মানব সভ্যতার পথচলার সূচনা কৃষির হাত ধরে। মানব জীবনের অস্তিত্বকে অর্থবহ করতে কৃষির ওপর নির্ভরতা সময়ের সঙ্গে পাল্টা দিয়ে বেড়ে চলেছে। আজ অবধি তাই কৃষিই আমাদের জীবিকার প্রধান অবলম্বন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সর্বাধিক গুরুত্বপূর্ণ একটি সেক্টর হল কৃষি। আমাদের মোট জনসংখ্যার শতকার ৮০ ভাগ এবং শ্রমশক্তি ৬০ ভাগ কৃষিতে নিয়োজিত। গ্রামের উন্নয়নের কথা বলতে গেলে প্রথমে আসে কৃষি উন্নয়ন- কৃষি ভিত্তিক শিল্প, বাণিজ্য ও সেবা খাতের উন্নয়ন। কৃষিভিত্তিক খাতগুলোর এই উন্নয়ের পাশাপাশি দেশে কৃষি ভিত্তিক শিক্ষার প্রসারে যে প্রতিষ্ঠানটি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত তার নাম ” বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়”।
কৃষিভিত্তিক এই উন্নয়ন ও প্রসারের লক্ষ্য নিয়ে ১৯৬১ সালের ১৮ আগস্ট পথ চলা শুরু করে দক্ষিণ এশিয়ার সর্ববৃহৎ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় “বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়”।
একটু পেছন ফিরে তাকানো যাক। সালটা ১৯৩৬। অবিভক্ত বাংলায় প্রথম প্রতিষ্ঠিত হয় কৃষি মন্ত্রণালয় যার অন্তুর্গত ছিল কৃষি ও লাইভস্টক। অবিভক্ত বাংলার মূখ্যমন্ত্রী হিসেবে শের এ বাংলা এ কে ফজলুল হক “বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (BAI)” প্রতিষ্ঠা করেন ১৯৩৮ সালে। ১৯৪৭ সালে এর নামকরণ হয় “ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট”। “বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (BAI)” কর্তৃক ব্যাচেলর ইন এগ্রিকালচার কোর্স চালু করা হয় যেখানে লাইভস্টক সায়েন্স ছিল মূল কোর্সের মাত্র ১৫·৭%। অতঃপর ১৯৪৭ সালের পর পাকিস্তানে কৃষি ও লাইভস্টক সেক্টর দুটোকে আলাদা করা হয়। ১৯৫০ সালে কুমিল্লাতে নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয় “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ” যা ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত। এরপর ১৯৫৭ সালে আরো পরিবর্ধিত এবং পরিমার্জিতরূপে “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি কলেজ” ময়মনসিংহে স্থানান্তরিত হয়ে নতুন আঙ্গিকে যাত্রা শুরু করে “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কলেজ” নামে।
পরবর্তীতে ১৯৫৮ সালে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গঠনে একটি আইন প্রণীত হয়,যা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় আইন-১৯৬১ নামে পরিচিত। এরপর ১৯৫৯ সালে তৎকালীন জাতীয় শিক্ষা কমিশন এবং খাদ্য ও কৃষি কমিশনের সুপারিশক্রমে ১৯৬১ সালের ১৮ই আগস্ট ময়মনসিংহে “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কলেজ” ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে “ইস্ট পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়” প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সময় পশ্চিম পাকিস্তানের লিয়াল্লপুরেও একটি কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় গঠিত হয় যা বর্তমানে ফয়সালাবাদ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় নামে পরিচিত।


পরবর্তীতে ১৯৭১ সালে “ইস্ট পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়”-এর নাম পরিবর্তিত হয় “বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়” এ। ইস্ট পাকিস্তান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের যাত্রা শুরু হয় দুটি অনুষদ নিয়ে (কৃষি অনুষদ এবং ভেটেরিনারি অনুষদ) যার অন্তর্গত ছিল ২৩টি বিভাগ। পরবর্তীতে ১৯৬২ তে অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি, ১৯৬৩-৬৪ তে এগ্রি ইকোনমিক্স ও রুরাল সোসিওলজি, ১৯৬৪-৬৫ তে এগ্রিকালচারাল ইঞ্জিনিয়ারিং ও টেকনোলজি এবং ১৯৬৭-৬৮ তে ফিশারিজ অনুষদে বিস্তৃতি লাভ করে।

