“কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা মনে মনে।”
– কবিগুরু মনে মনে হারিয়ে যাওয়ার এই যে বাসনা করেছিলেন, সেজন্য দরকার প্রচণ্ড কল্পনাপ্রবণ চিত্তচঞ্চল এক মন। আর মনের এই কল্পনালোককে জাগিয়ে তোলার ক্ষেত্রে সবথেকে বেশি কার্যকর মাধ্যম হলো বই। তবে এ বই সিলেবাসের ধরাবাঁধা পাঠ্যপুস্তক নয়, বরং পাঠ্যপুস্তকের বাইরে জ্ঞানের যে মহাসমুদ্র অবিরত মানবসভ্যতাকে আহ্বান জানাচ্ছে তার জ্ঞানসমুদ্রের অতল গহ্বরে ঝাঁপিয়ে পড়ার, এ হলো সেই অমূল্য রত্নভাণ্ডার। এই রত্নভাণ্ডারের সন্ধান যে পেয়েছে এবং তার পরিপূর্ণ স্বাদ নিতে পেরেছে, জীবনবোধ ও জীবনের আনন্দ কখনোই তাকে ছেড়ে যেতে পারে না।
মানবজাতির জ্ঞানের সোপান
অজানাকে জানার, রহস্যকে ভেদ করার, নতুন কিছুকে আবিষ্কার করার প্রবণতা মানুষের মজ্জাগত। সৃষ্টির শুরু থেকে এখনও অবধি যত মানুষ পৃথিবীতে এসেছে, তারা সকলেই স্বভাবসুলভ কৌতুহলী হয়েই এই গ্রহের বুকে পদচারণা করেছে। মানুষের এই কৌতুহলই তাকে জ্ঞানার্জনে নিবিষ্ট করেছে। মানুষ তার চারপাশের পরিবেশকে, প্রকৃতিকে, সমাজকে, রাষ্ট্রকে প্রশ্ন করেছে, সেই প্রশ্নের উত্তর খোঁজার চেষ্টা করেছে। কখনো প্রশ্নের উত্তর সে পেয়েছে, কখনো পায়নি। এইসব প্রশ্নের উত্তর, অনুমান, নতুন প্রশ্নের আগমন, উত্তরের পক্ষে-বিপক্ষে যুক্তি, তর্ক, বিতর্ক মানবজাতির জ্ঞানের সোপান তৈরি করেছে, পরবর্তীতে সে সোপান ধরেই আধুনিক ও উন্নত মানবসমাজের উদ্ভব; যার হাত ধরে বিশ্ব জয় করেছে মানুষ নামের এই প্রাণীটি। বছরের পর বছর মানুষের জিজ্ঞাসা, অভিজ্ঞতা, জীবনবোধের যে সম্ভার ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছে, মানুষ চেয়েছে তা সংরক্ষিত করতে, তার উত্তরাধিকারদের জীবন চলার পথ নির্দেশনা হিসেবে রেখে যেতে। প্রজন্ম থেকে প্রজন্মান্তরে নিজেদের জ্ঞানকে ছড়িয়ে দেয়ার এই অভিলাষ থেকেই জন্ম নিয়েছে বই।
যা শুধু মলাটের ভেতরে আবদ্ধ কিছু শব্দের সুশৃঙ্খল বিন্যাসই নয়, মানবসভ্যতার জয়গানের প্রতীক। শুধু তাই নয় যুগ যুগান্তরে পৌঁছে যাওয়ার উৎকৃষ্ট বাহন হলো বই। চোখের সামনে যে বইপুস্তক আমরা দেখি, সেখানে জ্ঞানের যে বিস্তৃত সমাবেশ, বাহ্যিক দৃষ্টিতে তা সমকালীন মনে হলেও এর অন্তর্নিহিত ভাব মানবজাতির হাজার হাজার বছরের দীর্ঘ পথ পরিক্রমার সুপ্ত ইতিহাস। তাই একজন মানুষ যখন একটি বই হাতে নেয়, তার সামনে খুলে যায় বিশ্বসভ্যতা ভ্রমণের এক সুপ্রশস্ত দরজা। এই দরজা দিয়ে যে প্রবেশ করতে জানে, পৃথিবীর সবকিছু তার কাছে তুচ্ছ মনে হবে।
পাঠ্য বহির্ভূত বই কি?
