“যদি আমি ভুল না করে থাকি, আমার এই উদ্ভাবন (প্লাস্টিক) ভবিষ্যতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ বলে প্রমাণিত হবে।”
লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড
একটি জার্নালে নিজের সদ্য উদ্ভাবিত একটি পদার্থ নিয়ে গর্ব করে এই কথাগুলো বলেছিলেন বেলজিয়ামের রসায়নবিদ লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ড। কিন্তু বিজ্ঞানী তো রক্তে-মাংসে গড়া মানুষ ছিলেন, তিনিই-বা কিভাবে জানতেন তার এই আবিষ্কার কালক্রমে সকলের দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠবে; ছড়িয়ে পড়বে স্থল থেকে মহাসাগরে, বাস্তুতন্ত্রের উপর ফেলবে এর বিরূপ প্রভাব।
১৯০৭ সালের ১১ জুলাই, বেলজিয়ামের রসায়নবিদ লিও হেনরিক বায়েকল্যান্ডের হাত ধরে পৃথিবীতে প্লাস্টিকের আগমন ঘটে। তার হাত ধরে মানব সভ্যতা প্রবেশ করে এক নতুন যুগে, যার নাম প্লাস্টিক যুগ।
বায়েকল্যান্ডের ধারণা ছিল, তার এই উদ্ভাবন মানুষের জন্য একসময় বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠবে। হ্যাঁ, হয়েছেও তাই। কালের পরিক্রমায় প্লাস্টিক পণ্য মানব সভ্যতার সাথে মিশে গেছে, হয়েছে মানব জীবনের নিত্য দিনের সঙ্গী। সময় পরিবর্তনের সাথে সাথে বিজ্ঞানের অগ্রগতিতে বায়েকল্যান্ডের তৈরি সিন্থেটিক প্লাস্টিকের বিবর্তন ঘটেছে, যে প্লাস্টিক পরিবেশে মেশে না, পৃথিবীতে থেকে যায় বহু বছর।
একটু খেয়াল করে দেখুন, প্রতিদিন বাজার থেকে যা কিনছেন তার সবই দেওয়া হচ্ছে কোন না কোন পলিথিন ব্যাগে, যার অধিকাংশই আর দ্বিতীয়বার ব্যবহার হচ্ছে না; তবে এসব প্লাস্টিক পণ্য পরবর্তীতে যাচ্ছে কোথায়? উত্তর হলো – বাজার থেকে বাসা, বাসা থেকে ডাস্টবিন, রাস্তা-ঘাট, জলাশয় কিংবা নদীতে। অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার অভাবে একবার ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিকের দূষণ পরিবেশে ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে।
সেদিনের সেই উদ্ভাবন আজ সকলের চিন্তার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু, আপনি জানেন কি – বিশ্ব বাঁচাতে প্লাস্টিক ব্যাগের জন্ম হয়েছিল? জ্বি, আপনি ঠিকই পড়েছেন, ভুল নয়। বিশ্ব বাঁচানোর মহান ব্রত নিয়ে ১৯৫৯ সালে সুইডেনে প্লাস্টিকের ব্যাগ আবিষ্কার করেন স্টেইন গুস্টাফ থুলিন।
সেকালে মানুষ অনেক বেশি কাগজের ব্যবহার করত। মানুষের চাহিদা পূরণের উদ্দেশ্যে, সেগুলো বানানোর জন্য অনেক গাছ কাটা হতো। প্রকৃতির ওপর চাপ কমাতে স্টেইন এমন একটি ব্যাগ তৈরি করেছিলেন, যা ছিল হালকা, টেকসই ও সহজলভ্য। তাই স্টেইন সবসময় একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ভাঁজ করে তার পকেটে বহন করতেন।
স্টেইন ভেবেছিলেন, মানুষ এগুলো বারবার ব্যবহার করবে, যে কারণে গাছ কম কাটা পড়বে এবং তা পরিবেশের জন্য মঙ্গলকর হবে। কিন্তু না, তেমনটা হয়নি। সময় যত গড়িয়েছে, মানুষ প্লাস্টিককে ধীরে ধীরে একবার ব্যবহারের পণ্যে পরিণত করেছে। এরপর থেকে মানুষ যত বেশি প্লাস্টিক ব্যবহার করতে শুরু করল, পরিবেশ দূষণ ততো বাড়ল। প্রতি বছর বিশ্বব্যাপী ৩০০ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের দ্রব্য উৎপাদিত হয়, যার ১০ শতাংশেরও কম পুনর্ব্যবহার করা হয়, বাকি ৯০ শতাংশের বেশি প্লাস্টিক, প্লাস্টিক বর্জ্যে পরিণত হয়।
