সামনে কোরবানির ঈদ। এই ঈদে লাল মাংস খাওয়া পরবে বেশি। রেড মিট বা লাল মাংস নিয়ে নানা প্রচার-অপপ্রচার সমাজে প্রচলিত। এসব কারণে অনেকে এই মাংস খাদ্যতালিকা থেকে একেবারেই বাদ দিয়ে দিয়েছেন। আবার অনেকে এই মাংস খাবেন কিনা দ্বিধায় আছেন। লাল মাংসে উপকারিতার পাশাপাশি রয়েছে অপকারিতা বা স্বাস্থ্য ঝুঁকি।
রেড মিট বা লাল মাংস কি?
গরু, মহিষ, খাসি, ভেড়া প্রভৃতি পশুর মাংসকে রেড মিট বা লাল মাংস বলে। এতে মায়োগ্লোবিনের পরিমাণ অনেক বেশি থাকে বলে কাঁচা অবস্থায় টকটকে লাল দেখায়। পুষ্টিগুণের বিচারে লাল মাংস অনেক সমৃদ্ধ। এতে প্রচুর আয়রন, প্রোটিন, ভিটামিন বি, জিংক এবং অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজ রয়েছে, যা শরীর গঠনের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ। প্রোটিনের সমৃদ্ধ উৎস এই লাল মাংস হলেও এগুলোতে সম্পৃক্ত চর্বির (স্যাচুরেটেড ফ্যাট) মাত্রা থাকে বেশি। থাকে প্রচুর খারাপ কোলেস্টেরলও। ফলে বেড়ে যেতে পারে হৃদরোগ ও ডায়াবেটিসের ঝুঁকি।
উপকারিতা
লাল মাংস প্রোটিনের খুব ভালো উৎস। শরীরের বৃদ্ধি সাধন, ক্ষয়পূরণ ও শরীর গঠনে লাল মাংসের ভূমিকা অপরিসীম। দেহের অস্থি, পেশি, দাঁত, নখ, নানা দেহযন্ত্র প্রোটিন দিয়ে তৈরি। প্রোটিন থেকেই তৈরি হয় রোগ প্রতিরোধী অ্যান্টিবডি। প্রয়োজনীয় হরমোন তৈরিতেও প্রয়োজন এই প্রোটিনের। এ ছাড়া লাল মাংসে থাকে প্রচুর পরিমাণ আয়রন, ভিটামিন এ, বি, জিংক, ফসফরাস, সেলেনিয়াম প্রভৃতি খাদ্যোপাদান। তাই শরীরের জন্য লাল মাংসের প্রয়োজন আছে বৈকি।
বিশেষজ্ঞরা জানান, লাল মাংস যা গরুর মাংসে পাওয়া যায় তাতে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান থাকে। সাদা মাংসে মায়োগ্লোবিন নামে এক ধরনের আয়রন বা লোহাযুক্ত প্রোটিন কম থাকে, আয়রনের রং যেহেতু লাল তাই মায়োগ্লোবিন কম থাকার জন্য সাদা মাংসের রং হালকা থাকে। সাদা মাংস সাধারণত পোলট্রি অর্থাৎ মুরগি ও টার্কির কিছু কিছু অংশে যেমন বুকের মাংসপেশিতে পাওয়া যায় কিন্তু পায়ের রানের মাংসে আবার মায়োগ্লোবিন বেশি থাকায় মাংসের রং লাল।
সম্পৃক্ত চর্বিতে খারাপ কলস্টেরল বা এলডিএল কলস্টেরল বেশি থাকে ও এই কলস্টেরল শরীরের বিভিন্ন রক্তনালিতে জমা হয়ে রক্তনালিতে ব্লক বা অ্যাথেরোস্কেলোরেটিক প্লাক তৈরি করে। লাল মাংসে এলডিএল বা খারাপ কলস্টেরল বা সম্পৃক্ত চর্বি সাদা মাংসের তুলনায় বেশি থাকে। কিন্তু যে পাখি উড়ে যেমন হাঁস তাদের বুকের মাংসেও মায়োগ্লোবিন বেশি থাকায় মাংসপেশি লাল। মাছের মাংস সাদা মাংস।
লাল মাংস সাধারণত পশুর মাংসে বিশেষ করে গরুর মাংসে পাওয়া যায়। লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত মাংস স্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর কারণ লাল মাংসে সম্পৃক্ত চর্বির পরিমাণ বেশি থাকে ও লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত মাংসে পেটের নাড়ির ক্যান্সারের ঝুঁকি বেশি, লাল মাংস ও প্রক্রিয়াজাত মাংস পাকস্থলী, অগ্নাশয়, খাদ্য নালির ও অন্ত্রের ক্যান্সার করে। ধারণা করা হয় লাল মাংসে যে সম্পৃক্ত চর্বি বেশি থাকে তা ও লাল মাংস রান্নার সময় যে কার্সিনোজেন তৈরি হয় তা এবং মায়োগ্লোবিনের যে আয়রন থাকে তা কিছু পরিবর্তিত হয়ে যে যৌগ তৈরি করে তা ক্যান্সার হওয়ার জন্য দায়ী।