গোড়াপত্তনের পর থেকে “বেঙ্গল এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (BAI)” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে কৃষি অনুষদে কার্যক্রম চালাচ্ছিল। অতঃপর ১৯৬১ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর এর শিক্ষা কার্যক্রম বাকৃবিতে স্থানান্তরিত হয় ১৯৬৪ সালে। পরবর্তীতে ২০০১ সালের জুলাই মাসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বাংলাদেশের ১৭তম বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে “শের এ বাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়”-এর উদ্বোধন করেন। ২০০১ এ শুধুমাত্র কৃষি অনুষদ দিয়ে শুরু করার পর ২০০৭ সালে এগ্রি বিজনেস, ২০১২ সালে এনিম্যাল সায়েন্স ও ভেটেরিনারি অনুষদ এবং ২০১৭ সালে ফিশারিজ ও একোয়াকালচার অনুষদ এ বিস্তৃত হয়।
উল্লেখ্য, বাকৃবির যাত্রা শুরু দুটো অনুষদ নিয়ে কৃষি ও ভেটেরিনারি (১৯৬১)। কিন্তু ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট (কলেজ) বাকৃবির অধিভুক্ত হয়েছে ১৯৬৪ তে অ্যাফিলিয়েটেড প্রতিষ্ঠান হিসেবে, অনুষদ হিসেবে নয়। বাকৃবির যাত্রা শুরু “ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কলেজ” এবং এর ক্যাম্পাসকে কেন্দ্র করে এবং এখন পর্যন্ত সংস্থাপন অনুযায়ী ভেটেরিনারি অনুষদই বাকৃবির যেকোনো তালিকায় ১নং সিরিয়ালে থাকে। বাকৃবি কখনোই “ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচারাল ইনস্টিটিউট” কিংবা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অনুষদের অধীনে ছিল না। ভেটেরিনারি অনুষদ যেমন বলতে পারেনা আমরা বাকৃবির প্রতিষ্ঠাতা তেমনি অন্য কেউই বলতে পারে না। কেননা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধীনে সবাই।
ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচার ইন্সটিটিউট ও ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কলেজ দুটোই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধিভুক্ত ছিল। কিন্তু পরবর্তীতে ইস্ট পাকিস্তান ভেটেরিনারি এন্ড অ্যানিমেল হাজবেন্ড্রি কলেজের বিভাগগুলো ভেটেরিনারি অনুষদের আওতাধীন হলেও, ইস্ট পাকিস্তান এগ্রিকালচার ইন্সটিটিউট কিন্তু কোনো স্বতন্ত্র অনুষদ হয়নি। বরং বাকৃবির কৃষি অনুষদের অ্যাফিলিয়েটেড কলেজ হিসেবেই ছিল বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নীত হবার আগ পর্যন্ত।

বাকৃবি ক্যাম্পাসের পরিকল্পনা
কোন বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর ক্যাম্পাস কিভাবে সাজানো হবে তা নিয়ে পরিকল্পনার প্রয়োজন পড়ে। ভবনের স্থাপত্যকলা, ক্যাম্পাস কেমন হবে তার পুরো পরিকল্পনা একজন স্থপতি করে থাকেন। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপনা ও ক্যাম্পাসের পুরো পরিকল্পনা করেন আমেরিকার তৎকালীন বিখ্যাত স্থপতি প্রয়াত পল রুডলফ (১৯১৮-১৯৯৭। পল রুডলফ ছাত্র বাংলাদেশের বিখ্যাত স্থপতি প্রয়াত মাজহারুল ইসলামের (১৯২৩-২০১২) আমন্ত্রণে বাংলাদেশে এসেছিলেন।

