কৃষিবিদ দিবস। বাংলাদেশের ইতিহাসে এই দিবসটি বেশ একটা পুরনো না হলেও দিবসটি এদেশের সকল কৃষিবিদদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ও তাৎপর্যপূর্ণ।
১৩ ফেব্রুয়ারি, ১৯৭৩। বাংলাদেশে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসে স্মরণীয় একটি দিন। এ দিনে বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের শুভাগমন ঘটেছিল বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের (বাকৃবি) সবুজ চত্বরে।
ব্রহ্মপুত্রের তীরে সবুজ শ্যামল অঙ্গন; কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হ্নদয় নিংড়ানো ভালবাসা দিয়ে বরণ করেছিল তাঁদের প্রাণপ্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধুকে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক, ছাত্র, কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের সাথে বঙ্গবন্ধুর আন্তরিক মিলন, নৈকট্য, কৃষিবিদ ও বিশেষজ্ঞদের সাথে তাঁর মতবিনিময়, দিক নির্দেশনামূলক ভাষণ এবং কর্মব্যস্ততা এ দিনটিকে স্মরণীয় করে রেখেছে।
দেশের কৃষি, কৃষক ও কৃষিবিদের বঙ্গবন্ধুর নিবিড় সম্পর্কের কথা কারও অজানা নয়। নির্বাচনী ডামাডোলের শত ব্যস্ততার মধ্যেও তাই মমতার টানে তাইতো সেদিন তিনি ছুটে গিয়েছিলেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এটিই ছিল বঙ্গবন্ধুর প্রথম ও শেষ সফর। বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক সেই সফর আজও কৃষিবিদদের মায়াবন্ধনে আবদ্ধ করে রেখেছে।
কৃষিবিদ সমাজ ঐতিহাসিক এ দিনটির অপরিসীম গুরুত্ব ও মর্যাদাকে স্মরণীয় করে রাখতে প্রতি বছর ’কৃষিবিদ দিবস’ হিসাবে পালন করে থাকে।
বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে সেদিন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়কে অপরূপ সাজে সজ্জিত এবং অধুনালুপ্ত সমাবর্তন মন্ডপকে বিশেষভাবে তৈরী করা হয়েছিল। সার্কিট হাউজ থেকে উপাচার্য অধ্যাপক ডঃ কাজী ফজলুর রহিম, বাকসুর জি এস আব্দুর রাজ্জাক (সাবেক খাদ্য ও দুযোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রী), ছাত্রলীগ সভাপতি মোঃ রহমতুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক মোঃ রফিক, শিক্ষক সমিতির সভাপতি ডঃ শাহান-উদ্দীন চৌধুরী, সাধারণ সম্পাদক ডঃ আনোয়রুল হক বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সংবর্ধনাস্থলে নিয়ে আসেন।
বাকসুর তদানীস্তন ভিপি বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা ও বাকৃবি’র সাবেক রেজিস্ট্রার নজিবুর রহমান মঞ্চ থেকে অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন। এ লালগালিচা সর্ম্বধনা অনুষ্ঠানটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। সভাস্থলে পৌঁছলে চিরাচরিত রীতি অনুযায়ী সংবর্ধিত প্রধান অতিথিকে দাঁড়িয়ে সম্মান জানানো হয়। কিন্তু এ ক্ষেত্রে তা করা হয়নি।
দর্শকবৃন্দ বসেছিলেন, ‘জয় বাংলা বাহিনীর’ এক সুসজ্জিত দল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার প্রদান করেন। সেই সাথে একদল ছাত্রছাত্রী সমন্বয়ে কবিগুরু ”তোমারী করি নমস্কার যাত্রা করি গুরু. . . ” গানের সাথে সাথে ফুলের পাঁপড়ি ছিটিয়ে বরণ করে নেন জাতির পিতাকে, বিমোহিত বঙ্গবন্ধু পরবর্তীতে বিভিন্ন স্থানেও উল্লেখ করেন সেই সংবর্ধনার কথা।
বঙ্গবন্ধুর বক্তব্যেও পূর্বে বাকসুর ভিপি নজিবুর রহমান (বাকৃবি’র সাবেক রেজিস্ট্রার) বঙ্গবন্ধুকে ‘বাংলাদেশের কৃষি’ এ আদর্শে প্রতিফলিত একটি কাঠের কারুকার্য এবং ‘বাংলার উৎফুল্ল কৃষক’ নামে একটি আলোকচিত্র উপহার প্রদান করেন।
