বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠা করেন কিশোর কুমার দাশ। তিনি কিছু শারীরিক জটিলতা নিয়ে জন্ম নিয়েছিলো। তাঁর বাবা ছিলেন একজন তৃতীয় শ্রেণির সরকারী কর্মচারী। বাবার সামান্য আয়ে পাঁচ ভাইবোনকে নিয়ে সংসার চালাতে হিমশিম খেতে হতো পরিবারকে। কিশোর কুমার দাশের বাবা চাকরি থেকে অবসরে যাওয়ার পরে তাঁর লেখাপড়া বন্ধ হয়ে যায় টাকার অভাবে। তখন তিনি ১৬ বছর বয়সী এসএসসি পাস করা এক কিশোর। এরপর কয়েকবছর বিরতি শেষে চট্টগ্রামের একটি পলিটেকনিক ইনিস্টিটিউট থেকে উচ্চ মাধ্যমিক শেষ করে প্রবেশ করেন চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে (চুয়েট)। এখান থেকে পড়ালেখা শেষ করেই ২০০৬ সালে যোগদান করেন ওয়ারিদ টেলিকমে (এয়ারটেল)। বর্তমানে পেরুতে ইন্টারনেট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান ‘ওলো’তে কর্মরত রয়েছেন। সম্পূর্ণ নিজের টাকায় প্রতিষ্ঠা করেছেন বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। সুবিধাবঞ্চিত হওয়া এবং নানা প্রতিকূলতাই তাকে সমাজের সুবিধাবঞ্ছিত শিশুদেরকে নিয়ে ভাবার প্রেরণা জাগিয়েছে।
২০১৩ সালের ২২ নভেম্বর বিদ্যানন্দের নারায়ণগঞ্জ শাখা চালু করার মাধ্যমে এর আনুষ্ঠানিক যাত্রা শুরু হয়।বর্তমানে বিদ্যানন্দের মোট ১২টি শাখা রয়েছে।এর মধ্যে মোট ৬ টি এতিমখানা ও অনাথালয় রয়েছে।বাংলাদেশের রামু ও রাজবাড়ীতে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন নিজস্ব জমিতে দুইটি আলাদা এতিমখানা প্রতিষ্ঠা করেছে।
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন সুবিধা বঞ্চিত শিশু, অসহায়দের জন্য বেশ কিছু কাজ করে। যেমন:
এক টাকায় শিক্ষা
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন প্রতিষ্ঠার মূল উদ্দেশ্য ছিল সমাজের সুবিধা বঞ্চিত শিশুদের মৌলিক শিক্ষা প্রদান করা।ফাউন্ডেশনের ৪০ জন কর্মকর্তা এবং কয়েক’শ স্বেচ্ছাসেবকের মাধ্যমে সারাদেশে ২,০০০ এর অধিক শিশুকে বিজ্ঞান, গণিত ও ইংরেজি বিষয়ে পাঠদান করা হয়।এছাড়া প্রচলিত শিক্ষার সহায়ক হিসেবে বিনামূল্যে কোচিং সুবিধা প্রদান করে থাকে।
এক টাকায় আহার
বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের অন্যতম প্রধান কাজ হলো পথশিশু ও অক্ষম বৃদ্ধদের প্রতিদিন “এক টাকায় আহার” প্রজেক্টের মাধ্যমে এক টাকার বিনিময়ে খাবার দেওয়া।এই প্রজেক্ট-এ বর্তমানে প্রায় ২,০০০ মানুষকে দৈনিক খাবার বিতরণ করা হয়।এক বেলার এই খাবার যেন অসহায় মানুষগুলোকে ভিক্ষাবৃত্তি বলে মনে না করায় সেজন্য প্রত্যেকের কাছ থেকে এক টাকা মূল্য রাখা হয়।অপরের দেওয়া খাবার খেতে যেন অসহায় মানুষগুলোকে ভাবতে না হয় তারা সত্যিকার অর্থেই খাবারের মূল্য পরিশোধে অপারগ।তাই এই প্রতীকি এক টাকার খুব বড় একটা মাহাত্ম্য আছে।এই ফাউন্ডেশন বাংলাদেশের পথশিশুদের জন্য পুষ্টিকর, সুষম ও নিরাপদ খাবার নিশ্চিত করতে নিরলস কাজ করে চলেছে।
