আলো বিলিয়ে দেওয়া সূর্যও এক সময় অস্ত যায়, গোধূলিবেলা শেষে নামে আঁধার বর্ণের সন্ধ্যা। কিংবদন্তিদেরও এভাবে একসময় থামতে হয়, বিদায় বলতে হয়। মাশরাফি ও থামলেন। বাংলাদেশকে ‘মিনোজ’ তকমা থেকে দূরে ঠেলে দেওয়ার মহানায়ক অবশেষে বাইশ গজের অধিনায়কত্বকে বিদায় বলে দিলেন। অধিনায়কত্বের অন্তিম লগ্নে স্পর্শ করলেন এক অনন্য মাইলফলক। ওয়ানডে ক্রিকেট ইতিহাসের ২৩ তম অধিনায়ক হিসেবে অর্ধশত ম্যাচ জয়ের কীর্তি গড়লেন ম্যাশ।
প্রায় ৬ বছর ধরে বাংলাদেশ ক্রিকেটকে নেতৃত্ব দেওয়া মাশরাফি ও বাংলাদেশকে দেখে নেওয়া যাক ঘটনা পরিক্রমায়-

“দ্য বাংলাদেশ টাইগারস হ্যাভ নকড আউট দ্য ইংলিশ লায়নস!”:
রুবেল হোসেন ছুটছেন। ছুটছেন সবাই। একপাশে শুয়ে পড়েছেন তিনি- মাশরাফি বিন মুর্তজা। একটু পর তার ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়লেন সবাই। অ্যাডিলেড ওভালে সেদিন যেন উচ্ছ্বাস বাঁধ মানছিল না বাংলাদেশের। ইতিহাসে প্রথমবার বিশ্বকাপে কোয়ার্টার ফাইনাল নিশ্চিত হয়েছে বাংলাদেশের, ইংল্যান্ডের বিপক্ষে সে জয় দিয়ে। জেমস অ্যান্ডারসনকে বোল্ড করে সে জয় নিশ্চিত করেছিলেন রুবেল। সে বিশ্বকাপে তাসকিন আহমেদের সঙ্গে লাফিয়ে উঠে বুক মিলিয়ে মাশরাফির উদযাপনটাও হয়ে গেছে আলোচিত এক ছবি।

সিরিজ জয়ের জয়রথ চলছিলইঃ
পাকিস্তান। ভারত। দক্ষিণ আফ্রিকা। এর আগে এদের কারও বিপক্ষে সিরিজ জেতেনি বাংলাদেশ। ২০১৫ বিশ্বকাপের পর দেশের মাটিতে জিতল সবার সঙ্গে- একের পর এক। ৩ ম্যাচ সিরিজে পাকিস্তানের বিপক্ষে ৩-০ , ভারতের বিপক্ষে ২-১ এর পর দক্ষিণ আফ্রিকাকে বাংলাদেশ হারিয়েছিল ২-১ এ।
কার্ডিফে ইতিহাস রচনাঃ

২০১৭ সাল। চ্যাম্পিয়নস ট্রফির খেলা চলছে। কার্ডিফে ৩৩ রানে ৪ উইকেট হারানোর পর সাকিব আল হাসান ও মাহমুদউল্লাহর মহাকাব্যিক এক জুটিতে নিউজিল্যান্ডকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো চ্যাম্পিয়নস ট্রফির সেমিফাইনালে গেল বাংলাদেশ।জয় নিশ্চিত হওয়ার পর ড্রেসিংরুমের ব্যালকনিতে মাশরাফির সেই উচ্ছ্বাসটা আপনি চাইলেও কখনো ভুলতে পারবেন না।
এশিয়া কাপে স্বপ্নভঙ্গঃ
ওপেনিংয়ে লিটন দাসের সঙ্গে পাঠানো হয়েছিল মেহেদি হাসান মিরাজকে। দারুণ এক ভিত পেয়েছিল বাংলাদেশ তাতে। লিটন পেয়েছিলেন ক্যারিয়ারের প্রথম সেঞ্চুরি, তার উদযাপনে মিশে ছিল স্বস্তি। তবে ড্রেসিংরুমের সামনে থেকে মাশরাফির ইঙ্গিতটা রক্ত টগবগ করতে বাধ্য করেছিল বোধহয় আপনাকে। বুকে হাত দিয়ে মাশরাফি ইঙ্গিত দিচ্ছিলেন, “সাহস রাখ, শেষ করে আয়।” শ্রীলঙ্কার বিপক্ষে প্রথম ম্যাচে তামিম ইকবালের অনন্য সাহসিকতার পেছনেও ‘হাত’ ছিল মাশরাফির। হাতে চোট পেয়ে তামিম উঠে গিয়েছিলেন শুরুতেই, তবে মুশফিকুর রহিমকে সঙ্গ দিতে শেষদিকে হাতে প্লাস্টার নিয়ে নেমেছিলেন আবারও। একহাতে ব্যাটিং করেই খেলেছিলেন ১ বল। পরে তামিম বলেছিলেন, ড্রেসিংরুমে প্রথম তাকে ব্যাটিংয়ের কথা বলেছিলেন মাশরাফিই। তামিমের সে ম্যাচের পরই দেশে ফিরেছিলেন, ফিরেছিলেন সাকিবও। বাংলাদেশও ফাইনালটা শেষ করে আসতে পারেনি, ফাইনালে ভারতের কাছে আরেকবার হয়েছিল স্বপ্নভঙ্গ। মাশরাফির নেতৃত্বে বাংলাদেশ সব ফরম্যাট মিলিয়ে এশিয়া কাপের দুটি ফাইনালে খেলেছে।
অতঃপর শিরোপাঃ

