইফোন কিংবা অ্যান্ড্রয়েড ফোনে প্রবেশ করে ফোনের মাধ্যমে বলা কথা, ম্যাসেজ, ছবি, হোয়াটসঅ্যাপ চ্যাট, এমনকি ছবিও পেগাসাসের মাধ্যমে হ্যাক হতে পারে। একইসঙ্গে কল রেকর্ড এবং গোপনে মাইক্রোফোন চালুও রাখতে পারে এই ম্যালওয়ার। ফোনের মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সম্পর্কে প্রতিটি তথ্যই হ্যাকারের কাছে পৌঁছাতে পারে।
তবে এনএসও’র দাবি তারা এই সফটওয়্যার শুধুমাত্র কোনো দেশের সরকারকেই বিক্রি করে। কোনো ব্যক্তিকে নয়।
পেগাসাস স্পাইওয়্যারের প্রথম ব্যবহারঃ
স্পাইওয়্যার হলো একটি ম্যালওয়ার, যেটা কোনো ব্যক্তির অগোচরে তাঁর কম্পিউটার, ফোন বা অন্যান্য ডিভাইস থেকে তথ্য সংগ্রহ করে। আধুনিক প্রযুক্তির স্পাইওয়্যার সাধারণত আইন প্রয়োগকারী বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো ব্যবহার করে। বর্তমান বিশ্বে ব্যয়বহুল এই প্রযুক্তির বড় বাজার রয়েছে।
২০১৯ সালে প্রথম এই পেগাসাস স্পাইওয়্যারের বিষয়টি সংবাদ শিরোনামে এসেছিল। ২০১৬ সাল থেকে এনএসওর গ্রাহকেরা এসব নম্বরে আড়ি পেতেছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। তবে ২০১৪ সালে পেগাসাসের প্রথম ব্যবহার করা হয়েছিল । এক আরব মানবাধিকার কর্মীর আইফোন হ্যাক করার সময় এই সফটওয়ার ব্যবহার করা হয়েছিল। এরই জেরে আইফোন প্রস্তুতকারক সংস্থা অ্যাপল ঘটনার কয়েক দিন পর তাদের অপারেটিং সিস্টেম আপডেট প্রকাশ করেছিল।
২০১৭ সালে সাইবার সুরক্ষা গবেষকরা জানিয়েছিলেন, এ ধরনের সফটওয়্যার অ্যান্ড্রয়েডভিত্তিক স্মার্টফোনে সহজেই ব্যবহার করা যায়। ২০১৯ সালে এনএসওর সঙ্গে পেগাসাস নিয়েই ফেসবুকের মতোবিরোধ প্রকাশ্যে আসে। বর্তমানে পেগাসাস সবচেয়ে পরিশীলিত হ্যাকিং সফটওয়্যার।
পেগাসাস স্পাইওয়্যার থেকে নিরাপদ থাকার উপায়ঃ
সাধারণত পেগাসাস স্পাইওয়্যার দ্বারা সাধারণ মানুষের মোবাইল থেকে ব্যক্তিগত তথ্য চুরির বা নজরদারির সম্ভবনা নেই। তবুও সব ক্ষেত্রেই নিরাপদ থাকার প্রক্রিয়ার সিংহভাগ হলো নিজে সচেতন হওয়া। সে জন্য আপনি যা যা করতে পারেন—
১. মুঠোফোনে যেকোনো ধরনের বার্তায় কোনো লিংক এলে দুটি জিনিস দেখুন। (ক) যিনি পাঠিয়েছেন, তাঁকে আপনি বিশ্বাস করেন কি না। (খ) যে লিংক এসেছে, সেটি নির্ভরযোগ্য কোনো ওয়েবসাইটের কি না। পেগাসাস ছড়িয়েছে আই মেসেজে আসা ওয়েব লিংকের মাধ্যমে। বেশির ভাগ সাইবার অপরাধীরা কিন্তু এই পদ্ধতি ব্যবহারের চেষ্টা করেন।
২. আপনার ফোনের অপারেটিং সিস্টেম থেকে শুরু করে সব অ্যাপ সর্বশেষ সংস্করণে হালনাগাদ রাখুন।
৩. ম্যালওয়্যার তৈরিতে সময়, শ্রম ও অর্থের খরচ কম হয় না। এরপর সেটি ব্যবহারকারীর স্মার্টফোনে ছড়িয়ে দিতে পারলে তবেই নজর রাখার সুযোগ পায় হ্যাকার। এটা তো গেল ভার্চ্যুয়াল দিক। ‘ফিজিক্যাল’ দিকটাও মাথায় রাখুন। যে কেউ যেন আপনার ফোন ব্যবহার করতে না পারে, সে জন্য পিন কোড, ফিঙ্গারপ্রিন্ট বা ফেস লকের মতো অপশন সচল রাখতে ভুলবেন না।
৪. ফ্রি পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার না করাই ভালো। বিশেষ করে যখন গোপনীয় তথ্য ব্যবহার করছেন। আর ব্যবহার যদি করতেই হয়, তবে ভিপিএন একটি ভালো সমাধান হতে পারে।
৫. সম্ভব হলে স্মার্টফোনে থাকা সংবেদনশীল তথ্য এনক্রিপ্ট করে রাখুন। আর যে ক্ষেত্রে দূর থেকে তথ্য মুছে ফেলার সুবিধা রিমোট ওয়াইপ আছে, সে সব ক্ষেত্রে সেটি সচল রাখুন। এতে আপনার ফোনটি হারিয়ে গেলে বা চুরি হলে অন্তত হাতে একটা অপশন থাকবে।
সূত্রঃ ওয়াশিংটন পোস্ট, গার্ডিয়ান, ফরবিডেন স্টোরিজ।
আরো পড়তে পারেন,
দেশে ২৮তম গ্যাসক্ষেত্র আবিষ্কার
‘ড্রাগন ম্যান’ – পাল্টে দিতে পারে মানব বিবর্তনের ধারণা
বাংলাদেশি শিক্ষার্থীদের বৃত্তি দিচ্ছে কানাডার বিশ্ববিদ্যালয়