প্লাস্টিক বর্জ্যগুলোর মধ্যে রয়েছে সিগারেটের বাট থেকে শুরু করে প্লাস্টিকের বোতল, বোতলের ক্যাপ থেকে শুরু করে খাবারের মোড়ক, পলিথিন ব্যাগ থেকে শুরু করে পলিইস্টাইরিনের পাত্র ইত্যাদি। এনভায়রনমেন্ট অ্যান্ড সোশাল ডেভেলপমেন্ট অর্গানাইজেশন-এর (ESDO) গবেষণা অনুযায়ী, বছরে শুধুমাত্র এধরনের প্লাস্টিকের বর্জ্য জমা হচ্ছে প্রায় ৮৭,০০০ টন।
জাতিসংঘের ২০১৫ সালের এক সমীক্ষা অনুযায়ী, প্রতি বছর সমুদ্রে গিয়ে পড়ছে অন্তত ৮০,০০,০০০ মেট্রিক টন প্লাস্টিক; যার ৬৭ ভাগ বর্জ্য পদার্থই নদীর মাধ্যমে এশিয়ার দেশগুলো থেকে সাগরে যাচ্ছে। সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্য পরিবহন করা শীর্ষ নদীগুলোর মধ্যে ২০টি নদীই এশিয়ার।
সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণের তালিকায় শীর্ষ স্থান লাভ করা দেশগুলোর মধ্যে শীর্ষ স্থানে রয়েছে এশিয়ার দেশ চীন, ইন্দোনেশিয়া, ফিলিপাইন, ভিয়েতনাম ও থাইল্যান্ডের এর নাম। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ বাংলাদেশ রয়েছে দশম স্থানে।

প্লাস্টিক কোন পচনশীল পদার্থ নয়। তাই স্থলের ন্যায় জলও প্লাস্টিকের কোন ক্ষতি করতে পারেনা। কিন্তু সমুদ্রে জলের লবণাক্ততা, সূর্যের আলো ও উত্তাপ সহ আরো বহুবিধ কারণে প্লাস্টিক বর্জ্য ভেঙে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণায় পরিণত হয়। এই প্রক্রিয়াকে বলা হয় ‘আলোকবিশ্লেষণ’। আবার কিছু প্লাস্টিক সামুদ্রিক স্রোতে পড়ে অনবরত ঘুরপাক খেতে থাকে। এরকম স্রোতে পড়লে, প্লাস্টিক ভেঙ্গে টুকরো টুকরো হয়ে ‘মাইক্রোপ্লাস্টিক ও ন্যানোপ্লাস্টিক কণা’য় পরিণত হয়। এই মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা বাস্তুতন্ত্রের জন্য বেশি ক্ষতিকর।

এসব প্লাস্টিকের বর্জ্য সমুদ্রে জমে তৈরি করেছে এক একটি বৃহদাকার প্লাস্টিক দ্বীপ বা আবর্জনার আস্তাকুঁড়। বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিকের বর্জ্য একত্রিত হয়ে সমুদ্রে প্লাস্টিকের আস্তাঁকুড় বা দ্বীপের সৃষ্টি হয়েছে বলে একে বলা হয় ‘গার্বেজ প্যাচ’। গার্বেজ অর্থ ‘আবর্জনা’, আর প্যাচ অর্থ ‘একত্রিত একটি স্থান’। বিশ্বের মহাসাগর গুলোতে এমন অনেকগুলো প্যাচের অস্তিত্ব রয়েছে।
ধারণা করা হয়, উত্তর ও দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগর, উত্তর ও দক্ষিণ আটলান্টিক মহাসাগর এবং ভারত মহাসাগরে বৃহদাকার ৫টি প্যাচ রয়েছে। মহাসাগর গুলোতে আবিষ্কৃত এই পাঁচটি প্যাচের মধ্যে সর্ববৃহৎ প্যাচটির নাম ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ’ (The Great Pacific Garbage Patch)।
দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ
ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র বালুকণা, বিন্দু বিন্দু জল গড়ে তোলে মহাদেশ, সাগর অতল। তবে মহাদেশ গড়তে না পারলেও ধীরে ধীরে প্লাস্টিক জমে দক্ষিণ প্রশান্ত মহাসাগরের বুকে তৈরি হয়েছে ‘দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচ’ নামক সর্ববৃহৎ আবর্জনার আস্তাঁকুড়। এই প্যাচটির অবস্থান হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জ এবং ক্যালিফোর্নিয়ার মধ্যবর্তী উত্তর-মধ্য প্রশান্ত মহাসাগরে।
আয়তনে কত বড় এই প্লাস্টিকের তৈরি দ্বীপ? ধারণা করা হয়, এটির আয়তন প্রায় ১.৬ মিলিয়ন বর্গ কিলোমটার, যা কিনা আয়তনে গ্রীনল্যান্ডের থেকেও বড়! এমনকি আয়তনের দিক থেকে প্লাস্টিক দ্বীপটি টেক্সাস স্টেটের দ্বিগুণ এবং ফ্রান্সের প্রায় তিন গুণ!

সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রায় ১ মিলিয়ন বর্গ কিলোমিটার এলাকা জুড়ে বিস্তৃত অঞ্চলটি বাইরে থেকে ৩.৫ মিটার বর্গ কিলোমিটার পরিধি দ্বারা বেষ্টিত। ২০০৬ সালে দ্য ইউনাইটেড নেশনস এনভায়রনমেন্ট প্রোগ্রামের এক প্রতিবেদন বলা হয়, এই অঞ্চলের প্রতি বর্গমাইলে প্রায় ৪৬,০০০ ভাসমান প্লাস্টিকের টুকরোর উপস্থিতি রয়েছে।
এই অঞ্চলটির কেন্দ্রের উচ্চ ঘনত্বযুক্ত প্লাস্টিক যুক্ত এলাকার প্রতি বর্গ কিলোমিটারে ১ মিলিয়ন টুকরো প্লাস্টিকের অস্তিত্ব রয়েছে বলে ধারণা করা হয়। দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গারবেজ প্যাচের ৮৪ শতাংশ প্লাস্টিকই বিষাক্ত কেমিকেল বহন করে।
কিন্তু এত বিপুল পরিমাণ প্লাস্টিক বর্জ্যের উৎস কি? আলগালিতা মেরিন রিসার্চ ইনস্টিটিউটের একদল গবেষকের করা গবেষণা বলছে, সমুদ্র নয় বরং জমি থেকে আগত ৮০ শতাংশ প্লাস্টিক পদার্থের দখলে এই অঞ্চল। বাকি ২০ শতাংশ বর্জ্য সমুদ্রগামী জাহাজগুলো থেকে আসে।
এক গবেষণায় বলা হয়, প্রতি এক দশকে এর আয়তন ১০ গুণ করে বাড়ছে। ক্যালিফোর্নিয়ার সান দিয়েগো বিশ্ববিদ্যালয়ের স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশন অফ ওশেনোগ্রাফি দ্বারা পরিচালিত এক গবেষণা অনুসারে, গত ৪০ বছরে এই প্যাচটিতে প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষের পরিমাণ ১০০ গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
এই তো গেলো মাত্র একটি প্লাস্টিক দ্বীপের কথা। দ্য গ্রেট প্যাসিফিক গার্বেজ প্যাচের ন্যায় আরো ৪টি প্যাচ রয়েছে, ক্রমাগত প্লাস্টিক বর্জ্য বৃদ্ধির কারণে আর্কটিক মহাসাগরে এধরনের আরেকটি প্যাচ সৃষ্টির সম্ভাবনা তৈরি হয়েছে।
পৃথিবীর গভীরতম বিন্দু মারিয়ানা ট্রেঞ্চে প্লাস্টিক দূষণ
শুধুই কি জলে আর স্থলে? প্লাস্টিকের বিচরণ আজ সর্বত্র। শুধুমাত্র সাগরের উপরিভাগ নয়, প্লাস্টিক দূষণ পৌঁছে গেছে সাগরের গভীর তলদেশেও। জানা গেছে, মানুষের আবিষ্কৃত পৃথিবীর গভীরতম সামুদ্রিক খাত মারিয়ানা ট্রেঞ্চেও মিলেছে প্লাস্টিকের উপস্থিতি।
যুক্তরাষ্টের অভিযাত্রী ভিক্টর ভেস্কো ৩৫,৮৫৩ ফুট গভীরে চ্যালেঞ্জার দ্বীপের তলদেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের সন্ধান পেয়েছেন, যার মধ্যে রয়েছে একটি প্লাস্টিকের ব্যাগ ও একটি ক্যান্ডির মোড়ক। এটি প্রশান্ত মহাসাগরের মারিয়ানা ট্রেঞ্চের দক্ষিণ প্রান্তের শেষ অংশ। সাগরের গভীর তলদেশে প্লাস্টিক বর্জ্যের উপস্থিতি অবশ্যই পরিবেশের জন্য ভালো বার্তা নয়, বরং সাগরে প্লাস্টিক দূষণের গভীরতাকেই নির্দেশ করে।
এখন সমুদ্রে ডুব দিলে শুধু মনোমুগ্ধকর প্রকৃতি নয়, প্রকৃতির সাথে দেখা মেলে প্লাস্টিক বর্জ্যের। এগুলো সমুদ্র তলে জমে এর বাস্তুসংস্থানকে মারাত্মকভাবে প্রভাবিত করছে।
সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে প্লাস্টিক দূষণের প্রভাব
একটিবার ভেবে দেখুন তো, ক্ষুধা নিবারণের জন্য যে খাদ্য আপনি গ্রহণ করলেন তা পরিপাক নালীর সাথে পেঁচিয়ে পরিপাকনালী প্রায় রুদ্ধ করে দিল! কেমন হবে, জীবন বাঁচাতে খাওয়া খাদ্যই যদি অনাহার বা অঙ্গহানিতে মৃত্যুর কারণ হয়? কিংবা কোন আস্ত প্লাস্টিকের ব্যাগে আটকে দম বন্ধ হয়ে মারা যান? কি, এমন মৃত্যুর কথা শুনে হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, তাই তো? যা চিন্তা করতেই হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসছে, তবে তা রীতিমতো কেন করে চলেছি সমুদ্রের নিরীহ প্রাণীদের সাথে!