লাল মাংসের খাদ্য উপাদান এর উপকারি ও ক্ষতিকর দিক নিয়ে যুগান্তরকে পরামর্শ দিয়েছেন মেডিনোভা হাসপাতালের মেডিসিন ও হৃদরোগ বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মো. তৌফিকুর রহমান ফারুক।
লাল মাংস যা গরুর মাংসে পাওয়া যায় তাতে প্রচুর পরিমাণে প্রয়োজনীয় খাদ্য উপাদান থাকে। গরুর মাংসে আয়রন বা লোহা পাওয়া যায় যা অন্ত:সত্ত্বা নারী, বাড়ন্ত শিশু ও কিশোর-কিশোরীদের রক্তশূন্যতা প্রতিরোধ করে, এ লোহা বা আয়রন অন্ত্রে সহজে শোষিত হয়।
এ মাংসে প্রচুর পরিমাণে ভিটামিন বি১২ আছে যা রক্ত তৈরিতে ও স্নায়ু গঠনে ভূমিকা রাখে।
গরুর মাংসে প্রচুর পরিমাণে জিঙ্ক নামক মিনারেল বা খনিজ পদার্থ থাকে যা শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়। চর্বি ছাড়া গরুর মাংসে অর্থাৎ লিনকাট মাংসে যেহেতু চর্বির পরিমাণ অনেক কম থাকে ও প্রচুর প্রোটিন থাকে তাই ৩ আউন্স চর্বি ছাড়া মাংসে মাত্র ১৮০ ক্যালরি শক্তি থাকে কিন্তু ১০টিরও বেশি জরুরি খাদ্য উপাদান থাকে।
তাছাড়া যে গরু লালনপালনের সময় শস্যদানা বেশি খাওয়ানো হয় সে সব গরুর মাংসে চর্বি বেশি থাকে ও যে গরু লালনপালনের সময় বিভিন্ন ধরনের ঘাস বেশি খাওয়ানো হয় সেসব গরুর মাংসে চর্বি কম থাকে ও বেশি পরিমাণে হৃদবান্ধব ওমেগা-৩ অসম্পৃক্ত চর্বি বেশি থাকে।
ক্ষতিকর দিক
লাল মাংসের প্রধান ক্ষতি হলো, এর উচ্চ মাত্রার ট্রাইগ্লিসারাইড (টিজি) ও এলডিএল, যা ক্ষতিকর কোলেস্টেরল হিসেবে পরিচিত। এই কোলেস্টেরল ধমনির প্রাচীরকে পুরু করে তোলে। ফলে হৃপিণ্ডে রক্ত সঞ্চালন কমে যায়। এভাবে চলতে থাকলে একপর্যায়ে রক্তনালির ব্লক তথা হৃদরোগের অন্যতম কারণ হয়ে দেখা দেয়। সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, যাঁরা প্রতিদিন ১০০ গ্রামের বেশি লাল মাংস খান, তাঁদের হৃদরোগে মৃত্যুঝুঁকি ১৫ শতাংশ, ব্রেইন স্ট্রোকের ঝুঁকি ১১ শতাংশ এবং বৃহদন্ত্র ও প্রোস্টেট ক্যান্সারের ঝুঁকি প্রায় ১৭ শতাংশ বেশি।
লাল মাংসে থাকে এক বিশেষ ধরনের ইনফ্লামেটরি যৌগ, যা পাকস্থলীর প্রদাহের জন্য দায়ী। এই যৌগ পাকস্থলী, ক্ষুদ্রান্ত্র ও বৃহদন্ত্রের ক্যান্সারের জন্যও দায়ী। ফুসফুস আক্রান্ত হওয়া, কোলন ও স্তন ক্যান্সারেও এর ভূমিকা থাকে। যত বেশি লাল মাংস খাওয়া হবে, এসবের ঝুঁকি ততই বাড়ে। অতিরিক্ত লাল মাংস গাউট, আর্থ্রাইটিস, কোষ্ঠকাঠিন্য, পেপটিক আলসার, পিত্তপাথর, প্যানক্রিয়াসের প্রদাহ, কিডনি রোগ প্রভৃতি সৃষ্টি করতে পারে।
আপনার করণীয়
রেড মিট বা লাল মাংস খেলেই যে ক্ষতি হবে তা কিন্তু নয়। তাই ঢালাওভাবে এটা বাদ দেওয়াও ঠিক না। ক্ষতির বিষয়টি নির্ভর করছে মাংসের ধরন, সপ্তাহে কী পরিমাণ খাওয়া হচ্ছে, কী পদ্ধতিতে রান্না হচ্ছে তার ওপর। এ জন্য কিছু বিষয় মেনে চলা ভালো—
