রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। অবিভক্ত উপমহাদেশ ভারত ও পাকিস্তানের বিভক্তের পর এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয়। উত্তরবঙ্গ তথা সারা বাংলাদেশে গৌরবের সাথে আজ ৬৮ বছর পেরিয়ে ৬৯ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। ১৯৫৩ সালের এই দিনে প্রাচ্যের ক্যামব্রিজ খ্যাত এই বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা লাভ করে।
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় দেশের চারটি স্বায়ত্বশাসিত বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর একটি। নাথান কমিশন কর্তৃক ১৯২১ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পর কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় গঠিত স্যাডলার কমিশনের মাধ্যমে বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সরব হয়ে ওঠে এ অঞ্চলের মানুষজন।
কারণ রাজশাহীর শিক্ষা ব্যবস্থা উন্নয়নে ১৮৭৩ সালে রাজশাহী কলেজ প্রতিষ্ঠিত হয়।সে সময়ে রাজশাহী কলেজে আইন বিভাগসহ পোস্ট গ্রাজুয়েট শ্রেণী চালু করা হয়৷ কিন্ত এর কিছুদিন পরেই বন্ধ হয়ে যায় এসব কার্যক্রম৷
মূলত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার পরপরই দেশে শিক্ষা ক্ষেত্রে এক নবজাগরণের সৃষ্টি হয়। কিন্তু সেই জাগরণ থেকে উত্তরবঙ্গ পিছিয়ে পড়তে পারে। তখন এই অঞ্চলে একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে সবাই কেননা দেশের খাদ্য শস্যের চাহিদা পূরণ করলেও উল্লেখযোগ্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সেভাবে এই অঞ্চলে গড়ে উঠে নি এবং যার ফলে উত্তরবঙ্গ নিতন্তই অবহেলিত ছিল।
তাই উত্তরবঙ্গের প্রধান শহর রাজশাহীতে একটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার জোর দাবি উত্থাপিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের পর রাজশাহীতে স্যাডলার কমিশনের সুপারিশ অনুযায়ী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার আন্দোলন শুরু হয়।
১৯৫০ সালের ১৫ নভেম্বর রাজশাহীর বিশিষ্ট ব্যক্তিদের নিয়ে ৬৪ সদস্য বিশিষ্ট একটি কমিটি গঠন করা হয়৷ রাজশাহীতে বিশ্ববিদ্যালয় ও মেডিকেল কলেজ স্থাপনের জন্য সর্বপ্রথম জনসভা অনুষ্ঠিত হয় ১৯৫২ সালের ১০ ফেব্রুয়ারি রাজশাহী শহরের ভুবন মোহন পার্কে ৷
প্রথম দাবি অবশ্য ওঠে রাজশাহী কলেজেই৷ ১৯৫২ সালের ৬ ফেব্রুয়ারি শহরের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা রাজশাহী কলেজ প্রাঙ্গনে সমবেত হয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ পাস করার দাবি তোলে৷
এরপর ১৯৫৩ সালের ৩১ মার্চ প্রাদেশিক আইনসভায় রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা আইন পাস হয়। ১৯৫৩ সালের ৬ জুলাই বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ড. ইতরাত হোসেন জুবেরীকে উপাচার্য নিয়োগের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিক কার্যক্রম শুরু হয়। পদ্মাতীরের বড়কুঠি নামে পরিচিত ঐতিহাসিক রেশমকুঠিতে কার্যক্রম শুরু হলেও ১৯৬১ সালে মতিহারের বর্তমান চত্বরে ক্যাম্পাসের গোড়াপত্তন হয়।
ভাষা আন্দোলনে প্রত্যক্ষ ভূমিকা না রাখতে পারলেও ৬২ এর শিক্ষা আন্দোলন, উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থান, মহান মুক্তিযুদ্ধে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা ছিল উল্লেখ করার মত। বিশেষ করে উনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানে ড. শামসুজ্জোহার আত্মত্যাগ ছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অবিচ্ছেদ্য অংশ।
কারণ ১৯৬৯ সালে যখন স্বৈরাচারী আইয়ুব খানের শোষণের বিরুদ্ধে এদেশের আপামর জনসাধারণ ফুঁসে উঠেছিল, তখন তাদের সঙ্গে একাত্মতা ঘোষণা করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরাও।