প্রতি বছর হাজার হাজার সামুদ্রিক পাখি এবং অন্যান্য সামুদ্রিক জলজ প্রাণীর মৃত্যুর কারণ হলো প্লাস্টিক। গবেষণায় দেখা গেছে যে, প্রতি বছর প্রায় ৭০০ প্রজাতির সামুদ্রিক প্রাণী বিভিন্ন প্রকারের বর্জ্য পদার্থের সংস্পর্শে আসে, যেগুলোর মধ্যে শতকরা ৯২ ভাগই প্লাস্টিক। ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ ন্যাচার (IUCN) বলছে, প্লাস্টিকের প্রত্যক্ষ সংস্পর্শে আসা প্রাণীগুলোর শতকরা ১৭টি প্রজাতি হয়তো প্লাস্টিক সেবন করে কিংবা প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষে জড়িয়ে পড়ে মারা যাওয়ার কারণে আজ বিলুপ্তির পথে।

বিভিন্ন সামুদ্রিক প্রাণী যে প্লাস্টিক খাচ্ছে তার বহু প্রমাণ ইতিমধ্যে পাওয়া গেছে। এই তালিকায় অতি ক্ষুদ্র প্ল্যাংকটন থেকে শুরু করে অতিকায় প্রাণী তিমির নামও শামিল রয়েছে।
সাগরের প্রায় ৯% মাছের পেটে প্লাস্টিকের ধ্বংসাবশেষের উপস্থিতি পাওয়া গেছে। এছাড়াও প্রশান্ত মহাসাগরীয় আবর্জনা প্যাচ দ্বারা প্রভাবিত অঞ্চলে পাওয়া মাছগুলো প্রতি বছর প্রায় ১২,০০০ থেকে ২৪,০০০ টন প্লাস্টিক গ্রহণ করে, স্ক্রিপস ইনস্টিটিউশনের করা এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে।
এখন কথা হচ্ছে, সামুদ্রিক প্রাণীগুলো ক্রমাগত প্লাস্টিক সেবন করছে, কিন্ত কেনো? প্লাস্টিক তো দেখতে খাবারের মতো নয় কিংবা এর তো কোনো গন্ধও নেই! প্রচলিত এই মতবাদের সাথে দ্বিমত পোষণ করেছেন নেদারল্যান্ডসের রয়্যাল ইনস্টিটিউট ফর সি রিসার্চের বিজ্ঞানী এরিক জেটলার। তিনি বলেছেন,
“এর পরের বার যখন সমুদ্র সৈকতে যাবেন, তখন এক টুকরো প্লাস্টিক কুড়িয়ে নিয়ে সেটার গন্ধ শুঁকে দেখবেন। মেছো একটা গন্ধ পাবেন।”
জেটলার তার ব্যাখ্যা দিয়েছেন এভাবে, সমুদ্রে ফেলে দেওয়া সব প্লাস্টিকের উপর এক ধরনের মাইক্রোব বা ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জীবাণুর পিচ্ছিল ও জীবন্ত আস্তরণ পড়ে। বৈজ্ঞানিক পরিভাষায় একে বলে ‘প্লাস্টিস্ফেয়ার’। এই পিচ্ছিল জীবন্ত আস্তরণ থেকে যখন রাসায়নিক নির্গত হয়, তখন অনেকটা খাদ্যের মতোই গন্ধ বের হয় এবং এর স্বাদও হয় সেরকম। আসলে এই রাসায়নিকের জন্যই সামুদ্রিক প্রাণীরা প্লাস্টিককে লোভনীয় খাদ্য ভেবে ভুল করে।
অন্যদিকে সাগরে সূর্যের উত্তাপ, সামুদ্রিক স্রোত এবং সামুদ্রিক নোনা পরিবেশসহ নানা কারণে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র কণায় পরিণত হওয়া প্লাংকটন আকারের মাইক্রোপ্লাস্টিক খুব সহজেই মাছেদের পেটে চলে যায়। সামুদ্রিক মাছেদের শরীরে জৈবসঞ্চিতির দরুন প্লাস্টিকের কণা ও এর থেকে সৃষ্ট রাসায়নিক পদার্থ জমা থেকে যায়।
প্লাস্টিকের কারণে সামুদ্রিক প্রাণীদের পরিপাক ও প্রজননের মতো গুরত্বপূর্ণ কাজও বাধাগ্রস্থ হতে পারে। রসকাইলড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানী ক্রিস্টিয়ান সাইবার্গ সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর কারণ নিয়ে গবেষণা করেছেন। তিনি প্লাস্টিক বর্জ্যের কারণে সামুদ্রিক প্রাণীদের জীবন নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছিলেন। তাঁর মতে, প্লাস্টিক সেবনের কারণে সামুদ্রিক প্রাণী শ্বাসরুদ্ধ হয়ে বা খাদ্যাভাবে মারা যেতে পারে। কারণ, এগুলো এদের পরিপাকনালী প্রায় রুদ্ধ করে দেয়।
