গত শতাব্দীতে বিশ্বব্যাপী ঘটে গেছে মানবসভ্যতার ইতিহাসে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সংঘটিত সর্ববৃহৎ এবং সবচেয়ে ভয়াবহ যুদ্ধ, যার নাম দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ ভয়াবহতা ও নৃশংসতার দিক থেকে অতীতের সকল যুদ্ধকে ছাপিয়ে যায়। ১৯৩৯ সালের ১ সেপ্টেম্বর জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সূচনা হয়েছিল। অবশেষে ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট আজকের এই দিনে জাপানের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ ঘোষণার মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে লাখো মানুষের বেদনা আর মৃত্যুর করুণ ইতিহাস সৃষ্টি করে সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই দিনটি ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে’ (V-J Day) নামে পরিচিত।
তৎকালীন বিশ্বের সকল পরাশক্তি এবং বেশিরভাগ রাষ্ট্রই প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে জড়িয়ে পড়ে, সৃষ্টি হয় দুইটি বিপরীত সামরিক জোট- মিত্রশক্তি আর অক্ষশক্তি। অক্ষশক্তির নেতৃত্বে ছিল প্রধান তিনটি রাষ্ট্র ইটালি, জাপান ও জার্মানি। এর মধ্যে জাপান ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে এশিয়া থেকে অংশগ্রহণকারী প্রধান অক্ষশক্তি রাষ্ট্র।
জার্মানির পোল্যান্ড আক্রমণের মধ্য দিয়ে বিশ্বজুড়ে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দামামা বেজে উঠেছিল। কিন্তু অনেক ঐতিহাসিক মনে করেন যে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের বীজ এর অনেক আগেই বপণ করা হয়েছিল। তারা এমন দাবি করেন, ১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই জাপানের চীন আক্রমণের মধ্য দিয়েই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরু হয়ে গিয়েছিল।
১৯৩৭ সালের ৭ জুলাই জাপান চীন আক্রমণ করলে দ্বিতীয় চীন-জাপান যুদ্ধ শুরু হয়। এই ঘটনাটি ইতিহাসে মার্কো পোলো ব্রিজ ঘটনা নামে পরিচিত। সেই হিসেবে জাপানের চীন আক্রমণের ঘটনাকে দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের সূত্রপাত হিসাবে ধরা হলে, জাপানের কর্মকাণ্ড দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধকে উসকে দিয়েছিল এমনটি তো বলাই যায়! আবার এই বিধ্বংসী যুদ্ধের সমাপ্তিও হয়েছিল জাপানের আত্মসমর্পণের মাধ্যমে।

দ্বিতীয় চীন- জাপান যুদ্ধ ; ইমেজ সোর্স : Reconciliation of Nation
অন্য সকল যুদ্ধ থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তিও ছিল আলাদা। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মিত্রশক্তি অক্ষশক্তির বিপরীতে বিজয়ী হয়েছিল। অন্য সকল যুদ্ধের ন্যায় এই যুদ্ধে পরাজিত অক্ষশক্তির আত্মসমর্পণ করার দিনটিকে ‘বিজয় দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছিল বিজয়ী মিত্রশক্তি। তবে অতীতের অন্য সকল যুদ্ধ থেকে আলাদা এই যুদ্ধে মিত্রশক্তির বিজয় এসেছে দু্’ইটি ভিন্ন ধাপে। যার কারণে মিত্রশক্তি এই দু’ইটি দিনকে আলাদাভাবে যুদ্ধ জয়ের দিন বা বিজয় দিবস হিসেবে উদযাপন করে। এর প্রথমটি ‘ভিক্টোরি ইন ইউরোপ ডে’ (V-E Day) এবং দ্বিতীয়টি ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে’ (V-J Day) হিসেবে পালিত হয়।
১৯৪৫ সালের ৮ মে জার্মানি আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। জার্মানির চূড়ান্ত পতনের মধ্য দিয়ে ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন নিভে যায়, সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ইউরোপ পর্ব। ভিক্টোরি ইন ইউরোপ ডে’টি (V-E Day) প্রতি বছর মে মাসের ৮ তারিখ পালিত হয়।
কিন্তু জার্মানির পতনের সাথে সাথে বিশ্ব থেকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আগুন পুরোপুরি নিভে যায়নি। ইউরোপ ছাড়িয়ে এই যুদ্ধ বিস্তার লাভ করেছিল এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে। ইউরোপের অক্ষশক্তির অন্যান্য রাষ্ট্রগুলো আরো অনেক আগেই মিত্রশক্তির কাছে আত্মসমর্পণ করলেও এশিয়ার রাষ্ট্র জাপান শত্রুর কাছে হার মানতে নারাজ ছিল। অবশেষে একই বছরের ১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে সমাপ্ত হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ। এই দিনটি মিত্রশক্তির দেশগুলোর কাছে পরিচিতি পায় ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে’ (V-J Day) নামে।
জেনে নেওয়া যাক, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দিনগুলোতে বর্তমান বিশ্বে শান্তিপ্রিয় জাতি হিসাবে পরিচিত জাপানিদের ভূমিকা কেমন ছিল? পৃথিবীজুড়ে কেমন ছিল ৭৫ বছর আগের আজকের দিনটি এবং মনে রাখার মতো কী এমন ঘটেছিল সেই দিনে?
