ডান হাতের বদলে বাম হাত দিয়ে কাজ করতে বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করেন অনেকেই। এমন মানুষদেরকে সাধারণত বাঁ-হাতি বলা হয়। তাদের জন্যই শুক্রবার (১৩ আগস্ট) পালিত হচ্ছে আন্তর্জাতিক বাঁ-হাতি দিবস।
মূলত ১৯৭৬ সালে প্রথম পালিত হয় আন্তর্জাতিক বাঁ-হাতি দিবস। শুরুটা করেন, ডিন আর ক্যাম্পবেল নামে এক ব্যক্তি, যিনি ‘লেফ্টহ্যান্ডার্স ইন্টারন্যাশনাল’ নামে এক সমিতি প্রতিষ্ঠা করেন। সেই থেকে প্রতি বছর ১৩ আগস্ট পালিত হয় এই দিনটি।
এই দিবসটি দিয়ে মানুষকে বোঝানোর চেষ্টা হয়, বাঁ-হাতি হলে যেমন কিছু অসুবিধা আছে ঠিক তেমন কিছু সুবিধাও আছে।
বিশ্বে নারী ও পুরুষ মিলিয়ে প্রায় ১০ শতাংশ মানুষ বাঁ-হাতি। আর বিশ্বের বিখ্যাত মানুষের তালিকায় বাঁ-হাতিদের সংখ্যাটা নেহাত কম নয়। একবার বাঁ-হাতি বিখ্যাত মানুষদের তালিকা দেখলেই আপনি অবাক হবেন বৈ-কি! তারা ডান-হাতিদের থেকে কোনো অংশে কম বা আলাদা নন। শুধু ডান হাতের বদলে বাঁ হাত ব্যবহারে স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে থাকেন। বিশ্ববিখ্যাত বাঁ-হাতিদের মধ্যে রয়েছেন অ্যালবার্ট আইনস্টাইন, অ্যারিস্টটল, লিওনার্দো দা ভিঞ্চি, মেরি কুরি, বারাক ওবামা, বিল গেটস, মার্ক জাকারবার্গ, অমিতাভ বচ্চন, শচিন টেন্ডুলকার, ব্রায়ান লারা, ওয়াসিম আকরাম, রাফায়েল নাদাল, ডেভিড গাওয়ার, অ্যাঞ্জেলিনা জোলি, টম ক্রুজ, হেলেন কেলার, লেডি গাগা, লুইস ক্যারল, প্রিন্স উইলিয়ামস, ওপরাহ উইনফ্রে। নিজের দেশের দিকেই তাকান। বিশ্বসেরা অলরাউন্ডার সাকিব কিন্তু বাঁহাতি। আবার দেশসেরা পেসারও বোলিংয়ে ভেল্কি দেখান বাম হাত দিয়েই।
গবেষণার তথ্য মতে, বাঁ-হাতিরা ডানহাতিদের থেকে বেশি সৃষ্টিশীল এবং বুদ্ধিমান হয়ে থাকেন। উপরের তালিকা দেখলে অবশ্য এই দাবি সম্পর্কে সন্দেহ হওয়ার কথা নয়। গবেষণায় দেখা গেছে, মস্তিষ্কের ডান এবং বাঁ অংশের মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা ডান-হাতিদের থেকে বাঁ-হাতিদের বেশি, এর ফলেই তারা বেশি বুদ্ধিমান হন।
তবে বাঁ-হাতি দিবস পালনের মূল উদ্দেশ্য হলো এই বিষয়ে সামাজিক কুসংস্কারমুক্ত করা। তারা কোনোভাবেই অস্বাভাবিক নন, ডানহাতিদের মতোই স্বাভাবিক।
বাঁ-হাতি হওয়ার কারণ
পৃথিবীতে বেশির ভাগ মানুষ ডানহাতি। কিন্তু অল্প কিছু মানুষ কেন বাঁ-হাতি হন? মনে প্রশ্ন জাগতে পারে বৈকি। গবেষকরা বাঁ-হাতি হওয়ার কারণ হিসেবে ৪০টির মতো জীন শনাক্ত করেছেন। প্রচলিত আরেকটি গবেষণার ফল জানলে আপনি চমকে উঠতে পারেন, জন্মগ্রহণের সময় শতকরা ৭৫ ভাগ শিশুই বামহাতি হওয়ার বৈশিষ্ট্য নিয়ে জন্মায়। কিন্তু পরবর্তী সময়ে পরিবেশ ও জীবনযাপন পদ্ধতি মিলিয়ে শিশু ডানহাতিতে পরিণত হয়।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের শারীরবৃত্তীয় বিভাগের প্রধান ড. টিম ক্রোর মতে, সম্ভবত মানবদেহের পিসিডিএইচ-১১এক্স জিন হাতের ব্যবহারের এ বিষয়টি নির্ধারণ করে দেয়। অক্সফোর্ডের আরেক বিশেষজ্ঞ ড. ফ্রাংকসের মতে, ক্রোমোজোম ২-এর মধ্যে থাকা এলআরআরটিএম-১ জিনের জন্য মানুষ হাত ব্যবহারে আলাদা বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন হয়। এ ছাড়া মাতৃগর্ভে থাকা ডাই ইথাইল স্টিলবোস্টেরলের সংস্পর্শ বাঁ-হাতি হতে সহায়ক।