শুধুমাত্র প্লাস্টিক দূষণের শিকার হয়ে প্রতি বছর প্রায় ১০০ মিলিয়ন সামুদ্রিক স্তন্যপায়ী প্রাণী মারা যাচ্ছে। এছাড়াও প্রতি বছর ৮৪ শতাংশ সামুদ্রিক কচ্ছপ, ৪৪ শতাংশ সামুদ্রিক পাখি ও ৪৩ শতাংশ অন্যান্য সামুদ্রিক প্রাণীর মৃত্যুর কারণ প্লাস্টিক।

যেসব সামুদ্রিক জলজ প্রাণী সমুদ্রের উপরিভাগের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র প্লাংকটন ভক্ষণ করে, তারা খাবার গ্রহণের সময় প্লাস্টিক গিলে ফেলে। কিছু কিছু জলজ প্রাণী, যেমন: সামুদ্রিক কচ্ছপদের বেশিরভাগই প্লাস্টিক ব্যাগ ও জেলিফিশের মধ্যে পার্থক্য করতে পারেনা। তাই এগুলো প্রায়শই জেলিফিশের পরিবর্তে প্লাস্টিক গিলে ফেলে।

আবার কিছু কিছু জলজ প্রাণী, যেমন: তিমি সরাসরি প্লাস্টিক সেবন করে না, তবে এরা যখন প্ল্যাংকটন খাওয়ার জন্য পানি ছাঁকে, তখন প্লাংকটনের সঙ্গে প্লাস্টিকও এদের পরিপাকনালীতে চলে যায়।
শুধুমাত্র সামুদ্রিক জলজ প্রাণীই নয়, প্লাস্টিকের কারণে ভুক্তভোগীদের খাতায় নাম রয়েছে এই অঞ্চলে বসবাসকারী বিভিন্ন পাখির। অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানীদের মতে, উপকূল অঞ্চলে বসবাসকারী ১০ টি’র মধ্যে ৯টি পাখির পাকস্থলীতে প্লাস্টিকের উপস্থিতি রয়েছে। কোন কোন পাখির মৃতদেহ বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, এদের পাকস্থলীর ৮০ শতাংশ জায়গা প্লাস্টিক কণা দখল করে আছে, যেগুলো কখনও হজম হয়নি।
আলবাট্রস নামের এক প্রকার সামুদ্রিক পাখি সমুদ্রে ভাসমান রেজিন কণাকে মাছের ডিম মনে করে বাচ্চাদের খাওয়ানোর জন্য বাসায় নিয়ে যায়। যার ফলস্বরূপ অনাহার বা অঙ্গহানির কারণে এরা করুণ মৃত্যুর দিকে পতিত হয়।
প্লাস্টিকের ব্যাগ, বোতল, বোতলের ছিপি বা অন্য কোনও আবর্জনার মতো, মাছ ধরার জন্য ব্যবহৃত পরিত্যাক্ত প্লাস্টিকের জাল অসংখ্য সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন কেড়ে নেয়। এই জালগুলোকে বলা হয় ‘গৌস্ট নেটস’ (Ghost Nets)। আর এই জালগুলোতে কোনো সামুদ্রিক প্রাণী আটকে পরার পুরো ঘটনাকে ‘গৌস্ট ফিশিং’ (Ghost Fishing) বলে উল্লেখ করা হয়। এই গৌস্ট নেটস-এর সবচেয়ে বড় শিকার হলো সামুদ্রিক জলজ প্রাণী কচ্ছপ।

শুধুই যে কম গভীর জলের প্রাণী বা উপকূলের প্রাণীরা প্লাস্টিক দূষণের শিকার হচ্ছে, তা কিন্তু নয়। স্কটিশ এসোসিয়েশন ফর মেরিন সায়েন্সের তাদের করা একটি গবেষণায় প্রকাশ করেছে যে, সমুদ্রের প্রায় ২,০০০ ফুট গভীরতায় প্রাপ্ত প্রাণীদের পেটে প্লাস্টিকের অস্তিত্ব পাওয়া গেছে। এই প্লাস্টিকের একটা বড় অংশজুড়ে রয়েছে পলিথিন ও পলিস্টার।
শুধু কি সামুদ্রিক প্রাণীর জীবন নিয়েই ক্ষান্ত হয়েছে প্লাস্টিক? প্লাস্টিকের দীর্ঘ মেয়াদী প্রভাব বিস্তার করছে সমুদ্রের বাস্তুতন্ত্রে। প্লাস্টিকের আস্তরণের কারণে সমুদ্রে খাদ্যশৃঙ্খলের প্রাথমিক খাদ্য উৎপাদন হিসেবে বিবেচিত প্লাংকটন এবং সামুদ্রিক শৈবালের জন্ম ও বৃদ্ধিতে বাঁধা সৃষ্টি হচ্ছে। কারণ, জলরাশির উপরিভাগের প্লাস্টিকের তৈরি আস্তরণ ভেদ করে সূর্যের আলো পানির নিচে পৌঁছাতে পারে না। যার কারণে জলজ প্রাণী জুপ্লাংকটন ও জলজ উদ্ভিদ ফাইটোপ্লাংকটনের পরিমাণ ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে।