পাঠ্যবই পড়া মানেই নির্দিষ্ট একটি সিলেবাস এর গন্ডির মধ্যে থাকা। যতটুকু না জানার জন্য পড়া তার চেয়ে বেশি কাজ করে পরীক্ষায় ভাল ফলাফল করার তারণা। পাঠ্যবই আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক সার্টিফিকেট পেতে সাহায্য করে ঠিকই কিন্তু নির্দিষ্ট পাঠ্যবইয়ের বাইরে বই পড়ার অভ্যাস আমাদের আরও বেশি প্রাণবন্ত করে। শুধু তাই না! পাঠ্যপুস্তক আমাদের স্বাভাবিক শেখাকে অনেক ক্ষেত্রে একঘেয়েমি করে তোলে। তাই পাঠ্যবইয়ের বাইরে অন্যান্য গল্পের বই পড়ার অনেক গুরুত্ব রয়েছে। কিন্তু পাঠ্য বহির্ভূত বই বলতে আমরা বেশিরভাগ সময় সাহিত্যকেই ভেবে থাকি। সাহিত্য মানুষের মনের ও চিন্তার প্রসার ঘটায়, এ কথা সত্য; তবে জ্ঞানের রাজ্য এর চেয়েও বিশাল!
বইপুস্তকের ভাণ্ডারও সাহিত্যের পরিধির চেয়ে কয়েক হাজার গুণ বড়৷ তাই শুধু সাহিত্য নিয়েই নয়, ইতিহাস, ঐতিহ্য, সংস্কৃতি, ধর্ম, দর্শন, রাজনীতি, অর্থনীতি, আইনশাস্ত্র প্রভৃতি বিষয়েও লক্ষ লক্ষ বইপুস্তক রয়েছে পৃথিবীতে। এ কারণেই পছন্দের বিষয়ে পছন্দের বই খুঁজে নেয়ার দারুণ সুযোগ রয়েছে পাঠকদের। আবার এটিকে যে কেবলমাত্র পুঁথিগত বিদ্যার পুঁজিকেই বৃদ্ধি করে, তা নয়। উৎকৃষ্ট মানের বই মানুষের অন্তরাত্মাকে জাগিয়ে তুলতে জানে। এর ফলাফল হিসেবে মানুষের মনোজগতেরও লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটে। একজন মানুষের চিন্তন ক্ষমতা ও বিশ্লেষণী দক্ষতাকে বাড়িয়ে তুলতেও ভালো মানের বইয়ের কোনো বিকল্প নেই। সে কারণেই বই পড়াকে নিছকই কিছু বাক্য আওড়ানো মনে করে ভুল করা যাবে না, বরং এর অন্তর্নিহিত উদ্দ্যেশ্যকেও সামনে আনতে হবে।
বই পাঠের উদ্দেশ্য কি হওয়া উচিত?
পৃথিবীর অনেক দেশের তুলনায় আমাদের দেশের মানুষদের বই পড়ার হার কম। এর অন্যতম প্রধান কারণ হলো বই পাঠের সঠিক উদ্দেশ্য আমাদের সামনে তুলে ধরা হয় না। ছোটবেলা থেকেই বইকে আমরা পরীক্ষা পাশের মাধ্যম হিসেবে জানতে অভ্যস্ত হই। এই ধ্যানধারণাই মানুষকে পতনের দিকে পরিচালিত করে৷ তাই এ ধরনের চিন্তাভাবনা থেকে আমাদের বেরিয়ে আসতে হবে। তা না হলে, আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রে যে অস্থিতিশীলতা বিদ্যমান, দিন দিন সেটি আরো প্রকট আকার ধারণ করবে। সমাজের মানুষের সংকীর্ণতা, কুসংস্কার, হীন মানসিকতার পরিবর্তন ঘটানো খুব সহজসাধ্য নয়৷ এটি একটি জটিল ও সময়সাপেক্ষ প্রক্রিয়া। সমাজ থেকে চলমান গড়পড়তা হীন মানসিকতা উপড়ে ফেলতে হলে এর গভীরে গিয়ে সংস্কার সাধন প্রয়োজন। এজন্য দরকার সুস্থ চিন্তার অধিকারী মননশীল মানুষ।