পার্ল হারবার থেকে হিরোশিমা এবং নাগাসাকি পর্যন্ত জাপানের ভূমিকা
বর্তমান বিশ্বে জাপানিদের পরিচয় খুবই শান্তিপ্রিয় এবং অমায়িক চরিত্রের অধিকারী হিসেবে। অমায়িক ব্যবহারে দুনিয়ার তাবৎ মানুষকে তাক লাগিয়ে দেওয়া আজকের জাপানকে দেখলে কোনো ভাবেই মনে হয় না যে, এরাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় এর শত্রুদের কাছে সবচেয়ে মারাত্মক, দক্ষ এবং বর্বর বাহিনীগুলোর একটি ছিল।
তখন জাপানের সামরিক বাহিনীর নাম ছিল ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ মিলিটারি’। সেসময়ের জাপানের সম্রাট হিরোহিতো মূলত জাপানকে একটি শক্তিশালী মিলিটারি শাসিত রাষ্ট্র হিসেবে পড়ে তুলতে চেয়েছিলেন। যে কারণে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শুরুর অনেক আগে থেকেই জাপানের সামরিক বাহিনী এশিয়ার বিভিন্ন দেশে ক্ষমতা বিস্তারের উদ্দেশ্যে আক্রমণ করে আসছিল। আর এক্ষেত্রে তাদের সবচেয়ে বড় প্রতিপক্ষ ছিল চীন।
জাপান ১৯৪১ সালের ৭ ডিসেম্বর যুক্তরাষ্টের পার্ল হারবার নৌঘাঁটি আক্রমণের মতো সমালোচিত ঘটনার জন্ম দেয়। এই আক্রমণে জাপান ২০টি আমেরিকান জাহাজ এবং ৩০০ টিরও বেশি বিমানকে বিকল বা ধ্বংস করেছে। জাপানের এই আক্রমণের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের ২৪০৩ জন নাবিক, সামরিক ও বেসামরিক নাগরিক নিহত এবং প্রায় এক হাজার মানুষ আহত হয়। এই আক্রমণের পর আমেরিকা জাপানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের রণাঙ্গনে আনুষ্ঠানিক আত্মপ্রকাশ করে। পার্ল হারবার আক্রমণের মাধ্যমে জাপান মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে সরাসরি যুদ্ধের ময়দানে নিয়ে এসেছিল। তখন জাপানি সামরিক বাহিনীর নাম ছিল ‘ইম্পেরিয়াল জাপানিজ মিলিটারি’। শুধুমাত্র পার্ল হারবার আক্রমণের মধ্যেই জাপানি সেনাবাহিনীর বর্বরতা থেমে ছিল না। ইম্পেরিয়াল জাপানিজ মিলিটারির সহিংসতার চিত্র দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পুরো সময়জুড়েই চোখে পড়ার মতো ছিল।

১৯৩১ সালে জাপানের দখল করা জাপান-চীনের মধ্যবর্তী মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে জাপান ব্যাপক হত্যাযজ্ঞ চালিয়েছিল। ১৯৪৫ সালে রাশিয়া এবং মঙ্গোলিয়ার যৌথ অভিযানের আগ পর্যন্ত জাপান মাঞ্চুরিয়া অঞ্চলে তার কর্তৃত্ব বজায় রেখেছিল।
জাপানি সেনাবাহিনীর নির্মমতার শিকার হওয়া দেশগুলোর মধ্যে অন্যতম দক্ষিণ ও উত্তর কোরিয়া এবং চীন। এছাড়াও জাপানের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে ব্রিটেন এবং কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর আনুমানিক ৭১ হাজার সৈনিক নিহত হয়। যাদের মধ্যে শুধু ১২ হাজার সামরিক ও বেসামরিক লোক মারা যায় জাপানের হাতে যুদ্ধবন্দী অবস্থায়।