একদিকে যেমন সমুদ্রে ক্রমশ প্লাংকটনের পরিমাণ কমে যাচ্ছে, তেমন অন্যদিকে প্লাংকটন ও প্রবালকীট মাইক্রোপ্লাস্টিক কণাকে খাদ্য হিসেবে গ্রহণ করছে। সমুদ্রের প্লাস্টিক দূষণ এমন পর্যায়ে পৌঁছে গেছে যে, সমুদ্রে প্রতি ১ পাউন্ড প্লাংকটনের বিপরীতে ৬ পাউন্ড প্লাস্টিক বিদ্যমান। ক্রমবর্ধমান হারে সামুদ্রিক প্রাণীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে প্লাস্টিক বর্জ্য গ্রহণ ও মৃত্যুর দরুন খাদ্যশৃঙ্খলে আসতে পারে নানাবিধ পরিবর্তন।
সামুদ্রিক বাস্তুতন্ত্রের পরিবর্তন কেবল সামুদ্রিক পরিবেশের ক্ষতি করবে না, বরং এই পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব পরবে মানব জীবনের উপর। কারণ, মানুষ যখন এমন একটি মাছ খাদ্য হিসাবে গ্রহণ করবেন, যে মাছটি নিজেই প্লাস্টিক খেয়েছে বা পরোক্ষভাবে মাইক্রোপ্লাস্টিক খেয়েছে, তখন মাছের শরীরের ক্ষতিকর রাসায়নিক পদার্থ খাবারের মাধ্যমে মানব শরীরেও প্রবেশ করবে।
খাদ্যচক্রে প্লাস্টিকের প্রবেশ নিয়ে শঙ্কা প্রকাশ করে ডাঃ ব্র্যান্ডন বলেছেন,
“আপনি যে বড় মাছটি খাবেন, সেই মাছটি নিজেই প্লাস্টিক বা হাজার হাজার ছোট্ট মাছ খাচ্ছে, যেগুলো আবার হাজার হাজার প্লাংকটন খাচ্ছে, যা হাজার হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক খাচ্ছে।”
আধুনিকতার নামে এ কোন পথে হেঁটে চলেছি আমরা? যে ক্ষতি আমরা প্রতিনিয়ত পরিবেশের করছি, তা কোন না কোন ভাবে বুমেরাং হয়ে আমাদের নিকট ফিরে আসছে।
২০১৯ সালের জুনে প্রকাশিত একটি গবেষণার পর্যালোচনাতে বলা হয়েছে যে, কেবল খাদ্য, পানীয় এবং শ্বাস-প্রশ্বাসের মাধ্যমে আমেরিকানরা প্রতি বছর কমপক্ষে ৭৪,০০০ মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা নিজেদের অজান্তেই খাদ্যের সাথে গ্রহণ করছে। ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড (World Wildlife Fund) দ্বারা পরিচালিত অস্ট্রেলিয়ার নিউক্যাসল বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষকদের করা অন্য একটি গবেষণায় দেখা গেছে যে, আমরা মানুষেরা প্রতি সপ্তাহে গড়ে ৫০০ গ্রাম প্লাস্টিক খাচ্ছি। শুনতে অবিশ্বাস্য লাগলেও, এর পরিমাণ প্রায় একটি ক্রেডিট কার্ডের সমতুল্য। প্লাস্টিক মানব শরীরে ক্যান্সার, কিডনি, এ্যাজমা জনিত বহু রোগ সৃষ্টিতে সক্ষম। এভাবে প্লাস্টিক খাদ্যচক্রে প্রবেশের মাধ্যমে প্রতিনিয়ত আমরা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছি।

সবশেষে, সাগরে প্লাস্টিক দূষণের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও কি নেহাত কম হবে? মোটেই না, বরং এর অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণও হবে ব্যাপক। ভেবে দেখুন তো, উপকূলীয় অঞ্চল গুলোর চারদিকে যদি প্লাস্টিকের বর্জ্য ভেসে বেড়ায়, তবে কি পর্যটকদের ভ্রমণ কমে যাবে না, এতে কি পর্যটন খাতের ক্ষতি হবে না? অন্যদিকে সামুদ্রিক মাছ শিকার করে যারা জীবিকা নির্বাহ করতো, তারাও তো প্রত্যক্ষভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
সাগরে প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্রচলিত পদ্ধতির কার্যকারিতা কতটুকু?