এক টাকায় চিকিৎসা
দরিদ্র মানুষ ও পথশিশুরা বিদ্যানন্দের এই চিকিৎসাসেবায় মাত্র এক টাকার বিনিময়ে রক্তের গ্রুপ পরীক্ষা, ডাক্তারের প্রয়োজনীয় পরামর্শ, ওজন মাপানো,ডায়বেটিস পরীক্ষা, উচ্চ রক্তচাপের চিকিৎসা ছাড়াও তিনদিনের ঔষধ পেয়ে থাকে। এর বাইরে কারো দীর্ঘস্থায়ী কোনো সমস্যা হলে প্রয়োজনীয় পরামর্শ দেয়া হয়।বিদ্যানন্দের স্বেচ্ছাসেবক ডাক্তাররা দৈনিক এমন ২৫-৩০ রোগীকে এক টাকার বিনিময়ে চিকিৎসা এবং ঔষধ দিয়ে যাচ্ছে।১২ বছরের নীচে এবং ৬০ বছরের অধিক পথের কিংবা বস্তির মানুষ পায় এই চিকিৎসা সুবিধা।বর্তমানে ঢাকার বিভিন্ন স্কুলগুলোতে মেডিকেল ক্যাম্পসহ স্বাস্থ্য শিক্ষা দেওয়া হচ্ছে। এছাড়াও বন্যাপীড়িত উত্তরবঙ্গের মানুষের পাশে ওষুধ এবং খাবার স্যালাইন দিয়ে পাশে দাঁড়িয়েছিল বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। অন্যদিকে কক্সবাজারের রামু ও বান্দরবানে পাহাড়ের বুকে প্রতিনিয়ত সংগ্রাম করে টিকে থাকা স্বাস্থ্যসুবিধা বঞ্চিত মানুষকে সেবা দেওয়া হচ্ছে।
বাসন্তী নিবাস
ঢাকা শহরে কিংবা অন্য যে কোনও শহর এলাকায় একজন নারী শিক্ষার্থী পরীক্ষা দিতে কিংবা চাকরির সন্ধানে বা কাজে এলে তাকে আবাসন সমস্যায় পড়তে হয়। শহরে পরিচিত বা আত্মীয়-স্বজন থাকলে খুব একটা সমস্যা হয় না বটে তবে সবার এমন সুবিধা থাকে না। নারীদের আবাসনের এমন সংকট দূর করতে এবং নিরাপত্তার কথা মাথায় রেখে ‘বাসন্তী নিবাস’ তৈরি করেছে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। বাসন্তী নিবাসে থাকতে হলে ৭১ টাকায় একজন শিক্ষার্থীকে কিংবা একজন চাকরিপ্রার্থী নারীকে তার প্রমাণস্বরূপ কাগজপত্র দেখাতে হবে। নিরাপত্তার জন্য এখানে সার্বক্ষণিক সিসিটিভি ক্যামেরা আছে এবং হোটেলের নিরাপত্তারক্ষী থেকে শুরু করে সব কর্মচারী থাকবেন নারী।
করোনায় আশার আলো বিদ্যানন্দ
শুরু থেকে সাধারণ মানুষের মাঝে মাস্ক বিতরণ এবং হ্যান্ড স্যানিটাইজার বিভিন্ন মসজিদ, হসপিটাল এবং চিকিৎসকদের মাঝে বিতরণ করেছে। পাবলিক ট্রান্সপোর্টে জীবাণুনাশক ছিটানোর কাজ করেছে। এখন হাসপাতালগুলোতে প্রতিদিন জীবাণুনাশক ছিটিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া হাসপাতালের আশপাশের রাস্তা এবং জায়গাগুলোতেও এই কাজ করছে। ঢাকা এবং চট্টগ্রামে প্রতিদিন প্রায় ৯ হাজার লিটার জীবাণুনাশক ছিটাচ্ছি এখন। যেহেতু পুরো দেশ ছুটির মধ্যে আছে। কেউ বাইরে বের হচ্ছে না তাই প্রশাসন থেকে, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে অনুমতি নিয়ে এই কাজ করে যাচ্ছে।
