আজ ২৬ জুন। বাংলার শ্রেষ্ঠ ঔপন্যাসিক, উনিশ শতকের বিশিষ্ট বাঙালি বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়; গদ্য ও প্রবন্ধ লেখকের আজ জন্মদিন। বাংলা গদ্য ও উপন্যাসের বিকাশে তার অসামান্য অবদানের জন্য তিনি আজও স্বীকৃত।
জন্ম ও পরিবার
১৮৩৮ সালের ২৬ জুন বর্তমানে ভারতের উত্তর চব্বিশ পরগণা জেলার নৈহাটি শহরের নিকটস্থ কাঠালপাড়া গ্রামে তিনি জন্মগ্রহণ করেন। তার আদিনিবাস ছিল হুগলি জেলার দেশমুখো গ্রামে। পিতা যাদবচন্দ্র ও মাতা দূর্গাসুন্দরীর তিনি তৃতীয়া সন্তান। তার জন্মের সময় তার বাবা অবিভক্ত মেদিনীপুর জেলার ডেপুটি কালেক্টর পদে উন্নীত হয়েছিলেন।
শিক্ষাজীবন
ছয় বছর বয়স অব্দি বঙ্কিম কাঠালপাড়াতেই জীবন অতিবাহিত করেন। পাচ বছর বয়সে কুল-পুরোহিত বিশ্বম্ভরের নিকট তার হাতেখড়ি হয়। শিশুকালেই তার অসামান্য মেধার পরিচয় পাওয়া যায়। শোনা যায়, বঙ্কিমচন্দ্র একদিনেই বাংলা বর্ণমালা আয়ত্ত করেছিলেন। গ্রামের পাঠশালায় যাননি বঙ্কিম। ১৮৪৪ সালে বঙ্কিমের পিতার বদলী মেদিনীপুরে হলে সেখানেই তার প্রকৃত শিক্ষাজীবন শুরু হয়।
মেদিনীপুরের ইংরেজি স্কুলের প্রধানের পরামর্শে যাদবচন্দ্র তাকে ইংরেজি স্কুলে ভর্তি করিয়ে দেন। তিনি সেখানে অল্প দিনেই তার কৃতিত্ত্বের ছাপ ফেলেন। বার্ষিক পরীক্ষার ফলে সন্তুষ্ট হয়ে স্কুল্প্রধান টিডসাহেব বঙ্কিমকে ডাবল প্রমশন দেওয়ার প্রস্তাবও রাখেন,যা যাদবচন্দ্রের হস্তক্ষেপে আর বাস্তবের মুখ দেখেনি। ১৮৪৯ সালে বঙ্কিম কাঠালপাড়ায় ফিরে এসে বাংলা ও সংস্কৃত শিক্ষা নেন শ্রীরাম ন্যায়বাগীশের কাছে। বঙ্কিম খুব ভাল আবৃত্তি করতে পারতেন। সংবাদ প্রভাকর এবং সংবাদ সাধুরঞ্জনে প্রকাশিত বহু কবিতাই তিনি এই সময় কন্ঠস্থ করে ফেলেন। ভারতচন্দ্র রায়গুণাকর বিরচিত বিদ্যাসুন্দর কাব্যের ‘বিদ্যার রূপবর্ণন’ ও জয়দেব প্রণীত গীতগোবিন্দম কাব্য থেকে ‘ধীরে সমীরে যমুনাতীরে’ তিনি প্রায়শই আবৃত্তি করতেন।
১৮৪৯ সালে বঙ্কিমচন্দ্র হুগলি কলেজে ভর্তি হোন এবং সাত বছর অধ্যয়ন করেন। হুগলি কলেজে অধ্যয়নকালে তিনি ১৮৫৩ সালে জুনিয়র স্কলারশিপ পরীক্ষায় প্রথমস্থান অধিকার করে মাসিক আট টাকা বৃত্তি লাভ করেন। এই বছরেই তিনি সংবাদ প্রভাকর পত্রিকায় কবিতা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে ২০ টাকা পুরষ্কার হিসেবে লাভ করেন। হুগলি কলেজে অধ্যয়নকালেই তিনি সংবাদ প্রভাকর ও সংবাদ সাধুরঞ্জনে গদ্য-পদ্য রচনা শুরু করেন। ১৮৫৬ সালে সিনিয়র বৃত্তি পরীক্ষায় বিশেষ কৃতিত্ব প্রদর্শন করায় তিনি দুই বছরের জন্য কুড়ি টাকা বৃত্তি লাভ করেন এবং এর কিছুকাল পরেই তিনি হুগলি কলেজ ছেড়ে কলকাতায় চলে আসেন।
আইন পড়বার জন্য তিনি কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হোন। ১৮৫৭ সালে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় এবং প্রবেশিকা পরীক্ষা প্রবর্তিত হয়। বঙ্কিম প্রবেশিকা পরীক্ষায় আইন বিভাগ হতে প্রথম বিভাগে উত্তীর্ণ হোন। ১৯৫৮ সালে প্রথমবারের মত বি.এ পরীক্ষা নেওয়া হয় এবং মোট দশজন ছাত্র এ পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করেন তন্মধ্যে উত্তীর্ণ হোন শুধু বঙ্কিমচন্দ্র ও যদুনাথ বসু।
কর্মজীবন