কেবল মানুষই নয়, অনেক পশু-পাখিও বাঁ-হাতি বৈশিষ্ট্য হয়। এক গবেষণায় বলা হয়, অস্ট্রেলিয়ান ক্যাঙ্গারুরা সব বাঁ-হাতি। সেখানে বলা হয়, দ্বিপদী প্রাণীর ক্ষেত্রে হয়তো এমনটা হওয়াই স্বাভাবিক। কিন্তু চতুষ্পদী প্রাণীরা এ ধরনের বৈশিষ্ট্য প্রকাশ করে না।
প্রাণীর এই বিশেষ বিষয়টি নিয়ে টিয়া পাখি ও মুরগির ওপর গবেষণা করেছেন নরওয়ের ব্রুনে ক্যাসেল বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষক ড. লেসলি রজারস। তিনি জানান, চোখ ও হাতের সংযোগের কারণে প্রাণীরা শরীরের বিভিন্ন অংশকে প্রাধান্য দিয়ে কাজ করে। যেমন, যদি কোনো টিয়া পাখি ডান চোখে কোনো খাবার খেয়াল করে, তবে স্বভাবতই সে তা ধরতে ডান পা এগিয়ে দেবে। এই বৈশিষ্ট্যের জন্য রজারস মস্তিষ্কের ‘হেমিস্ফিয়ার’ অংশের কার্যপ্রণালির কথা তুলে ধরেন। মস্তিষ্কের এই অংশ ডান ও বামের বিষয়টি নির্ধারণ করে। কাজেই এই অংশটি স্বাভাবিকভাবেই বাঁ-হাতি বা ডানহাতি হিসেবে মানুষকে তৈরি করে।
বাঁ-হাতিদের নিয়ে চমকপ্রদ তথ্য
- গবেষণায় দেখা গেছে, বাঁ-হাতিদের ডান পাশের মস্তিষ্ক বেশি ব্যবহৃত হয়। এ জন্যই সাধারণত বাঁ-হাতিরা বেশি উদ্ভাবনী ক্ষমতাসম্পন্ন হয়ে থাকে। ক্রিস এমসি ম্যামস ইউনিভার্সিটি কলেজ লন্ডন থেকে প্রকাশিত ডানহাতি ও বাঁ-হাতিদের ওপর লেখা একটি বইতে উল্লেখ করা আছে, বাঁ-হাতিদের জীবনের সাফল্য, প্রাপ্তি বা কৃতিত্বপূর্ণ কাজ ডানহাতিদের তুলনায় ঈর্ষণীয়। বলা হয়ে থাকে, তাঁদের আইকিউ বেশি এবং সংগীত ও গণিতে তাঁদের পারদর্শিতা ডানহাতিদের চেয়ে ভালো।
- ক্রীড়াজগতে ক্রিকেট, টেবিল টেনিস, ব্যাডমিন্টন, টেনিস, বেসবল খেলায় বাঁ-হাতিরা বেশ সুবিধা আদায় করে নিতে পারে।
- ইউরোপ ও আমেরিকা মহাদেশের সফল রাজনীতিবিদদের অনেকেই বাঁ-হাতি। যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্টদের মধ্যে চারজন বাঁহাতি ছিলেন।
- নির্দিষ্ট সময়ের আগে জন্মগ্রহণকারী বেশির ভাগ শিশুই বাঁ-হাতি হয়। গর্ভাবস্থায় এবং প্রসবের সময় সন্তানের অবস্থান এবং প্রিম্যাচিউর (অর্থাৎ ২৪ সপ্তাহের আগে এবং জন্মগত ওজন ১.৫ কেজির কম হলে) হলে বাঁ-হাতি হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যায়।
- ১৯৮৯ এবং ১৯৯১ সালে প্রকাশিত দুটি বৈজ্ঞানিক প্রবন্ধে বলা হয়েছিল, বাঁ-হাতিদের জীবনকাল ডানহাতিদের চেয়ে কম হয়। কিন্তু সম্প্রতি এক গবেষণায় ক্যালিফোর্নিয়ার গবেষকরা এই কথাটি নাকচ করে দিয়েছেন।
- বিশ্বে বেশির ভাগ যন্ত্র এবং সরঞ্জাম ডানহাতিদের উপযোগী করে বানানো। এ জন্য প্রতিবছর বিশ্বে দুই হাজারের বেশি বাঁ-হাতি বিভিন্ন দুর্ঘটনার শিকার হন।
- মা-বাবা দুজন বাঁ-হাতি হলে সন্তানদের শুধু শতকরা ২৬ জন বাঁ-হাতি হওয়ার সম্ভাবনা থাকে।
- ডানহাতিদের তুলনায় বাঁ-হাতিদের অ্যালার্জি এবং মাথাব্যথার (মাইগ্রেন) সমস্যা বেশি হয়। এ ছাড়া বাঁ-হাতিরা অনিদ্রা ও তোতলামির সমস্যায়ও ভোগেন।
- ২০০৬ সালে যুক্তরাষ্ট্রের লাফায়েত কলেজ এবং জন হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের গবেষকরা দেখিয়েছেন, বাঁ-হাতি মানুষরা ডানহাতিদের চেয়ে ১০-১৫% বেশি উপার্জন করেন।
আরো পড়তে পারেন