বিশ্বের সমুদ্রগুলোকে প্লাস্টিকমুক্ত করার উদ্দেশ্যে প্রায়ই চালানো হয় বিভিন্ন পরিচ্ছন্নতা অভিযান। এক ঘোষণায় বলা হয়েছে, ২০২০ সালের মধ্যে প্লাস্টিক মুক্ত হবে প্রশান্ত মহাসাগর। সেই উদ্দেশ্যে ‘দ্য ওসান ক্লিন-আপ’ নামের একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার উদ্যোগে শুরু হয়েছে এই কাজ। এখন পর্যন্ত প্রায় ৯ মিলিয়ন টন প্লাস্টিকের বর্জ্য সমুদ্র থেকে অপসারণ সম্ভব হয়েছে। বলা হচ্ছে, সাগর থেকে প্লাস্টিক অপসারণে সময় লাগতে পারে প্রায় দুই থেকে তিন মাস।
সমুদ্রের প্লাস্টিকের একটি বড় অংশজুড়ে রয়েছে মাইক্রোপ্লাস্টিক কণা। এসব কণার মধ্যে কিছু পানির উপরে ভেসে থাকে, কিছু আবার ভেসে থাকে পানির উপরিতল থেকে কয়েক সেন্টিমিটার নিচে এবং এর অল্প পরিমাণ চলে যায় সাগরের গভীর তলদেশে। তাই এসব ক্ষুদ্র প্লাস্টিক কণা অপসারণ সবচেয়ে বেশি দুরূহ ব্যাপার।
সাগরের প্লাস্টিক অপসারণ করা হচ্ছে, কিন্তু চিন্তার বিষয় সমুদ্রে প্লাস্টিকের প্রবেশ বন্ধ করা যাচ্ছে না, প্রতিনিয়ত সাগরে প্লাস্টিক বর্জ্যের পরিমাণ বাড়ছে। তাহলে সাগর প্লাস্টিক মুক্ত হবে কিভাবে!

অস্টেলিয়া গ্রিফফিথ বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষক এম্যান্ডা ডসন সমুদ্র তলদেশে জমে থাকা প্লাস্টিক এবং মাইক্রোবিডস নিয়ে গবেষণা করতে এত নিরাশার মধ্যে আশাজনক কিছুর সন্ধান পেয়েছেন। তিনি বার্তাসংস্থা এএফপি-কে জানান, চিংড়ি জাতীয় এক প্রকারের জুপ্লাংকটন ‘ক্রিল’ প্লাস্টিক বর্জ্য ৭৪ শতাংশ এবং কিছু ক্ষেত্রে প্রায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত মিশিয়ে ফেলতে পারে। এটি প্লাস্টিকের বিরুদ্ধে করা এই যুদ্ধে ভালো সেনানী হাতে পারে। কিন্তু অনেকের মতে, কোন খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে এভাবে প্লাস্টিকের প্রবেশ নতুন ভয়ের কারণ হতে পারে।
দেশগুলো প্লাস্টিক দূষণ রোধে তেমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারেনি। অন্যদিকে সাধারণ মানুষের মধ্যে সচেতনতা ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার অভাব থাকায় তারা ব্যবহার করা প্লাস্টিক সামগ্রী যেখানে-সেখানে ফেলে দিচ্ছে। যেহেতু প্লাস্টিকের সামগ্রী মাটিতে মিশে যায় না, তাই এই প্লাস্টিক বর্জ্য পদার্থ হিসেবে জমা হচ্ছে লোকালয়, নদী ও সাগরে।
অনেকেই আবার সচেতনতার অভাবে প্লাস্টিকসামগ্রী পুড়িয়ে ফেলছেন। এতে আরো বিপদ! কারণ, তখন হাইড্রোকার্বন হয়ে বাতাসে মিশে তা দূষণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দিচ্ছে। সচেতনতা বৃদ্ধির নানা প্রয়াস চালানো হচ্ছে, তবে কমছে না প্লাস্টিকের ব্যবহার।
অনেক দেশে প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার হ্রাসের উদ্দেশ্যে প্লাস্টিকের ব্যাগ ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। বাংলাদেশ প্লাস্টিকের ব্যাগের ব্যবহার নিষিদ্ধ করা বিশ্বের প্রথম দেশ। ২০০২ সালের জানুয়ারি থেকে এর উৎপাদন, পরিবহন, মজুদ ও ব্যবহারকে আইন করে নিষিদ্ধ করা হয়ছে। শুরুর দিকে বেশ কড়াকড়ি হলেও বাংলাদেশে যে এটি নিষিদ্ধ তা দেখে বোঝার কোন উপায় নেই, চারদিকে প্লাস্টিক ব্যাগের ছড়াছড়ি।
এই সমস্যা থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসেবে অনেকে প্লাস্টিকের বিকল্প কিছু চিন্তা করছেন। অনেকেই প্লাস্টিকের ব্যাগের পরিবর্তে সুতা কিংবা কাগজের ব্যাগ ব্যবহার শুরু করেছেন, তবে এক্ষেত্রেও রয়েছে বিতর্ক। বিশেষজ্ঞদের মতে,
কাগজ দিয়ে ব্যাগ তৈরিতে অনেক শক্তি দরকার হয়, উৎপাদনে অনেক বেশি পানি লাগে, উৎপাদন খরচও পড়ে বেশি এবং সেগুলো অনেক ভারীও বটে। অন্যদিকে সুতার তৈরি ব্যাগ আরো খারাপ। কারণ, এই ব্যাগ তৈরিতে আরো বেশি পানি খরচ ও অপচয় হয়। আর এটি উৎপাদনে ব্যবহৃত ফসল উৎপাদনেও নিবিড় পরিচর্চার দরকার হয়, যা এর উৎপাদন খরচ বহুগুণে বাড়িয়ে দেয়।
প্লাস্টিকের বিকল্পের কথা চিন্তা করে কাগজের ও সুতার তৈরি ব্যাগ সরবরাহের ক্ষেত্রে আবার পরিবেশের ওপর অতিরিক্ত চাপ তৈরি হচ্ছে। তাহলে আমরা কি করবো?