কর্মজীবনে বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় বাবার মতোই সরকারি চাকুরীতে যোগদান করেন। ১৮৫৮ সালের ৭ আগস্ট যশোরে তিনি ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে যোগদান করেন। এরপর তিনি যথাক্রমে নেগুয়া,খুলনা, বারুইপুর ও মুর্শিদাবাদে বদলী হোন। ১৮৭১ সালের ১০ জুন তিনি মুর্শিদাবাদের কালেক্টর রূপে পদোন্নতি লাভ করেন। কর্মজীবনের সবশেষে তিনি ঝিনাইদহের ডেপুটি ম্যাজিস্ট্রেট ও ডেপুটি কালেক্টর হিসেবে কর্মরত ছিলেন। ১৮৯১ সালের ১৪ সেপ্টেম্বরে তিনি অবসর গ্রহণ করেন। সারাজীবন তিনি অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে কাজ করে গিয়েছেন। ফলে,তার কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ব্রিটিশ সরকার তাকে ১৮৯১ সালে “রায়বাহাদুর ” এবং, ১৮৯৪ সালে “কম্পানিয়ন অফ দ্যা মোস্ট এমিনেন্ট অর্ডার অফ দ্যা ইন্ডিয়ান এম্পায়ার” খেতাবে ভূষিত করেছে।
বিবাহ
বঙ্কিমচন্দ্রের প্রথম বিবাহ সম্পাদিত হয় ১৮৪৯ সালে,এগার বছর বয়সে এক পঞ্চমবর্ষীয়া বালিকার সাথে। চাকুরী জীবনের শুরুতে যশোরে অবস্থানকালে তার প্রথমা স্ত্রীর মৃত্যু ঘটে। এরপর হালি শহরের বিখ্যাত চৌধুরী বংশের কন্যা রাজলক্ষ্মী দেবীর সাথে ১৮৬০ সালের জুন মাসে তিনি বিবাহবন্ধনে আবদ্ধ হোন।
সাহিত্যজীবন
একনিষ্ঠ এই সরকারি কর্মকর্তা তার লেখনীর ধারেই সর্বাধিক সমাদৃত। বাঙলা তথা ভারতের নবজাগরণের অন্যতম মুখ হিসেবেই বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় তখন পরিচিত হতে থাকেন। হুগলি কলেজে অধ্যয়নকালেই তার ভেতরে সে সাহিত্যকীটের পরিস্ফুটন ঘটে তার জাদুকরী ছোয়ার সাথে আমরা আজও পরিচিত। বাংলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস “দুর্গেশনন্দিনী“ র রচয়িতা তিনি। তার রচনার হাত ধরেই বাংলা সাহিত্য নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছিল। ১৮৬৫ সালের মার্চ মাসে এই উপন্যাসটি প্রকাশিত হয়। মাত্র ছাব্বিশ বছর বয়সে তিনি এই উপন্যাসের মাধ্যমে ষোড়শ শতাব্দীর শেষভাগে উড়িষ্যার অধিকারকে কেন্দ্র করে মোঘল ও পাঠানের সংঘর্ষকে তুলে ধরেন সকলের সামনে। বঙ্কিমচন্দ্রের জীবদ্দশায় এই উপন্যাসের তেরোটি সংস্করণ প্রকাশিত হয়েছিল।
বঙ্কিম মোট ১৫ টি উপন্যাস লিখেছিলেন, তন্মধ্যে একটি ইংরেজি ভাষার উপন্যাসও ছিল, যার নাম “Rajmohan’s Wife“। তার লিখা দ্বিতীয় উপন্যাসটি হল “কপালকুণ্ডলা”,যা বাংলা সাহিত্যের প্রথম সার্থক রোমান্টিক উপন্যাস বলে খ্যাত। ১৮৬৬ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। নবকুমারের উদ্দেশ্যে বলা কপালকুন্ডলার “পথিক,তুমি পথ হারাইয়াছ?” উক্তিটি বাংলা সাহিত্যের প্রথম রোমান্টিক ডায়লগ। এটি একটি কাব্যধর্মী উপন্যাসও বটে।
তার আরোও উল্লেখযোগ্য রচনার মধ্যে রয়েছে আনন্দমঠ, রাজসিংহ, মৃণালিনী, বিষবৃক্ষ, যুগলাঙ্গুরীয়, চন্দ্রশেখর, কৃষ্ণকান্তের উইল প্রভৃতি।
ছদ্মনাম
প্রখ্যাত এই ঔপন্যাসিক গীতার ব্যাখ্যাদাতা,সাহিত্য সমালোচক হিসেবেও বেশ সমাদৃত। তিনি বাংলা ভাষার আদি সাহিত্যপত্র বঙ্গদর্শনের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তার ছদ্মনাম ছিল “কমলাকান্ত”। বঙ্কিমই বাংলা ভাষাকে প্রথম সত্যিকারের মর্যাদা প্রদান করেন। তার রচনার ধরণ বাংলা সাহিত্যে ‘বঙ্কিমী শৈলী’ বা ‘বঙ্কিমী রীতি’ নামে পরিচিত।
মৃত্যু
সাহিত্যসম্রাট খ্যাত এই মহান ঔপন্যাসিকের স্বাস্থ্য শেষজীবনে তেমন ভাল ছিল না। ১৮৯৪ সালের মার্চ মাসে তার বহুমূত্র রোগ বেড়ে যায়। ১৮৯৪ সালের ৮ এপ্রিল, ৫৫ বছর বয়সে কলকাতায় বঙ্কিমচন্দ্র চট্টপাধ্যায় শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন। বঙ্কিম বাংলা সাহিত্যকে যে যৌবন দান করে গিয়েছিলেন তা আজও লেখকদের হাত ধরে বিকশিত হয়ে যাচ্ছে। বঙ্কিমশৈলীর আলোকচ্ছটায় বর্ণিল হয়ে থাকুক বাংলা সাহিত্যের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস।
আরো পড়ুন,
‘মরণ বিলাস’ আহমেদ ছফার অনন্য সৃষ্টি
পুতুল নাচের ইতিকথা-বাংলা সাহিত্যের অমূল্য রত্ন