বর্তমানে ইঞ্জিনিয়ারিং কোন বিষয় বললেই সবাই মোটামুটি সিএসই বা ইলেক্ট্রিক্যাল এন্ড ইলেক্ট্রোনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং (ইইই) বুঝে। অনেক ক্ষেত্রে সিভিলের নামটাও শুনা যায়। তবে সিএসই বা ইইই বা সিভিলের মত অত প্রচলন না হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং। বিষয়টি কি, কি কি পড়ানো হয় আর ভবিষ্যৎ কেমন এ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হলো-
বিষয়টি আসলে কি?
ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং হলো মূলত প্রকৌশল, পদার্থবিজ্ঞান এবং রসায়ন নীতিগুলির একীভূত একটি বিষয়। এটি মূলত উপকরণগুলির কাঠামো , প্রক্রিয়াকরণ ও বৈশিষ্ট্যসমূহ সম্পর্কিত জ্ঞান। আধুনিক এমএসইতে প্রচলিত ধাতববিদ্যা থেকে শুরু করে জৈবিক উপকরণ, পলিমার, সিরামিকস, সেমিকন্ডাক্টর, কমপোজিটস এবং অপটিক্যাল এবং চৌম্বকীয় উপকরণ এবং সেইসাথে অসংখ্য ন্যানো টেকনোলজির সামগ্রী রয়েছে।

কি পড়ানো হয়?
আমাদের চারপাশে যা কিছু আছে সব কিছু কোন না কোন উপাদান দিয়ে তৈরি। আর এই ‘উপাদান’ নিয়েই এম এম ই। নামে ধাতবকৌশল দেখে ভাবার দরকার নেই শুধু ধাতু এবং সংকর ধাতু নিয়ে এম এস ই। বরং আমাদের বাড়ির চামচ থেকে যুদ্ধের ময়দানের ট্যাঙ্ক, পানির নিচের সাবমেরিন থেকে মহাকাশযান- সব কিছুর সাথেই এমএসই এর সম্পর্ক। সকল বস্তুকে ৫টি প্রধান ভাগ(মেটাল, সিরামিক, সেমিকন্ডাক্টার, পলিমার, কম্পোজিট) করে কাজ করে এমএসই।
মেটালঃ কিভাবে খনি থেকে আকরিক আহরণ করা হয়, কিভাবে তা থেকে ধাতু নিষ্কাশন করা হয়, সংকর ধাতু কিভাবে তৈরি করলে তা মানুষের বেশি কাজে আসবে কিন্তু খরচ হবে কম, কিভাবে রিসাইকেল করে কোন ধাতব বস্তুকে কাজে লাগানো যায়, জাহাজ, প্লেন, মহাকাশযান, গাড়ির বডি,ইঞ্জিনের উপাদান কি হবে যেন তা সহজে নস্ট না হয়, পানিতে ক্ষতিগ্রস্থ না হয় এরকম হাজারো ব্যাপার।

সিরামিকঃ বাসার নিত্য প্রয়োজনীয় থালা-বাসন,মেঝের টাইলস ছাড়াও সিরামিকের বিশাল একটা ক্ষেত্র আছে। উচ্চতাপমাত্রায় কাজ করার যন্ত্র, অপটিক্যাল ফাইবার, ইনসুলেটর, সিমেন্ট, কৃত্তিম অঙ্গ তৈরি এরকম অনেক জায়গায় সিরামিক লাগে।
সেমিকন্ডাক্টারঃ ইলেক্ট্রিক চিপ এখন সব যায়গায়। আর এমএসই এর কাজের একটা বড় ক্ষেত্র এখানে।কিভাবে কোন ইলেক্ট্রনিক ম্যাটেরিয়াল কাজ করবে, কত ভোল্টেজ, তাপমাত্রা পর্যন্ত সহ্য করতে পারবে এসবই নির্ভর করে উপাদানের উপর। আর উপাদান মানেই এমএসই।কিভাবে ইলেক্ট্রনিক স্ট্র্যাকচার চেঞ্জ হয়, ব্যান্ড থিওরি, কোয়ান্টাম স্ট্র্যাকচার যেমন quantum well , quantum dot এসব নিয়েও কাজ হয় এমএসইতে
পলিমারঃ পলিমার কি তা আলাদা করে বলার দরকার পড়বে না। পলিমারের প্রচুর জিনিস আমরা ব্যবহার করি। এসবের প্রস্তুতি,গুনগত মান রক্ষা সবই এম এমইর আওতায় পড়ে।
কম্পোজিটঃ উপরের ৪ প্রকার ম্যাটেরিয়ালের সমন্বয়ে যেসব বস্তু বানানো হয় তারাই এর অন্তর্ভুক্ত। শুধু ধাতু বা সিরামিকের তৈরি কোন কিছুর মান উন্নয়নে অন্য কিছু যোগ করে তৈরি হয় কম্পোজিট। খেলার র্যারকেট, আধুনিক উচ্চ গতির প্লেনের বডি, বুলেটপ্রুফ ভেস্ট বা গ্লাসসহ আরো অনেক কিছুই কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালসের আওতায় পড়ে।

কোথায় পড়ানো হয়?
ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টটি বাংলাদেশের ৪ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাড়াও বিভিন্ন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেমনঃ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে রয়েছে। এর মধ্যে রাজশাহী প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে ২০১৬ সালে উক্ত ডিপার্টমেন্ট টি চালু করা হয়।এছাড়াও খুলনা প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় এবং বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ে উক্ত ডিসিপ্লিনের কার্যক্রম চালু আছে। এছাড়া ২০১৯ শিক্ষাবর্ষে চট্টগ্রাম প্রকৌশল ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ে এই বিষয়টির কার্যক্রম শুরু হয়েছে।
চাকুরী ক্ষেত্র
- একজন ম্যাটেরিয়াল ইন্জিনিয়ারের প্রধান কর্মক্ষেত্র হচ্ছে গবেষণাগার।মিলি মাইক্রো ন্যানো পর্যায়ের পর্যন্ত ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র পর্যবেক্ষণ এবং মানোন্নয়নের মাধ্যমেই কর্মপরিসরে বিস্তৃত হওয়ার সুযোগ থাকছে।
- সরকারী/স্বায়ত্তশাসিত/সশস্ত্রবাহিনীতে চাকুরি: BCSIR, Atomic Energy Commission, BITAC, PDB, Bangladesh Machine Tools Factory, Bangladesh Ordinance Factory(সশস্ত্র ও প্রতিরক্ষা বাহিনীর জন্য বন্দুক, কার্তুজ, গ্রেনেড প্রস্তুতকারক), Bangladesh Army EME Corps, Bangladesh Air Force Engineering Corps.
- দেশে চাকুরীর ক্ষেত্র: স্টিল শিল্প, সিরামিক শিল্প, খাদ্য প্যাকেজিং শিল্প, গ্যাস ক্ষেত্র, পাওয়ার জেনারেশন কোম্পানি, ওয়ালটন গ্রুপের মতো উচ্চ প্রযুক্তির উৎপাদন শিল্প।
- বিদেশে গবেষণা ও চাকুরির ক্ষেত্র: নভোযান গবেষণা প্রতিষ্ঠান , সেমিকন্ডাক্টর ও ইলেকট্রনিক ইন্ডাস্ট্রি , পলিমার ইন্ডাস্ট্রি ,অটোমোটিভ বায়োমেডিক্যাল,ন্যানোটেকনোলজিক্যাল ইন্ডাস্ট্রি,মাইনিং ইন্ডাস্ট্রি এবং বিল্ডিং ম্যাটেরিয়াল তৈরির ইন্ডাস্ট্রি।
- যদি কারো গবেষণার ইচ্ছা থাকে তবে নিয়ে নিতে পার চিন্তা ছাড়াই। বাংলাদেশে খুব বেশি গবেষণার সুযোগ না থাকলেও বিশ্বে যত গবেষণা হয় তার মধ্যে অন্যতম একটি শাখা ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্স। তাই ব্যাচেলর ডিগ্রি নিয়ে বিদেশে চলে যেতে পার আর নিজের মত নতুন একটি ম্যাটেরিয়াল আবিষ্কার করে পৃথিবীকে চমকে দিতে পার।
- ক্যান্সার সহ বিভিন্ন জটিল রোগের গবেষণায় এমএসই এখন অনেক ভুমিকা রাখছে। হাড়,দাঁত প্রতিস্থাপন, কৃত্তিম পা, হাত সবই ম্যাটেরিয়ালস সায়েন্টিস্টরা করছে। কারণ মানুষের দেহে এসব প্রতিস্থাপন করতে হলে এমন উপাদান হতে হবে যা শরীরের কোন ক্ষতি করবে না। আর উপাদান মানেই তো এমএসই।হয়তো তোমাদের মধ্যেই কেউ কম খরচে কৃত্তিম কিডনি বা সেরকম কিছু বানাবে, ক্যান্সারকে নির্মূল করবে- বাঁচাবে হাজার হাজার প্রান।
