শুভ জন্মদিন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় । আজ ১ জুলাই। ১৯২১ সালের আজকের এই দিনেই জন্ম হয় প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের। প্রতিষ্ঠার একশ বছর আজ সকলের ভালবাসার জায়গা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।
যে কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ বলা হয়
দেশের অন্যতম সেরা এই বিদ্যাপীঠ প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে বহুল পরিচিত। বাংলাদেশসহ আশপাশের দেশগুলোর লোকজন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড নামে জানে। বিশ্ববিদ্যালয়ে অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ও কথাসাহিত্যিক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম এর কারণ সম্পর্কে বলেন, ‘‘এলাহাবাদ ও ঢাকা- দুটি বিশ্ববিদ্যালয় ছিল অক্সফোর্ড মডেলের, যার জন্য এটিকে ভুলক্রমে আমরা ‘অক্সফোর্ড অব দ্য ইস্ট’ বলি, এলাহাবাদকেও ডাকা হয়। কিন্তু এটি ভুল একটা ধারণা যে, আমরা প্রাচ্যের অক্সফোর্ড হয়ে গেছি। তা কিন্তু নয়।’’
তিনি বলেন, এখানে পড়াশোনাটা হতো অক্সফোর্ড মডেলের, যেমন আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয়, সেখানে ডিনরা শিক্ষাগুরু অর্থাৎ প্রতিটি অনুষদের ডিনদের দায়িত্ব হচ্ছে শিক্ষাটাকে গতিশীল করা।
এই শিক্ষাবিদ ও সাহিত্যিক আরও বলেন, এখানকার উপাচার্য ছিলেন একজন সমন্বয়কের ভূমিকায়। ছাত্র-শিক্ষকের খুব ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক থাকবে, আমরা যেটাকে টিউটোরিয়াল বলি, যা এখন আর নেই। সেই টিউটোরিয়াল সিস্টেমটা ছিল অক্সফোর্ড মডেলের প্রধান উপকরণ, যা শিক্ষক-ছাত্রের সম্পর্কটা খুব নিবিড় করত এবং জ্ঞানের উৎপাদন ও বিতরণে সহায়তা করত।
প্রাচ্যের অক্সফোর্ড ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ইতিহাস
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা ভারতীয় উপমহাদেশের ক্ষেত্রে ব্যাপক চ্যালেঞ্জিং ছিল। পাশাপাশি অবশ্যম্ভাবী ও অত্যাবশ্যকীয়ও ছিল। কেননা তৎকালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের পাশাপাশি বাংলাদেশেও একটা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নেয় ব্রিটিশরা। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে প্রথম উদ্যোগ নেন তৎকালীন বিট্রিশভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ। কারণ বঙ্গভঙ্গের ইতিহাসের দিকে খুব ভালো করে তাকালে দেখা যাবে পূর্ব বাংলা আর আসামের মুসলমান সমাজে এর প্রভাব ছিল সবচেয়ে বেশি। নতুন রাজধানী ঢাকাকে কেন্দ্র করে শিক্ষাদীক্ষা আর কর্মক্ষেত্রের সুযোগ বাড়তে থাকে।

১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদের পরে ১৯১২ সালে পূর্ব বাংলা ও আসাম সফরে এসে ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ঘোষণা করেছিলেন,
“গত কয়েক বছরে শিক্ষাক্ষেত্রে পূর্ব বাংলার যে অগ্রগতি হয়েছে তাতে ভারত সরকার আনন্দিত হয়েছে এবং ভারত সচিবের কাছে তারা ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন ও পূর্ব বাংলার শিক্ষা ব্যবস্থায় উন্নতির জন্য একজন বিশেষ অফিসার নিয়োগের সুপারিশ করবে।”
ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ
পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়নে নাথান কমিশন