ইউরোপে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের লড়াই থেমে গিয়েছিল ১৯৪৫ সালের ৭ই মে। কিন্তু জাপানি বৈমানিক যোদ্ধারা তখনও বিমান নিয়ে বিভিন্ন আমেরিকান লক্ষ্যবস্তুতে আত্মঘাতী হামলা বা ‘কামিকাজি’ চালিয়ে যাচ্ছিল।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় জাপানি সামরিক বাহিনী, ইম্পেরিয়াল জাপানিজ আর্মি, লুটপাট থেকে শুরু করে গণহত্যা, নরমাংসভক্ষণ, রাসায়নিক অস্ত্র ব্যবহার, জোরপূর্বক শ্রম আদায়, যৌন দাসত্ব– এমন কিছুই ছিল যা বাদ রেখেছিল। মিত্রবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের আগপর্যন্ত জাপানি সামরিক বাহিনী তাদের ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়ে গিয়েছিল।
জার্মানির আত্মসমর্পণের পর, ১৯৪৫ সালের ২৬ জুলাই মিত্রশক্তির নেতারা একটি পোষ্টডাম ঘোষণার মাধ্যমে জাপানকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানায়। মিত্রশক্তির নেতারা জাপানকে ২৮ জুলাই পর্যন্ত আত্মসমর্পণের সময়সীমা বেঁধে দেয়। কিন্তু বেঁধে দেওয়া এই সময়সীমার মধ্যে জাপান আত্মসমর্পণ করেনি।
জাপান আত্মসমর্পণের রাজি না হওয়ায়, যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্র প্রধান হ্যারি ট্রুম্যান জাপানের হিরোশিমায় পারমাণবিক আক্রমণের নির্দেশ দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে পার্ল হারবার আক্রমণের প্রতিশোধ হিসেবে ১৯৪৫ সালের ৬ আগস্ট হিরোশিমায় মানব ইতিহাসের প্রথম পারমাণবিক বোমা নিক্ষেপ করে। জাপানের পাঁচ বর্গমাইল এলাকা পুরোপুরি ধ্বংস করে দিয়েছিল এই পারমাণবিক আক্রমণ।
এবার যুক্তরাষ্ট্র ভেবেছিলো, জাপান বুঝি লেজ গুটিয়ে পালাবে। কিন্তু না, তা হয় নি। জাপান সব কিছুকে ছাপিয়ে শত্রুর বিরুদ্ধে যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেয়।
৯ আগস্ট, সোভিয়েত ইউনিয়ন জাপানের বিরুদ্ধে আনুষ্ঠানিক যুদ্ধের ঘোষণা করে। অন্যদিকে জাপানিদের যুদ্ধ চালিয়ে যাবার সিদ্ধান্তে ক্রুদ্ধ ট্রুম্যান জাপানের উপর দ্বিতীয় দফা বোমা নিক্ষেপের নির্দেশ দেন। তার নির্দেশে অনুযায়ী, যুক্তরাষ্টের সামরিক বাহিনী ৯ আগস্ট জাপানের বন্দরনগরী নাগাসাকির উপর পারমাণবিক হামলা চালায়।

একদিকে যুক্তরাষ্টের পারমাণবিক আক্রমণ আর অন্যদিকে সোভিয়েত বাহিনী সীমান্তের কাছাকাছি চলে আসায় জাপান একদম কোণঠাসা হয়ে পড়েছিল। এবার তারা বুঝতে পেরেছিল, শত্রুর বিপরীতে যুদ্ধে টিকে থাকা আর সম্ভব হবে না।
১৫ ই আগস্ট (সময়ের পার্থক্যের কারণে যুক্তরাষ্ট্রে ১৪ আগস্ট) বিকেলে একটি রেডিও ভাষণে জাপানের সম্রাট হিরোহিতো তার দেশের সামরিক ও সাধারণ জনগনকে আত্মসমর্পণকে মেনে নেওয়ার আহ্বান জানান। এই সময় তিনি তাদের পরাজয়ের জন্য হিরোশিমা এবং নাগাসাকির উপর সম্পূর্ণ নতুন এবং নিষ্ঠুর পারমাণবিক বোমার ব্যবহারকে দায়ী করে বলেছিলেন,
“আমরা কি লড়াই চালিয়ে যেতে চাই,” এটি কেবল জাপানি জাতির চূড়ান্ত পতন ও বিলুপ্তির কারণ হবে না, বরং সম্পূর্ণ মানব সভ্যতাকে বিলুপ্তির দিকে পরিচালিত করবে।
ইউরোপজুড়ে জাপানি আত্মসমর্পণের প্রতিক্রিয়া
পরাজয় নিশ্চিত জেনে জাপান ১৯৪৫ সালের ১৫ আগস্ট (১৪ আগস্ট যুক্তরাষ্ট্র) ও তার মিত্র দেশগুলোর কাছে আত্মসমর্পণের ঘোষণা দেয়। একই দিন যুক্তরাষ্টের রাষ্ট্রপ্রধান হ্যারি এস. ট্রুম্যান হোয়াইট হাউস থেকে একটি পোষ্টডাম সম্মেলনের মাধ্যমে জাপানিদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের কথা ঘোষণা করে বলেন,