- এমএমই এর কাজের ক্ষেত্র আরো বড়। ন্যানোটেক,বায়ো মেডিকেল, ইলেকট্রিক্স এরকম বিষয়ে পড়ার ইচ্ছা ছিল, ইচ্ছা ছিল ইইই পড়ে ওসব করবে কিন্তু ইইই পাচ্ছো না, তাদের বলছি তোমাদের আশা এখনো আছে কারণ এমএসই থেকেই এসব এসেছে। তাই ভবিষ্যতে এসবের পড়ার ভালো সুযোগ এখনো তোমার আছে। Intel, IBM এর মত প্রতিষ্ঠানে কাজ করারও সুযোগ রয়েছে এখান থেকে।
গবেষণার সুযোগ
ন্যানোটেকনোলজি: পরবর্তী ১০-১৫ বছরের মধ্যেই আমরা খুব সম্ভবত সিলিকন এজ থেকে ন্যানো এজে প্রবেশ করবো। ন্যানো নিয়ে তো আশা করি আমরা সবাই ই জানি। ন্যানো টেকনোলজির উন্নতির ফলে ইলেক্ট্রনিক প্রপার্টিগুলো, অপ্টিওইলেক্ট্রিক এবং ফিজিক্যাল প্রপার্টিসগুলোর ব্যাপক উন্নতি সাধন হবে।
মাল্টিফাংশনাল ম্যাটেরিয়াল: নরমাল যে ম্যাটেরিয়ালস যেমন মেটাল, পলিমার অথবা সিরামিক গুলো দেখি এগুলোর মোডিফাইড ভার্সন ই হলো মাল্টিফাংশনাল ম্যাটেরিয়ালস। এই মাল্টিফাংশনাল ম্যাটেরিয়ালিস গুলো এনভায়রনমেন্ট চ্যাঞ্জের সাথে সাথে নিজের প্রপার্টিসগুলো ও চ্যাঞ্জ করতে পারে। এক্সাম্পল হিসেবে আমরা শেইপ মেমোরি এলয়, পাইজোইলেক্ট্রিক ম্যাটেরিয়ালস, সুপার কন্ডাক্টিভ ম্যাটেরিয়ালস গুলোর নাম নিতে পারি।
কম্পোজিট ম্যাটেরিয়ালস: এটা তো ম্যাটেরিয়ালস এর ই একটা বেসিক টাইপ। যেখানে তুমি কোনো একাধিক টাইপের কোনো ম্যাটেরিয়ালের কম্বাইন ঘটিয়ে নতুন একটা ম্যাটেরিয়াল তৈরী করতে পারো যেখানে ইউজড ডিফারেন্ট ম্যাটেরিয়াগুলোর বেস্ট ক্যারাক্টারিস্টিকসের সমন্বয় ঘটবে। যেমন: কার্বন ফাইবার পলিমার যেখানে একইসাথে পলিমার আর গ্লাস এর প্রপার্টিস গুলোর সমন্বয় ঘটেছে।
এনার্জি ইঞ্জিনিয়ারিং: নতুন এমন কিছু ম্যাটেরিয়ালস এর উদ্ভাবনের চেষ্টা চলছে যা খুব অল্প এনার্জি কন্সাম্পসনে হাইয়ার এফিসিয়েন্সি দেখাবে।ফিজিক্যাল মেটালার্জি:এই ফিল্ডের মানুষগুলো প্রতিনিয়ত ই মাইক্রোস্ট্রাকচার এর প্রপার কন্ট্রোল এর মাধ্যমে ম্যাটেরিয়াল এর প্রপার্টিসগুলো উন্নত করার চেষ্টায় রত আছে।
এছাড়া গবেষণার আরো কয়েকটা স্কোপ হলো নিউক্লিয়ার ম্যাটেরিয়ালস,পাউডার ম্যাটালার্জি,থিন ফিল্মস,মেটালিক গ্লাস ইত্যাদি।
একজন ইঞ্জিনিয়ারিংপ্রেমী ও গবেষণায় যদি ঝোক থেকে থাকে তবে ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স এন্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সাবজেক্টটি তোমাদের জন্য অনেক মজার একটি সাব্জেক্ট হবে বলে আশা আমাদের।
সংগৃহীত ও পরিমার্জিত