আজ থেকে বাংলাদেশে চালু হচ্ছে ভার্চুয়াল আদালত । কোভিড-১৯ মহামারীর মধ্যে আসামি, সাক্ষী এবং আইনজীবীদের সশরীরে উপস্থিতি ছাড়াই তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে কীভাবে ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম চলবে, সে বিষয়ে নির্দেশিকা জারি করেছে সুপ্রিম কোর্ট।
ভার্চুয়াল আদালত এর সংজ্ঞায় বলা হয়েছে, “অডিও-ভিডিও বা অনুরূপ অন্য কোনো ইলেকট্রনিক পদ্ধতির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তির আদালতের বিচার বিভাগীয় কার্যধারায় উপস্থিত থাকা বা অংশগ্রহণ।”
বাংলাদেশের প্রত্যেক জেলার জেলা ও দায়রা জজ, মহানগর এলাকার মহানগর দায়রা জজ, নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, বিশেষ জজ আদালতের বিচারক, সন্ত্রাস দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক, দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক, জননিরাপত্তা বিঘ্নকারী অপরাধ দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারককে এবং জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট, মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট নিজে অথবা তার নিয়ন্ত্রণাধীন এক বা একাধিক ম্যাজিস্ট্রেটকে দিয়ে এই ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম পরিচালনা করা যাবে। তবে ‘বিশেষ প্রাকটিস নির্দেশনা’ অনুসরণ করে নিম্ন আদালতে আপাতত কেবল জামিন সংক্রান্ত বিষয়গুলো নিষ্পত্তি করা যাবে।
হাইকোর্ট বিভাগে ভার্চুয়াল আদালত পরিচালনার জন্য তিনটি বেঞ্চ গঠন করে দেওয়া হয়েছে, যেখানে ‘অতি জরুরি’ রিট ও দেওয়ানি মামলা, ফৌজদারি মামলা ও সংশ্লিষ্ট জামিন আবেদন এবং সম্পত্তি, বিবাহ বিচ্ছেদসহ কিছু মামলার শুনানি করা যাবে।
ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর মাধ্যমে অবশেষে দেশের বিচার বিভাগ প্রবেশ করতে যাচ্ছে নতুন এক অধ্যায়ে। এরই মধ্যে ভার্চুয়াল এই কোর্ট চালু করতে সব ধরনের প্রস্তুতি শেষ করেছে সুপ্রিম কোর্ট প্রশাসন। আইনি বাধা কাটাতে জারি করা হয়েছে অধ্যাদেশ। ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনায় প্রশিক্ষণ নিয়েছেন সংশ্লিষ্ট বিচারপতিরাও। প্রস্তুতি নিয়েছেন রাষ্ট্রের প্রধান আইন কর্মকর্তাসহ রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীরা। আর আগে থেকেই ভার্চুয়াল কোর্টের দাবিতে সরব তরুণ আইনজীবীরা রীতিমতো উচ্ছ্বাস জানিয়েছেন নতুন ধারার এই সিদ্ধান্তে।
সুপ্রিম কোর্ট সূত্রে জানা গেছে, ভার্চুয়াল কোর্টে অংশ নিতে আইনজীবীদের ভিডিও কনফারেন্সের লিংক পাঠানো হবে। এসএমএসে দেওয়া হবে অ্যালার্ট। নির্দিষ্ট সময়ে বিচারকসহ সংশ্লিষ্ট আইনজীবীরা যুক্ত হবেন ভিডিও কনফারেন্সে। আজ সোমবার (১১ মে) থেকেই ডিজিটাল পদ্ধতির এই আদালত ব্যবস্থা চালু হবে বলে জানা গেছে।
এর আগে, রোববার ভার্চুয়াল আদালত চালুর ক্ষেত্রে কিছু নির্দেশনা জারি করেছেন প্রধান বিচারপতি। আপিল বিভাগের একটি এবং হাইকোর্ট বিভাগের তিনটি বেঞ্চ তিনি শুনানির জন্য নির্ধারণ করে দিয়েছেন। কোন বেঞ্চ কোন বিষয়ের মামলাগুলো চালাবে, সেটিও উল্লেখ করে দেওয়া হয়েছে। আর নিম্ন আদালতে কেবল জামিন শুনানি করতে বলা হয়েছে ভার্চুয়াল আদালত ব্যবহার করে।
বিচারকার্যের নির্দেশনামা :
আসামি, সাক্ষী এবং আইনজীবীদের সশরীরে উপস্থিতি না হলেও তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে তাদের যুক্ত করার মাধ্যমে সুপ্রিম কোর্ট, হাই কোর্ট এবং নিম্ন আদালগুলোকে বিচারিক কার্যক্রম পরিচালনার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে ‘আদালত কর্তৃক তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার অধ্যাদেশে’।
আর সেই ভার্চুয়াল আদালতের কার্যক্রম কীভাবে চলবে সে বিষয়ে আপিল বিভাগের জন্য ১৩ দফা, হাই কোর্টের জন্য ১৫ দফা এবং অধস্তন আদালতের জন্য ২১ দফা নির্দেশনা দিয়েছেন প্রধান বিচারপতি।
অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, “ফৌজদারি কার্যবিধি বা দেওয়ানি কার্যবিধি বা আপাতত বলবৎ অন্য কোনো আইনে ভিন্নতর যাই থাকুক না কেন, যে কোনো আদালত এই অধ্যাদেশের ধারা ৫ এর অধীন জারিকৃত প্র্যাকটিস নির্দেশনা (বিশেষ বা সাধারণ) সাপেক্ষে, অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষরা বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীদের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করে যে কোনো মামলার বিচার বা বিচারিক অনুসন্ধান বা দরখাস্ত বা আপিল শুনানি বা সাক্ষ্য গ্রহণ বা যুক্ততর্ক গ্রহণ বা আদেশ বা রায় প্রদান করতে পারবে।”