“পার্ল হারবার আক্রমণের পর থেকে আমরা আজকের দিনটির জন্য অপেক্ষা করছিলাম। আজকের এই দিনে ফ্যাসিবাদের মৃত্যু ঘটল, যেমনটি আমরা সবসময় জানতাম যে, এটি হবে।”
১৫ ই আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণের সংবাদ ঘোষণার সাথে সাথে সমগ্র ইউরোপ জুড়ে প্রশান্তির বাতাস বয়ে যায়, একইসাথে শুরু হয় বিজয়ের আনন্দ উল্লাস।
জাপানের আত্মসমর্পণের ঘোষণা প্রকাশের দিন অর্থাৎ ১৫ আগষ্টকে অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, নেদারল্যান্ড, নিউজিল্যান্ড, উত্তর কোরিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া ও যুক্তরাজ্য ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে’ (V-J Day) হিসেবে ঘোষণা করে। মিত্রশক্তির অন্যান্য দেশগুলোও এই দিন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের দুর্বিষহ দিনগুলো ভুলে বিজয়ের আনন্দে মেতে উঠে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তি সম্পর্কে ইতিহাসবিদ ডোনাল্ড এল. মিলার তার ‘দ্য স্টোরি অফ ওয়ার্ল্ড ওয়ার টু’ বইতে লিখেছিলেন,
“গভীরভাবে চিন্তা করলে খুব বেশি মৃত্যু, খুব বেশি বর্বরতা ও দুর্ভোগ ছিল; এবং ১৯৪৫ সালের আগস্টে কেউ তা গণনা করছিল না। যারা যুদ্ধের সম্মুখীন হয়েছে, শিবিরগুলিতে এবং বোমার আড়ালে ছিল – এবং যারা বেঁচে ছিল – তাদের প্রচুর স্বস্তি অনুভূত হয়েছিল।”
এমনটি প্রায়শই শোনা যায়, পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত যত নৃশংস ঘটনা ঘটেছে, তার কোনোটিই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের নৃশংসতাকে হার মানাতে পারেনি। তাই দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির দিনটি ছিল মিশ্র প্রতিক্রিয়ায় পরিপূর্ণ।
আত্মসমর্পণ দলিলে জাপানের আনুষ্ঠানিক স্বাক্ষর
২ সেপ্টেম্বর, জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মামোরু শিগেমিটসু এবং জাপানের সেনাবাহিনীর প্রধান যোশিজিরো উমেজু সহ অ্যালাইডের সুপ্রিম কমান্ডার জেনারেল ডগলাস ম্যাক আর্থারের উপস্থিতিতে টোকিও উপসাগরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধজাহাজ মিসৌরিতে জাপান আত্মসমর্পণ দলিলে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষর করে। এতে বিগত ছয় বছর ধরে চলা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তি হয়।
জাপান ১৪ আগস্ট, আত্মসমর্পণের ঘোষণা দিলেও ২ সেপ্টেম্বর আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষর করে। তাই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ২ সেপ্টেম্বরকে আনুষ্ঠানিক ‘ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে’ ঘোষণা করে। অন্যদিকে সময়ের পার্থক্যের কারণে জাপানের আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের সময় মিত্রশক্তির অন্যান্য দেশ চীন, হংকং, ফিলিপাইন ও তাইওয়ানে দিনটি ছিল ৩ সেপ্টেম্বর।