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা প্রণয়নের জন্য ১৯১২ সালের ২৭ মে বঙ্গীয় সরকার কর্তৃক গঠিত হয় ১৪ সদস্যবিশিষ্ট “নাথান কমিশন”। নাথান কমিশনের সদস্যদের ছিলেন আর. নাথানিয়েল, বার-অ্যাট-ল’। অন্যান্য সদস্য ছিলেন বাংলার গণশিক্ষা অধিদপ্তরের পরিচালক জি.ডব্লিউ কুচলু, কলকাতা হাইকোর্টের অ্যাডভোকেট রাসবিহারী ঘোষ, নওয়াব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী, নওয়াব সিরাজুল ইসলাম, ঢাকার জমিদার ও উকিল আনন্দচন্দ্র রায়, আলীগড়ের মুহম্মদ আলী, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যক্ষ এইচ.আর জেমস, ঢাকা কলেজের অধ্যক্ষ ডব্লিউ.এ.টি আর্চবোল্ড, কলকাতা সংস্কৃত কলেজের অধ্যক্ষ সতীশচন্দ্র আচার্য, ঢাকা জগন্নাথ কলেজের অধ্যক্ষ ললিত মোহন চ্যাটার্জী, কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজের অধ্যাপক সি.ডব্লিউ পীক ও ঢাকা মাদ্রাসার সুপারিনটেনডেন্ট শামসুল উলামা আবু নসর মুহম্মদ ওহীদ। ডি.এস ফ্রেজার এ কমিটির সেক্রেটারি নিযুক্ত হন।

প্রতিষ্ঠালগ্নেই বিরোধিতা
লর্ড হার্ডিঞ্জের ঢাকা সফর শেষে কলকাতা ফিরে যাওয়ার পরে ১৯১২ সালের ১৬ই ফেব্রুয়ারি ড. রাশবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধি দল ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা করে স্মারকলিপি দেয়। রাশবিহারী ঘোষের সাথে একমত ছিলেন বিপিন চন্দ্র পাল, সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, সুরেন্দ্রনাথ সমাজপতি, ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তী, পেয়ারী মোহন মুখোপাধ্যায়, অম্বিকা চরণ মজুমদারের মতো নেতারা।
ভাইসরয় তাদেরকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেটি কোনো মুসলিম বিশ্ববিদ্যালয় হবে না, বরং সবার জন্য উন্মুক্ত সাধারণ একটি বিশ্ববিদ্যালয় হবে।
নাথান কমিটির তৎপরতা ও প্রতিষ্ঠার বাস্তবতা
১৯১২ সালের ৪ এপ্রিল প্রেরিত এক পত্রে ভারত সরকার কর্তৃক ঢাকায় একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সিদ্ধান্ত ভারত সচিব অনুমোদন করেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ভারত সরকার বঙ্গীয় সরকারকে সম্ভাব্য ব্যয়ের হিসাবসহ একটি পূর্ণাঙ্গ পরিকল্পনা পেশ করতে বলে।
ঢাকায় আবাসিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান হিসেবে একটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে ভারত সরকারের আগ্রহের কথা সরকারি সিদ্ধান্তে জোর দিয়ে বলা হয়। শহরের কলেজসমূহ কেন্দ্রীয় ধাঁচের এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধিভুক্ত থাকবে, কিন্তু শহরের বাইরের কলেজগুলি এর আওতাভুক্ত হবে না।
২৫টি বিশেষ সাব-কমিটির পরামর্শ নিয়ে ১৯১২ সালের হেমন্তে বঙ্গীয় সরকারের কাছে কমিটি তার রিপোর্ট দাখিল করে।রিপোর্টে অক্সফোর্ড এবং কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের আদলে ঢাকায় একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। নাথান কমিটির হিসেব অনুযায়ী, বিশ্ববিদ্যালয় নির্মাণের জন্য প্রায় ৫৩ লক্ষ টাকা এবং বাৎসরিক খরচ প্রায় ১২ লক্ষ টাকা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