করোনার কারণে ক্ষতিগ্রস্ত পাঁচ লাখ মানুষের কাছে খাবার পৌঁছে দেবে বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন। ৫০০ টন চাল-ডাল-লবণ-তেল কেনার কাজ শুরু করেছে সংগঠনটি। লকডাউন অবস্থায় কেউ খাদ্য সংকটে ভুগলে বিদ্যানন্দ বা এক টাকার আহারের সাথে যোগাযোগ করা হলে তাৎক্ষণিক খাদ্য পৌঁছে দেওয়া হবে। চাল, ডাল, তেল, দুধ, বিস্কুট, স্যালাইন, নুডুলসের মতো খাবার থাকবে, প্রতিটি পরিবারের জন্য প্রায় ৫শ’ টাকার খাবার থাকবে একেকটা প্যাকেটে। একটা নেটওয়ার্ক তৈরি করে ত্রাণটা মানুষের কাছে সঠিকভাবে পৌঁছে দিচ্ছে বিদ্যানন্দ। বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের হাতে যে ফান্ডটা আছে তা দেশের বিভিন্ন জায়গায় ডিস্ট্রিবিউট করে দেয়া হচ্ছে যাতে এটা শুধু ঢাকাকেন্দ্রিক না হয়।
বিদ্যানন্দের অন্যান্য মহৎ মানবিক কাজের মধ্যে রয়েছে –
- বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশন “এক টাকায় আইন সেবা” নামক প্রজেক্টের মাধ্যমে সুবিধা বঞ্চিত মানুষের জন্য আইন সেবা সহজলভ্য করেছে। এই প্রজেক্টের মাধ্যমে তারা মাত্র এক টাকার বিনিময়ে অভিজ্ঞ আইনজীবীর মাধ্যমে আইন সেবা পেয়ে থাকে
- গরীব ও অসহায় কিন্তু মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের জন্য শিক্ষাবৃত্তির ব্যবস্থা করে থাকে। ২০১৫ সালে ১০২ জন শিক্ষার্থীকে বৃত্তি প্রদানের মাধ্যমে প্রজেক্টটি শুরু করা হয়। বৃত্তিপ্রাপ্ত ছাত্র-ছাত্রীদের মধ্যে পুরস্কার হিসাবে ক্রেস্ট, সার্টিফিকেট, নগদ অর্থ ও শিক্ষা সামগ্রী বিতরণ করা হয়।
- বিদ্যানন্দ ফাউন্ডেশনের বিভিন্ন শাখায় বিনামূল্যে গ্রন্থাগার সুবিধা রয়েছে।এসব গ্রন্থাগারে ৮ হাজারের অধিক বইয়ের সংগ্রহ আছে। এই গ্রন্থাগার গুলো সকাল-সন্ধ্যা খোলা থাকে এবং যে কেউ সেখানে গিয়ে বিনামূল্যে বই পড়তে পারেন।
- ২০২০ সালে ঢাকা সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের পোস্টার ও ব্যানার দিয়ে অসহায় সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের জন্য খাতা এবং ব্যাগ তৈরি করে।
- রমজানে ইফতার ও সেহরী বিতরন।
- ঈদ ও পূজায় জামা কাপড় বিতরন।
- বিভিন্ন দূর্যোগ কালীন সময় প্রান্তীক পর্যায়ে সহযোগীতা করা ইত্যাদি।