২০০৯ থেকে ২০১৯- একাধিক দলের টুর্নামেন্টের ফাইনাল জেতার অপেক্ষাটা বাংলাদেশের শুধু বাড়ছিলই, সূর্যের আলোর সঙ্গে ছায়া বড় হওয়ার মতো করে। মালাহাইডে অবশেষে ঘুচলো সে অপেক্ষা। ২০১২ এশিয়া কাপের ফাইনালে খুব কাছে গিয়ে পাকিস্তানের সঙ্গে হারের পর সাকিব-নাসির হোসেনের কান্নার ছবিটা হয়তো এখনও আপনাকে কেমন করে তোলে। অথবা তারও আগে ২০০৯ সালে মুত্তিয়া মুরালিধরন বা নিদাহাস ট্রফিতে দীনেশ কার্তিকের অতিমানব হয়ে ওঠা আপনাকে উদাস করে তোলে এখনও। সেসব ছবি মুছে দেওয়ার চেষ্টা করেছিল মালাহাইডের সেই ফাইনাল। সৌম্য সরকারের দারুণ এক ইনিংসে ওয়েস্ট ইন্ডিজকে হারিয়ে প্রথমবারের মতো একাধিক দলের সিরিজের ফাইনাল জিতেছিল বাংলাদেশ, মাশরাফির নেতৃত্বে।
বিশ্বকাপে হতাশাকাব্যঃ
২০১৯ বিশ্বকাপটা সাকিব আল হাসানের স্বপ্নের সমান বড়। বাংলাদেশের শুরুটাও হয়েছিল দারুণ- দক্ষিণ আফ্রিকাকে হারিয়ে। তবে ধীরে ধীরে সাকিব নিজেকে ছাড়িয়ে যেতে লাগলেন, আর বাংলাদেশ উলটোপথে হাঁটা শুরু করলো। মাশরাফি থাকলেন বিবর্ণ। ৮ ইনিংস বোলিং করে মাশরাফি পেয়েছিলেন মাত্র ১ উইকেট।অনেক উচ্চাশা নিয়ে যাওয়া বাংলাদেশ বিশ্বকাপ শেষ করেছিল ৯ ম্যাচে ৩ জয় নিয়ে ৮ নম্বরে থেকে।
বিশ্বকাপের পর শ্রীলঙ্কা সিরিজে শেষমুহুর্তে চোটের কারণে খেলেননি মাশরাফি। এরপর লম্বা বিরতির পর জিম্বাবুয়ে সিরিজ, মাশরাফি যেটি দিয়ে ইতি টানলেন তার অধিনায়কত্বের ক্যারিয়ারের। ২০১৪ সালে মুশফিকুর রহিমের কাছ থেকে যখন দায়িত্ব নেন আরেক মেয়াদে, সে বছর ওয়ানডেতে কোনও জয় ছিল না বাংলাদেশের। জিম্বাবুয়েকে ৫-০ হোয়াইটওয়াশ করে শুরু হয়েছিল তার অধিনায়কত্বের ‘নতুন’ অধ্যায়, সেই জিম্বাবুয়ের বিপক্ষেই আরেকটি সিরিজ হোয়াইট ওয়াশ করে শেষ হচ্ছে সেটি।
বিদায় ‘অধিনায়ক’ মাশরাফি।