মানপত্র পাঠ করেন বাকসুর জি এস আব্দুর রাজ্জাক। বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন বিভাগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে ছাত্রদের বোনা একটি কম্বল উপহার দেওয়া হয়। ‘বাকসু’ কর্তৃক আলোকচিত্র শিল্পী নাইব উদ্দিন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ফটো অ্যালবাম প্রদান করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে প্রকাশিত কৃষি ’বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা’র বিশেষ সংখ্যার একটি কপি বঙ্গবন্ধুকে উপহার প্রদান করা হয়। পরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ ছাত্রলীগ অফিসে শহীদ স্মৃতি পাঠাগারের দ্বারোন্মোচন করেন। পাঠাগারের বই কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকা, দুটো ট্রাক এবং ছাত্রদের পূনর্বাসনের জন্য নগদ এক লাখ টাকা প্রদান করেন বঙ্গবন্ধু।
একইসঙ্গে তিনি ছাত্রদের যাতায়াতের সুবিধার্থে দুটি নতুন মডেলের বাস আনুষ্ঠানিকভাবে হস্তান্তর করেন এবং বিশ্ববিদ্যালয় চত্বরে একটি পূর্ণাঙ্গ রেল ষ্টেশন প্রতিষ্ঠার জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেন। সবচেয়ে বড় কথা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বঙ্গবন্ধুর আগমনের মধ্য দিয়েই এ দেশে কৃষি শিক্ষা ও কৃষিবিদগণ যথাযথ গুরুত্ব , সামাজিক সম্মান ও প্রথম শ্রেণীর পদ মর্যাদা, কৃষির নতুন অভিযাত্রা সূচিত হয়েছিল।
আজ আমরা যে খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বার প্রান্তে উপনীত হয়েছি, তার বীজ রোপিত হয়েছিল সেদিনই। যা পরবর্তিতে বিভিন্ন সময়ে অবনমিত হয়েছে। যথাযথই তিনি ছিলেন রাজনীতির মহাকবি। শক্তিমান কবির লেখনীতে যেমন সৃষ্টি হয় মহাকাব্যের, তেমনি বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক প্রজ্ঞা ও দূরদর্শিতায় জাগরিত হে সোনার বাংলাদেশ। সেদিনের অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু প্রদান করেন এক ঐতিহাসিক বক্তৃতা, যা সমকালেও তাৎপর্য বহন করে।
বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সংক্ষিপ্ত ইতিহাস:
বাংলাদেশের কৃষি সংস্কৃতিতে আধুনিকতার ছোঁয়ায় একটা শক্তিশালী আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো দেশকে উপহার দেয়ার লক্ষ্য নিয়ে জন্ম নেয়া দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কৃষি শিক্ষার সর্বশ্রেষ্ঠ ও সর্ববৃহৎ বিদ্যাপীঠ বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় (বাকৃবি)। জাতির গভীরতম প্রত্যাশা পূরণে দরিদ্রতা দূরীকরণের অঙ্গীকার ও খাদ্যনিরাপত্তা অর্জনের প্রত্যয়ে এবং আধুনিক প্রযুক্তি বিজ্ঞানে সমৃদ্ধ কৃষি সরবরাহের মাধ্যমে আজ জাতির হৃদয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয় আপন মর্যাদার আসীন। গত প্রায়৫১ বছরের অগ্রযাত্রায় আন্তর্জাতিক মানের শিক্ষাপদ্ধতি উচ্চতর কৃষি গবেষণা, লাগসই কৃষি গবেষণা সবকিছু মিলে এ বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন পরিণত হয়েছে ‘দি সেন্টার অব এক্সিলেন্স’-এ।
১৯৫৯ সালে জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশের ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত হয় এ বিশ্ববিদ্যালয়টি। বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা চূড়ান্ত হয় ১৯৬১ সালের ৮ জুন এবং ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্টে পূর্ব পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ-এর মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয়টির যাত্রা শুরু। পরবর্তীতে ১৯৭২ সালে ‘এডাপটেশন অব ইউনির্ভাসিটি ল’জ’ অধ্যাদেশ বলে এর নামকরণ করা হয় বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৬১-৬২ শিক্ষাবর্ষে ভেটেরিনারি ও কৃষি এই দুই অনুষদে ৪৪৪ জন শিক্ষার্থী এবং ২৩ বিভাগে ৩০ জন শিক্ষক নিয়ে একাডেমিকভাবে যাত্রা শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয়টি; প্রথম ভিসি ছিলেন প্রফেসর ড. এম. ওসমান গণি।