কমিশন আরো সুপারিশ করে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হবে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারী চালিত এবং সরকারি অর্থায়নে পুষ্ট একটি রাষ্ট্রীয় বিশ্ববিদ্যালয়। গণশিক্ষা বিভাগের পরিচালক হবেন এর সরকারি পরিদর্শক; সমস্ত কলেজ ও সমস্ত বিভাগ পরিদর্শনের পূর্ণ ক্ষমতা তাঁর থাকবে।
রমনায় অবস্থিত পূর্ববঙ্গ ও আসাম সরকারের সিভিল স্টেশন সংলগ্ন ৪৫০ একর জায়গা নিয়ে পরিকল্পিত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাস স্থাপনের প্রস্তাব করে নাথান কমিটি। এই এলাকার মধ্যে ছিল ঢাকা কলেজ, গভর্নমেন্ট হাউজ, সেক্রেটারিয়েট, গভর্নমেন্ট প্রেস ভবনের মতো গুরুত্বপূর্ণ ভবন।
এ পরিকল্পনা থেকে বোঝা যায় যে, ঢাকায় আবাসিক ও শিক্ষাদান কার্যক্রম সম্বলিত একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হবে। কলেজ হবে এর একটি ইউনিট এবং তাতে শিক্ষা ও আবাসিক সুবিধাদি থাকবে। প্রতিটি কলেজে ছাত্রসংখ্যা ৬০০-এর মধ্যে সীমিত থাকবে। সাতটি কলেজ মিলে ২৮৯৯ জন ছাত্রের থাকা ও লেখাপড়ার সুযোগ থাকবে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ব্যতীত অন্য ছয়টি কলেজ হলো-
- ঢাকা কলেজ
- জগন্নাথ কলেজ
- মোহাম্যাডান কলেজ
- উইমেন্স কলেজ
- বিত্তবানদের জন্য টিচার্স কলেজ।
- ইসলামি শিক্ষার জন্য মোহাম্যাডান কলেজ
কলা ও বিজ্ঞান বিভাগে স্নাতকোত্তর শিক্ষাসহ বিজ্ঞান, ইঞ্জিনিয়ারিং, আইন ও চিকিৎসা বিভাগ খোলার সুপারিশ করেছিল নাথান কমিটি। নাথান কমিটির পরিকল্পনায় ইসলামি শিক্ষা বিভাগ একটি বিশেষ স্থান অধিকার করেছিল। এ বিভাগ পুনর্গঠিত মাদ্রাসা ছাত্রদের বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ের শিক্ষাদান করবে।
নাথান কমিটি ইতোমধ্যে স্থাপিত ইঞ্জিনিয়ারিং ও মেডিকেল স্কুলকে কলেজে উন্নীত করার প্রস্তাব করেছিল। এ দুটি কলেজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি বিভাগ। একইভাবে ইডেন গার্লস স্কুলকে কলেজে রূপান্তরিত করা হবে; অন্যদিকে টিচার্স ট্রেনিং কলেজ হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গ। স্কুল পরিদর্শন ও সেগুলিকে স্বীকৃতিদানের বিষয়টি হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের এখতিয়ারভুক্ত।
নাথান কমিটির সুপারিশ অনুযায়ী আচার্য, উপাচার্য, সমাবর্তন ও কাউন্সিল নিয়ে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ গঠিত হবে। বাংলার গভর্নর হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য। সরকার কর্তৃক উপাচার্য নিযুক্ত হবেন এবং তিনিই হবেন বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রধান নির্বাহী। বিশ সদস্যের একটি কাউন্সিল থাকবে; এতে চেয়ারম্যান হবেন উপাচার্য এবং এ কাউন্সিলই হবে বিশ্ববিদ্যালয়ের সর্বোচ্চ নির্বাহী সংস্থা।
তবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় অন্যতম বড় বাঁধা ছিলো কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধ। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় শুরু থেকেই ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়ের বিরোধিতা করে আসছিলেন। পরবর্তীকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. রমেশচন্দ্র মজুমদার তার ‘ঢাকার স্মৃতি’ নামক একটি প্রবন্ধে লিখেছিলেন,
“ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে বলেছিলেন, তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের ব্যাপারে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তিনি সরাসরি আশুতোষ বাবুর কাছে জানতে চেয়েছিলনে কীসের বিনিময়ে তিনি ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন। শেষ পর্যন্ত আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চারটি নতুন প্রফেসর পদ সৃষ্টির বিনিময়ে বিরোধের অবসান ঘটান।”
স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়কে নিয়েই গঠন করা হয়েছিল ‘কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় কমিশন’ বা ‘স্যাডলার কমিশন’। এই কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিভিন্ন আবাসিক হলকে বিশ্ববিদ্যালয়ের ইউনিট হিসেবে ধরা হয়। এছাড়াও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সম্পর্কে আরো তেরোটি সুপারিশ করে, যা কিছুটা রদবদল করে ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় আইন’ হিসেবে ১৯২০ সালে ভারতীয় আইনসভায় গৃহীত হয়, গভর্নর জেনারেল তাতে ১৯২০ সালের ২৩শে মার্চ সম্মতি দিয়েছিলেন।

১৯১৪ সালে প্রথম বিশ্বযুদ্ধ শুরু হওয়ায় এবং তার ফলে সরকারের ব্যয়-সংকোচনের কারণে নাথান কমিশনের রিপোর্ট বাস্তবায়ন অসম্ভব হয়ে পড়ে। অবশ্য পরবর্তীকালে একটি সংশোধিত পরিকল্পনা পেশ করা হয় এবং তা ভারত সরকার ও ভারত সচিব উভয়েরই অনুমোদন লাভ করে এবং ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপিত হয়।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমিজমা
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির ব্যাপারে একটি জনপ্রিয় ভুল ধারণা প্রচলিত আছে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জমির একটি বড় অংশই নাকি ঢাকার নবার পরিবারের দান করা। নবাব সলিমুল্লাহর নামটি জোরেশোরেই শোনা যায়। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ঘোষণা আসার পরেই নাকি তিনি ৬০০ একর জমি দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছিলেন।
কিন্তু কাগজে-কলমে সেই ধরনের কোনো হিসেব পাওয়া যায় না। বরং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শুরু হয়েছিল সরকারি খাস জমিতে। রাজধানীর অবকাঠামো গড়ে তোলার প্রয়োজনে যে ভবনগুলো নির্মিত হয়েছিল, সেগুলো বিশ্ববিদ্যালয়কে ব্যবহারের জন্য দেওয়া হয়। এই ভবনগুলোর জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফান্ড থেকে টাকাও কেটে রাখা হয়।
ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের জন্য ১৯১০ সাল থেকে বাজেটে আলাদা করে টাকা রাখা শুরু করে। ১৯২০-২১ এ এই টাকার পরিমাণ দাঁড়ায় ৬০ লক্ষ টাকা। সেই টাকার পুরোটা বিশ্ববিদ্যালয়ের কাছে আসেনি, ভবন বরাদ্দ দেওয়া বাবদ সেই টাকার বিপুল অংশ কেটে রাখা হয়।
আর রমনা এলাকায় যে জমিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গোড়াপত্তন তার পুরোটাই খাস জমি। সেটেলমেন্ট রিপোর্টের দলিল দস্তাবেজে তার প্রমাণ পাওয়া যায়। নবাব পরিবার নিজেই ছিলো ঋণের বোঝায় ক্লান্ত।
তবে ঢাকার অনেক ধনী ব্যক্তি সেই আমলে মারা যাওয়ার পরে তাদের সম্পত্তি নবাব পরিবারের নামে ওয়াকফ করে দিয়ে যেত। নবাব পরিবারের জমির অন্যতম উৎস ছিল এটি। তাই নবাব পরিবারের পক্ষে এই বিপুল পরিমাণ জমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে দান করে যাওয়া ছিল অসম্ভব ব্যাপার।
‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এবং পূর্ববঙ্গীয় সমাজ’ নামক বইয়ে দেওয়া এক প্রশ্নের উত্তরে জাতীয় অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টাকা এবং জমির উৎস সম্পর্কে বলেছিলেন,
“কোনো মুসলিম ধনীর কাছ থেকেই ঢাকা ইউনিভার্সিটি ডাইরেক্টলি কোনো ফাইনেন্সিয়াল কন্ট্রিবিউশন পায় নাই। সলিমুল্লাহ হল যে তৈরি হলো তা পুরোই সরকারের টাকায়।
… নওয়াব পরিবারের টাকায় নয়; নওয়াব পরিবারের জায়গাতেও নয়। রমনার যে জায়গায় ঢাকা ইউনিভার্সিটি এর পুরাই খাসমহল, সরকারের জমি। সেটলমেন্ট রিপোর্টে তা-ই আছে। … এটার ভেরিফিকেশন তো সোজা। যে কেউ ইন্টারেস্টেড, সে ঢাকা কালেক্টরেটে যেয়ে দেখে আসতে পার।”

প্রতিষ্ঠালগ্নে শিক্ষক হিসেবে প্রথিতযশা শিক্ষাবিদদের পেয়েছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়। পেয়েছে হরপ্রসাদ শাস্ত্রী, এফসি টার্নার, মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, জিএইচ ল্যাংলি, হরিদাস ভট্টাচার্য, ডব্লিউএ জেনকিন্স, রমেশচন্দ্র মজুমদার, স্যার এএফ রহমান, সত্যেন্দ্রনাথ বসু, নরেশচন্দ্র সেনগুপ্ত ও জ্ঞানচন্দ্র ঘোষের মতো শিক্ষক।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকালীন অস্থিরতা ও দেশভাগের কারণে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অগ্রযাত্রা কিছুটা ব্যাহত হয়। ১৯৪৭ সালে ভারত ও পাকিস্তান নামে দুটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠিত হলে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী ঢাকায় অবস্থিত প্রদেশের একমাত্র বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে কেন্দ্র করে আবার উজ্জীবিত হয় মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা। নতুন উদ্যমে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের কর্মকাণ্ড শুরু হয় তৎকালীন পূর্ব বাংলার ৫৫টি কলেজ এ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত হওয়ার সুযোগ লাভ করে। ১৯৪৭-৭১ সাল পর্যন্ত সময়ের মধ্যে পাঁচটি নতুন অনুষদ, ১৬টি নতুন বিভাগ ও চারটি ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠিত হয়।
তিনটি অনুষদ ও ১২টি বিভাগ নিয়ে একটি আবাসিক বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা শুরু হয়। কলা, বিজ্ঞান ও আইন অনুষদের অন্তর্ভুক্ত বিভাগগুলো ছিল— সংস্কৃত ও বাংলা, ইংরেজি, শিক্ষা, ইতিহাস, আরবি, ইসলামিক স্টাডিজ, ফারসি ও উর্দু, দর্শন, অর্থনীতি ও রাজনীতি, পদার্থবিদ্যা, রসায়ন, গণিত এবং আইন। তবে বর্তমানে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৩টি অনুষদ, ১৩টি ইনস্টিটিউট, ৮৪টি বিভাগ, ৬০টি ব্যুরো ও গবেষণা কেন্দ্র এবং ছাত্র-ছাত্রীদের ১৯টি আবাসিক হল, ৪টি হোস্টেল ও ১৩৮টি উপাদানকল্প কলেজ ও ইনস্টিটিউট রয়েছে। এ বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যয়নরত ছাত্র-ছাত্রীর সংখ্যা প্রায় ৪৬ হাজার ১৫০ জন। পাঠদান ও গবেষণায় নিয়োজিত রয়েছেন প্রায় ২ হাজার ৮ জন শিক্ষক।
শতবর্ষ পূর্তিতে প্রাচ্যের অক্সফোর্ড খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতি রইল আন্তরিক অভিনন্দন। জ্ঞান ও আলোর পথে ১০০ বছরের অভিযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় নতুন দিগন্ত তৈরি হোক।
সূত্রঃ রোর বাংলা, বাংলাপিডিয়া ও অনলাইন
আরো পড়ুন,
এপিএমও প্রতিযোগিতায় ১ম বারের মতো বাংলাদেশের স্বর্ণ জয়
ঢাবি’র শতবর্ষে থাকবে যেসব কর্মসূচি