বছরের পর বছর ধরে পালিত হচ্ছে ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে (V-J Day)
জাপানিরা ১৫ আগস্টকে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ অবসানের স্মৃতি দিবস হিসেবে পালন করে। জাপানের সংবিধানে এই দিনটির আনুষ্ঠানিক নাম ‘ডে ফর মোর্নিং অফ ওয়ার ডেড অ্যান্ড প্রেয়িং ফর পিস’। এই নামটি ১৯৮২ সালে জাপানের সংবিধানে যুক্ত করা হয়।
১৯৮০ এবং ১৯৯০-এর দশকে দিনটিকে বৈষম্যমূলক মনোভাব সৃষ্টির কারণ বলে চিহ্নিত করে দিনটি মুছে ফেলার বা পুনঃনামকরণের জন্য বেশ কয়েকটি প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছিল। যদিও সবগুলি ব্যর্থ হয়েছিল, রোড আইল্যান্ড জেনারেল অ্যাসেম্বলি ১৯৯০ সালে একটি প্রস্তাব পাস করে বলেছিল যে, “এটি বিজয় দিবস, কিন্তু হিরোশিমা এবং নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমার কারণে ধ্বংস এবং মৃত্যুর জন্য সন্তুষ্টি প্রকাশ করার দিন নয়।”
বর্তমানে আমেরিকার অন্যতম নিকটতম সহযোগী রাষ্ট্র জাপান। আমেরিকানদের পারমাণবিক ধ্বংসযজ্ঞ নিয়ে ব্যাপক আলোচনা ও সমালোচনার কারণে ভিক্টোরি ওভার জাপান ডে (V-J Day) উদযাপন বছরের পর বছর ধরে জাপানিদের পক্ষে চলে যায়।
১৯৯৫ সালে, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সমাপ্তির ৫০ তম বার্ষিকীতে আমেরিকার রাষ্ট্রপ্রধান বিল ক্লিনটন প্রশাসন এই দিনকে ওভার জাপান ডে হিসেবে উল্লেখ করেনি। উপরন্তু তার প্রশাসন এই দিবসের আনুষ্ঠানিক স্মরণ অনুষ্ঠানে “প্রশান্ত মহাসাগরীয় যুদ্ধের সমাপ্তি দিবস” (V-P Day) বলে উল্লেখ করেছিল।
এই সিদ্ধান্তের ফলে মার্কিন প্রশাসনের উপর অভিযোগ উঠেছিল যে, ক্লিনটন জাপানের প্রতি অত্যধিক শ্রদ্ধাবনত হচ্ছেন। আমেরিকান সেনাবাহিনীকে যুদ্ধবন্দি হিসেবে জাপানি বাহিনীর হাতে ভোগান্তি পোহাতে হয়েছিল, কিন্তু তিনি জাপানের প্রতি শ্রুতিমধুর সংবেদনশীলতা প্রকাশ করেছেন।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে মারা গিয়েছিল সাত থেকে আট কোটি লোক। যা ছিল পুরো পৃথিবীর সেই সময়ের জনসংখ্যার প্রায় ৩%। নিহতদের অধিকাংশই ছিল বেসামরিক সাধারণ জনগন। এই বিশাল ধ্বংসযজ্ঞের ভয়াবহতা মানব সভ্যতাকে আরেকবার নতুন করে ভাবতে বাধ্য করেছিল যে, সহিংসতা কখনই কোনো উদ্দেশ্য অর্জনের পথ হতে পারে না।
জাপানের বর্তমান জনসংখ্যার প্রায় ৮০ শতাংশের বেশি দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর প্রজন্মের। তাই ওই যুদ্ধ নিয়ে তাদের হয়তো কিছু করার নেই। তবে জাপান বরাবরই যুদ্ধের সময়ের নিজ কর্মের জন্য গভীর দু:খ এবং অনুশোচনাবোধ করে আসছে। ১৯৪৫-এর ২ সেপ্টেম্বর জাপান আনুষ্ঠানিকভাবে আত্মসমর্পণের চুক্তি স্বাক্ষর করে। তাই এই দিনটিকেই ভয়াল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সমাপ্তির দিন হিসেবে বিবেচনা করা হয়। কিন্তু ১৫ আগস্ট জাপানের আত্মসমর্পণ ঘোষণা প্রকাশের দিনটিকেই জাপানি নির্মমতার শিকার হওয়া দেশগুলো বিজয়দিবস হিসেবে পালন করে আসছে।
তথ্য সূত্র :