স্বৈরাচারী শাসকের বিরুদ্ধে মিছিল হয়েছে। সেখানে শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালাতে উদ্যত হয়েছিল সরকারের পোষা বাহিনী। শিক্ষার্থীরাও উন্মত্ত হয়ে উঠেছিল। এ সময় শিক্ষার্থী এবং সেনাবাহিনীর মধ্যে প্রতিবন্ধক হয়ে দাঁড়ান রসায়ন বিভাগের শিক্ষক এবং তৎকালীন প্রক্টর ড. শামসুজ্জোহা। সেনাবাহিনী তার বুকে গুলি চালিয়ে দেয়। ড. জোহা লুটিয়ে পড়েন রাস্তায়।
এছাড়াও মহান মুক্তিযুদ্ধেও ছিল রাজশাঈ বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমিকা। দেশের জন্য যুদ্ধে শহীদ হয়েছেন ত্রিশ জন ছাত্র, কর্মচারী-কর্মকর্তা। এছাড়া অধ্যাপক ও শিক্ষকদের মধ্যে জীবন দিয়েছেন শহীদ হবিবুর রহমান, শহীদ মীর আবদুল কাইয়ুম, শহীদ সুখরঞ্জন সমাদ্দার। অকথ্য নির্যাতন ভোগ করেছিলেন গণিত বিভাগের শিক্ষক মজিবর রহমান।
শুরুতে ৭ টি বিভাগ, ১৫৬ জন ছাত্র এবং ৫ জন ছাত্রী নিয়ে যাত্রা শুরু করে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়। তবে বর্তমানে প্রায় ৩৫ হাজার শিক্ষার্থী, ১০টি অনুষদ এবং ৫৭টি বিভাগ ও ৫ টি উচ্চতর গবেষণা ইনস্টিটিউট নিয়ে ৭৫৩ একর জায়গার বিশাল ক্যাম্পাস নিয়ে স্বমহিমায় দাঁড়িয়ে আছে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।
বিশাল সংখ্যক শিক্ষার্থীর চাপ সামলানোর পাশাপাশি তাদের উজ্জ্বল ভবিষ্যত গড়ায় কান্ডারি হিসেবে আছেন প্রায় ১৩০০ শিক্ষক-অধ্যাপক এবং আবাসিক সুবিধা হিসেবে আছে ১৭ টি হল। এর মধ্যে ছেলেদের জন্য ১১ টি এবং মেয়েদের জন্য রয়েছে ৬ টি হল।
বিশাল এই ক্যাম্পাসের পুরো নকশাটি করেন অস্ট্রেলিয়ার বিখ্যাত স্থপতি ড. সোয়ান টমাস। সৌন্দর্যের দিক দিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়কে অন্যতম সাজানো গোছানো ক্যাম্পাস হিসেবে মনে হয়। প্রতিবছর দেশের নানান প্রান্ত হতে অসংখ্য মানুষ শুধু সৌন্দর্য উপভোগ করতে এখানে আসে।
৭৫৩ একরের এই বিশাল ক্যাম্পাসে পড়াশোনা ও গবেষণার পাশাপাশি খেলাধুলার জন্য আছে একটি কটি পূর্ণাঙ্গ স্টেডিয়াম, সুইমিং পুল এবং ইনডোর গেমসের জন্য ইনডোর স্টেডিয়াম। সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিচালনার জন্য আছে কাজী নজরুল ইসলাম অডিটোরিয়াম।
এছাড়াও শিক্ষার্থীদের গবেষণামুখী করার জন্য প্রতিটি বিভাগে সেমিনার লাইব্রেরি থাকার পাশাপাশি রয়েছে প্রায় চার লাখ বই সংবলিত একটি আধুনিক গ্রন্থাগার। ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্, ড. এনামুল হক, হাসান আজিজুল হক, ড. এ বি এম হোসেন, ড. অরুণ কুমার বসাকের মতো প্রতিথযশা মনীষীরা এখানে পাঠদান করেছেন। ফলে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা জ্ঞানের বিভিন্ন শাখায় অবাধে বিচরণ করে নিজেদের সমৃদ্ধ করে চলেছেন।
প্যারিস রোডের নান্দনিক সৌন্দর্য এবং এর দু’পাশ দিয়ে আকাশছোঁয়া গগনশিরিষ গাছগুলো মোহিত করে রাখে বহুক্ষণ।প্রধান ফটক দিয়ে প্রবেশ করেই হাতের বামদিকে পড়ে সাবাস বাংলাদেশ মাঠ। সেখানে রয়েছে শিল্পী নিতুন কুণ্ডুর অসামান্য সৃষ্টি এবং মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবাহক সাবাস বাংলাদেশ ভাস্কর্য। প্রশাসন ভবনের সামনেই চোখে পড়বে ড. শামসুজ্জোহার সমাধি।
হাঁটি হাঁটি করে আজ ৬৮ বছর পেরিয়ে ৬৯ বছরে পদার্পণ করতে যাচ্ছে উত্তরবঙ্গের সর্ববৃহত এই শ্রেষ্ঠ বিদ্যাপীঠ। তবে বিভিন্ন সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতার মধ্য দিয়ে চলছে বিশ্ববিদ্যালয়ের কার্যক্রম। এক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আবাসন ব্যবস্থার পাশাপাশি প্রয়োজন ও চাহিদার তুলনায় কম বাজেট বরাদ্দকে প্রধান সমস্যা হিসেবে মনে করছেন অনেক। তবে সব সমস্যা ও প্রতিবন্ধকতা ছাপিয়ে আরো অনেক দূর এগিয়ে যাবে বলে আশা রাখা যায়।