আর এ ধরনের মানুষ গড়তে হলে সবচেয়ে বেশি যেটি দরকার তা হলো উন্নততর মানসিকতার ভিত্তি, সে ভিত্তি তৈরিতে বই বহুলাংশে কার্যকর। সমাজের সামগ্রিক মানসিকতার প্রয়োজন ঘটানোর জন্য বই পড়াকে সামাজিক আন্দোলনে রূপদান করতে হবে। এই কাজটিই করে যাচ্ছেন আব্দুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যার ও তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র। সমাজের উন্নতির জন্য দরকার আলোকিত মানুষ, যার আলোয় আলোকিত হবে আরো দশজন, প্রজ্জ্বলিত হবে সমাজ। এজন্যই বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্রের মূল স্লোগান, ‘আলোকিত মানুষ চাই‘। সমাজে একটি ইতিবাচক পরিবর্তন আনতে বিশ্ব সাহিত্য কেন্দ্র যে কাজ করে যাচ্ছে, তার সাথে আমাদের একাত্মতা ঘোষণা করা দরকার। বই পড়াকে সমাজের সর্বস্তরে ব্যাপক আকারে ছড়িয়ে দিতে পারলে আমরাই এর সুফল ভোগ করব। তাই শুধু নিজে পড়লেই চলবে না, আশেপাশের মানুষদেরও বই পাঠে উৎসাহিত করতে হবে।
বই সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু
একজন মানুষ যে পেশায়ই দক্ষ হোক না কেন তার পেশাদারিত্বে উৎকর্ষতা অর্জনের জন্য বারবার বইয়ের কাছে ফিরে আসতে হয়। কারণ জ্ঞানের সূচনা সেখান থেকে এবং সে জ্ঞানকে সামগ্রিকভাবে কাজে লাগানোর দক্ষতা মানুষ বই পড়ে পেয়ে থাকে। মানুষের মননশীল, চিন্তাশীল, সৃষ্টিশীল চিন্তার যাবতীয় সূচনার বিস্ফোরণ একমাত্র বইয়ের মাধ্যমে হতে পারে।
বলা হয়, মানুষের সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধু হচ্ছে বই। যা তাকে কখনোই ছেড়ে যায় না; মানুষের অবসরের সঙ্গীও বটে। সারাদিনের ক্লান্তি শেষে মানুষ যখন বইয়ের পাতায় ডুব দেয়, সম্পূর্ণ ভিন্ন এক প্রশান্তি বিরাজ করে তার মধ্যে। অবসরকে ফলপ্রসূভাবে ব্যবহার করতে হলে বই পড়ার মতো দ্বিতীয় কোনো পদ্ধতি নেই। যা মনের খোরাক যোগায়, চেতনাকে আন্দোলিত করে। অনেকেই অবসরে অলস সময় কাটান, কেউ কেউ আবার নানাবিধ কারণে বিষণ্ণতায় ভোগেন। তাদের জন্যও বই হতে পারে মনকে সুস্থ রাখার চমৎকার একটি মাধ্যম।
লেখক হতে হলে প্রচুর পড়তে হবে
লেখক হতে গেলেও বইপুস্তক পাঠের বিকল্প নেই। ভালো লেখক হতে হলে অবশ্যই নিয়মিত প্রচুর পরিমাণে পড়তে হবে। বই লেখকের শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে, নতুন নতুন ভাবনার উদ্রেক ঘটায়, যা তাকে লিখতে সাহায্য করে। বিশ্বের খ্যাতনামা লেখকদের অধিকাংশই ছিলেন বইপোকা। দিনের বেশিরভাগ সময় তাঁরা বইপুস্তক পড়ে কাটাতেন, যার ফলে পৃথিবীর মানুষকে তাঁরা উপহার দিতে পেরেছেন অমূল্য সব বই। সুতরাং, লেখক হওয়ার বাসনা থাকলে, প্রথমেই পাঠক হতে হবে, প্রচুর পড়তে হবে।
সমাজ বিনির্মাণে বই
আগেই বলেছি, সমাজকে নতুন করে বিনির্মাণের জন্য বই পাঠের বিকল্প নেই। সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন জাতি গঠনের জন্য বই পড়া অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই বই পড়াকে যদি তৃণমূলে ছড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে সমাজের অপরাধপ্রবণতা কিছুটা হলেও কমে আসবে। আমাদের বিপুল সংখ্যক জনসংখ্যার এই দেশকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে হলে নিঃস্বার্থ, চরিত্রবান, উন্নত মানসিকতার মানুষ প্রয়োজন। বই পাঠই পারে আমাদেরকে এরকম মানুষ এনে দিতে। ‘বই পড়া তাই বোঝা নয়, আনন্দে পরিণত হোক। ’বই পাঠের আনন্দ ছড়িয়ে পড়ুক সবার মাঝে, পাঠকে পাঠকে ভরে উঠুক দেশ।
আরো পড়ুন,
আপনার মতামত দিন