ইয়ালে স্থাপত্য বিভাগের প্রধান হিসেবে শিক্ষক হিসেবে পল রুডলফকে পেয়েছিলেন মাজহারুল ইসলাম; সহপাঠি হিসেবে ছিলেন নরম্যান ফস্টার এবং রিচার্ড রজার্স। এরপর ছাত্র মাজহারুল ইসলামের আমন্ত্রণেই বাংলাদেশে আসেন পল রুডলফ এবং বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরো নকশা করেন।

প্রতিষ্ঠাকালীন শিক্ষার্থী-শিক্ষক সংখ্যা
১৯৬১ সালে আনুমানিক ৪৪৪ জন শিক্ষার্থী ও ৩০ জন শিক্ষক নিয়ে যাত্রা শুরু করে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে ৭১০৩ জন শিক্ষার্থী ও ৫৮১ জন শিক্ষক রয়েছেন। শিক্ষার্থীদের মধ্যে অনার্স পর্যায়ে ৪,৪৩৪ জন, মাস্টার্সে ১,২০৯ এবং পিএইচডি ৪৩২ জন এবং শিক্ষকদের মধ্যে অধ্যাপক ২৭০ জন, সহযোগী অধ্যাপক ১০৭ সহকারী অধ্যাপক ১৩৯ এবং প্রভাষক পর্যায়ে ৪৬ জন রয়েছে। শিক্ষকদের মধ্যে ৩৬৩ জন পিএইচডি ডিগ্রিধারী।
প্রতিষ্ঠার পর থেকে এখন পর্যন্ত ছয়টি বিভাগের আওতায় প্রায় ২৫,৫২৩ জন অনার্স, ১৬,০৭৮ জন মাস্টার্স এবং ৫৩৭ জন শিক্ষার্থীকে পিএইচডি ডিগ্রি দিয়েছে।

প্রথম সমাবর্তন
১৯৬৮ সালের ২৮ মার্চে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রথম সমাবর্তনে অনুষ্ঠিত হয়। স্নাতক ও স্নাতকোত্তর প্রায় পাঁচ শতাধিক শিক্ষার্থী সেই সমাবর্তনে উপস্থিত ছিলেন। সমাবর্তন উপলক্ষ্যে ১৫ পয়সা সমমানের স্মারক মোহর বানানো হয়।


কৃষি খাতকে পূর্ণতা দেওয়া এবং খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য নিয়ে ৫৯ বছর ধরে গৌরবের স্মারক হয়ে জ্বলজ্বল করছে। দেশের প্রথম কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় হিসেবে যাত্রা করা এ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ তথা দক্ষিণ এশিয়ার কৃষিশিক্ষার অন্যতম পথিকৃৎ বিদ্যাপীঠ বলে পরিগণিত। প্রতিষ্ঠাকালে মাত্র দুটি অনুষদ নিয়ে কার্যক্রম শুরু করা বাকৃবিতে বর্তমানে ছয়টি অনুষদে কৃষিবিষয়ক পূর্ণাঙ্গ জ্ঞান আহরণের সুযোগ রয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষিখাত ও দেশের উন্নয়নের মূল চালিকাশক্তি শ্রেষ্ঠ এই বিদ্যাপীঠ আজ গৌরবের সাথে ৫৯ বছর পেরিয়ে ৬০ তম বছরে পদার্পণ করেছে। কৃষি তথা কারিগরি ক্ষেত্রে কর্মের সুযোগ বৃদ্ধির পাশাপাশি জ্ঞানচর্চা আরো বেগবান করা হলে কৃষিবিজ্ঞান ও প্রযুক্তির অগ্রগতির ধারার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় বিগত অর্ধশত বছরের গৌরবময় ঐতিহ্য পরবর্তী দিনগুলোয়ও সমুন্নত রাখতে সক্ষম হবে। গুণে-মানে-সৃষ্টিতে সত্যিকার অর্থে কৃষিশিক্ষার তীর্থ বিদ্যাপীঠ হয়ে দেশের সার্বিক উন্নয়ন ও সমৃদ্ধি অর্জনে রাখবে অগ্রণী ভূমিকা, এ প্রত্যাশা সবার।
তথ্যসূত্রেঃ কালেরকন্ঠ ও গুগল
সম্পাদনায়ঃ জেবিন সাজ্জাদ, সহ-সম্পাদক, শ্যাডো নিউজ