অডিও-ভিডিও বা অন্য কোনো ইলেক্ট্রনিক পদ্ধতিতে বিচারপ্রার্থী পক্ষ বা তাদের আইনজীবী বা সংশ্লিষ্ট অন্য ব্যক্তি বা সাক্ষীদের ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা ছাড়া অন্যান্য বিষয়ের ক্ষেত্রে ফৌজদারী কার্যবিধি বা ক্ষেত্রমতে দেওয়ানি কার্যবিধি অনুসরণ করতে হবে।
এতদিন বিচারিক আদালতে সাংবিধানিকভাবে বিচারকার্য চালাতে আসামি, সাক্ষী এবং আইনজীবীদের সশরীরে উপস্থিতি প্রয়োজন হত। এ অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, কোনো ব্যক্তির ভার্চুয়াল উপস্থিতি নিশ্চিত করা হলেই তা সশরীরে আদালতে উপস্থিতি হিসেবে গণ্য হবে।
ভার্চুয়াল জুডিশিয়ালের মতামত:
ভার্চুয়াল কোর্টের বিষয়ে আইনমন্ত্রী অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার স্বপ্ন ছিল বাংলাদেশকে ডিজিটাল বাংলাদেশে রূপান্তর করা। সেই কাজ তিনি ১৯৯৬ সাল থেকে শুরু করেছিলেন। তারই আলোকে তিনি ই-জুডিশিয়ারি চালুর উদ্যোগ নিয়েছিলেন। এবারে ভার্চুয়াল আদালত চালুর মাধ্যমে বিচারিক প্রক্রিয়া ডিজিটাল যুগের নতুন অধ্যায়ে প্রবেশ করলো।
আইনমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাসের কারণে আদালত সীমিতভাবে খোলা থাকলেও আদালতের সব কাজ প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। এর মধ্যেও বিচারকাজ যেন থেমে না থাকে, সে কারণেই ভার্চুয়াল কোর্ট বসানোর পরিকল্পনা ছিল। সেটা করতেই আদালতের তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার অধ্যাদেশ ২০২০ জারি হয়েছে।
আইনজীবীরা বলছেন, আমাদের সংবিধান, ফৌজদারি ও দেওয়ানি কার্যবিধি, সাক্ষ্য আইন এবং আরও কিছু আইনে বলা আছে, আদালতে যখন বিচারকাজ চলবে, তখন সংশ্লিষ্টদের সশরীরে উপস্থিত থাকতে হবে। ভার্চুয়াল আদালত চালুর ক্ষেত্রে এটিই ছিল মূল প্রতিবন্ধকতা। নতুন অধ্যাদেশে সেই প্রতিবন্ধকতাই দূর করা হয়েছে। বলা হয়েছে, এই ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে উপস্থিত থাকলে তাকে সশরীরে উপস্থিত থাকা বলে গণ্য করা হবে।
ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর বিষয়ে জানতে চাইলে অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা রোববার (১০ মে) রাতে সারাবাংলাকে বলেন, এই সময়ে ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনায় যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে এটি একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত হয়েছে। সরকারের এ সিদ্ধান্তে আমি খুবই আনন্দিত। এজন্য প্রধান বিচারপতি ও আইনমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই।
তিনি বলেন, দীর্ঘ দিন ধরে আদালত বন্ধ রয়েছে। ভার্চুয়াল কোর্ট চালুর মাধ্যমে কিছুটা হলেও সেই বন্ধ দশার অবসান হবে। এর মাধ্যমে দেশের বিচার বিভাগ প্রকৃত অর্থে ডিজিটাল যুগে প্রবেশ করল বলেও মত দেন তিনি।
ভার্চুয়াল কোর্ট পরিচালনায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের প্রস্তুতি কেমন— জানতে চাইলে মুরাদ রেজা বলেন, ভার্চুয়াল কোর্টে মামলা পরিচালনায় আমরা প্রস্তুত রয়েছি। অ্যাটর্নি জেনারেলসহ রাষ্ট্রপক্ষের ১০/১২ জন আইনজীবী মিলে প্রশিক্ষণ নিয়েছি। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ইউএনডিপি আজ (রোববার) এ বিষয়ে আমাদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়েছে। দুই থেকে তিন ঘণ্টা ধরে ভার্চুয়াল কোর্টে মামলা পরিচালনার বিষয়টি তারা আমাদের দেখিয়ে দিয়েছেন। বেশ কয়েকজন বিচারপতিও ছিলেন। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভার্চুয়াল কোর্টের মাধ্যমে বিচার বিভাগ ডিজিটাল বিচার ব্যবস্থায় প্রবেশ করল।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আইনজীবী খুরশীদ আলম খান সারাবাংলাকে বলেন, সরকারের এ উদ্যোগকে আমি স্বাগত জানাই। অবশ্যই এটি ইতিবাচক একটি পদক্ষেপ। এটি আরও আগে হওয়া উচিত ছিল। দেরিতে হলেও এটি একটি ভালো উদ্যোগ বলে আমি মনে করি। কেননা করোনাভাইরাসের কারণে দীর্ঘ দিন ধরে আদালত বন্ধ। মনে হচ্ছে দেশে কোনো আদালতই নেই।
এছাড়া বিচারপতি নুরুজ্জামানকে দেওয়া হয়েছে সুপ্রিম কোর্টের চেম্বার আদালত পরিচালনার দায়িত্ব। তিনি আগামী ১৪ ও ২০ মে বেলা সাড়ে ১১টা থেকে ভার্চুয়াল আদালতে শুনানি নেবেন।