এ দূষণ রোধে আমাদের করণীয় কি?
বিশেষজ্ঞরা দেশগুলোর অনিয়ন্ত্রিত প্লাস্টিকের ব্যবহার ও বর্জ্য নিষ্কাশনের অব্যবস্থাপনাকেই এই বিপর্যয়ের জন্য দায়ী করছেন। যেহেতু এই দেশগুলোর বেশিরভাগ এশিয়ার, তাই বেশিরভাগ দেশ গ্রেট প্যাসিফিকের আবর্জনা প্যাচের কাছাকাছি রয়েছে। এই দূষণের জন্য কোন একক দেশ দায়ী নয়, তাই এককভাবে এই দূষণের দায়ভার কেউ নিতে প্রস্তুত নয়। এক্ষেত্রে, সমুদ্রে প্লাস্টিক দূষণ রোধে প্রয়োজন সকলের সম্মিলিত প্রয়াস।
সর্বপ্রথম, প্লাস্টিকের তৈরি সামগ্রী আমাদের পরিবেশের কতটা ক্ষতি করে চলেছে এবং পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষায় এসবের রিসাইক্লিং বা পুনর্ব্যবহার কতটা জরুরি, সে ব্যাপারে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে হবে। বস্তুত, সচেতনতা বৃদ্ধি ব্যতীত প্লাস্টিকের অনিয়ন্ত্রিত ব্যবহার ও যত্র-তত্র নিক্ষেপ হ্রাস করা সম্ভব নয়।

বিভিন্ন গবেষণায় ৪টি উপায় অবলম্বন করে এ দূষণের মাত্রা কমিয়ে আনার কথা বলা হয়েছে। সেগুলো হলো –
১. প্লাস্টিক পণ্যের ব্যবহার হ্রাস করা।
২. আপনার ব্যবহৃত প্লাস্টিক পণ্য আবার ব্যবহার করা।
৩. একবার ব্যবহারের পরিবর্তে পুনরায় ব্যবহারযোগ্য প্লাস্টিক ব্যবহার এবং প্রয়োজন হলে আবার মেরামত করে ব্যবহার করা।
৪. যখন আর ব্যবহার করা যাবে না, তখন পুনর্ব্যবহার উপযোগী করা।
উপরের প্রতিটি উপায় অনুসরণ করে প্লাস্টিকের ব্যবহার কমিয়ে আনা যাবে বলে আশা করা যায়। আর যদি এমনটা করা সম্ভব না হয়, আগামীতে কোন পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তা তো আন্দাজ করাই যাচ্ছে! জাতিসংঘের এক প্রতিবেদনে সতর্ক করে বলা হয়েছে,
২০২৫ সালের মধ্যে প্রতি ৩ টন মাছের বিপরীতে সমুদ্রে ১ টন প্লাস্টিক এবং ২০৫০ সালের মধ্যে, ওজনের দিক থেকে প্লাস্টিকের সংখ্যা মাছের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
এখন আমরা অনেকেই হয়তো ভাবছি, সাগরে প্লাস্টিক দূষণ হলে আমার কি, আমি বেঁচে থাকতে তো আর কিছু হবে না? সেই ধারণাও ভুল, বর্তমান পৃথিবীর প্রায় অর্ধেক মানুষের, তাদের জীবন দশায় প্লাস্টিক দূষণের ভয়াবহ রূপ প্রত্যক্ষ করার সম্ভাবনাই বেশি। আর আপনি নিজে এই বাজে পরিস্থিতির সম্মুখীন না হলেও, আপনার পরবর্তী প্রজন্ম এর সম্মুখীন হবে, সমস্ত সাগরের প্রাণীকুল মরে যাওয়া তখন হয়ে দাড়াবে, শুধুমাত্র সময়ের ব্যাপার!
আরো পড়ুন,
পরিবেশ রক্ষায় পলিথিন ও প্লাস্টিক পণ্য রাষ্ট্রীয়ভাবে নিষিদ্ধ করা উচিত : রাষ্ট্রপতি
আপনার মতামত দিন