- কোরবানির পর মাংস কাটার সময় যতটা সম্ভব চর্বি কেটে বাদ দিন। রান্নার সময় মাংসের গায়ে লেগে থাকা জমাট সাদা চর্বি তুলে ফেলুন। মাংস টুকরো বা পাতলা ফালি করে কেটে এবং চর্বি ছাড়িয়ে রান্না করলে এর সম্পৃক্ত চর্বির মাত্রা কমে যায়।
- রান্নায় ঘি, মাখন বা ডালডার ব্যবহার না করে, কম তেলে রান্না করে সপ্তাহে এক, দুই দিন বা মাঝেমধ্যে ৫০-১০০ গ্রামের মতো টাটকা মাংস খেলে তেমন সমস্যা নেই।
- লাল মাংসে থাকে টিনিয়া সোলিয়াম নামের এক ধরনের বিশেষ কৃমিজাতীয় পরজীবী। ঠিকভাবে মাংস সিদ্ধ না হলে এই কৃমিতে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। শিক কাবাব, বারবিকিউ খেলে এর ঝুঁকি থাকে বেশি। এ জন্য কাবাব বা আধা সিদ্ধ মাংস পারতপক্ষে পরিহার করা শ্রেয়।
- মাংসের ভেতরে-বাইরে ভালোভাবে রান্না করা উচিত। রান্না করা মাংস বারবার জ্বাল দিয়ে বেশিদিন ধরে খাওয়া ঠিক নয়।
- একটানা কয়েক দিন লাল মাংস না খেয়ে গ্যাপ দিন। মাঝেমধ্যে সবজি বা মাছ খাওয়ার চেষ্টা করুন।
- কাঁচা মাংসে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ হয় খুব দ্রুত। তাই কোরবানির পর যত দ্রুত সম্ভব মাংস চুলায় বসান। আর ফ্রিজে রাখতে চাইলে যত দ্রুত সম্ভব সংরক্ষণ করুন।
- আঁশ বা ফাইবারসমৃদ্ধ খাবার খান প্রচুর। এসব খাবার চর্বি হজমে বাধা দেয় এবং কোষ্ঠ পরিষ্কার রাখতে সাহায্য করে। তাই খাদ্যতালিকায় সালাদ, সবজি, আঁশযুক্ত ফল, ইসবগুলের ভুসি, তোকমারির শরবত ইত্যাদি রাখুন। এতে লাল মাংসের ক্ষতিকর টক্সিন অন্ত্র থেকে সরে যায়, খারাপ কোলেস্টেরলও দূর হয়।
- বেশি করে পানি পান করুন। খাওয়ার অন্তত এক ঘণ্টা পর পানি খান।
প্রক্রিয়াজাত মাংস নয়
টাটকা বা ফ্রেশ লাল মাংসের চেয়ে প্রক্রিয়াজাত লাল মাংসের (সসেজ, সালামি, বেকন, লাঞ্চন মিটস, হট-ডগস্ ইত্যাদি) ক্ষতিকর দিক অনেক বেশি। এতে প্রচুর লবণ, নাইট্রেটস ও নানা রকম প্রিজারভেটিভ থাকে। প্রক্রিয়াজাত লাল মাংস দৈনিক ৫০ গ্রামের মতো গ্রহণে হৃদরোগের ঝুঁকি বাড়ে ৪২ শতাংশ আর ডায়াবেটিসের ঝুঁকি বাড়ে ১৯ শতাংশ। তাই সম্ভব হলে প্রক্রিয়াজাত মাংস এড়িয়ে চলুন।
রোগীদের জন্য সতর্কতা
- স্থূলতা, ডায়াবেটিস, রক্তচাপ বা হৃদরোগীরা লাল মাংস যথাসম্ভব বর্জন করুন কিংবা কম খান।
- ২৫ থেকে ৩০ বা এরও বেশি বয়সী, যাঁদের রক্তে কোলেস্টেরলের মাত্রা ২০০-এর বেশি, তাঁদের রেড মিট বা লাল মাংস না খাওয়াই ভালো।
- যাঁরা মুটিয়ে গেছেন, তাঁরা প্রতিদিন ব্যায়াম করুন বা হাঁটার অভ্যাস করুন। এতে গ্রহণ করা বাড়তি ক্যালরি বার্ন হয়। সাঁতার কাটা, সিঁড়ি ভাঙা, সাইকেল চালনা, বাগান পরিষ্কারের মতো কাজগুলো হতে পারে ভালো ব্যায়াম। সম্ভব হলে চেষ্টা করুন।
- যাঁরা গ্যাস্ট্রিক, আলসার, কোষ্ঠকাঠিন্য, অ্যানালফিশার ও পাইলসজাতীয় রোগে ভুগছেন, তাঁরা রান্নায় কম তেল ও মসলা ব্যবহার করে অল্প পরিমাণ মাংস খেতে পারেন।
- ইউরিক এসিড বেশি যাঁদের বা গিঁটে বাত ও কিডনি রোগীদের জন্য প্রাণিজ প্রোটিন ক্ষতিকর। এ ক্ষেত্রে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিন।
অধ্যাপক ডা. মো. আফজালুর রহমান
আরো পড়ুন,
বাংলাদেশে ফেসবুকের বিকল্প ‘যোগাযোগ’ আসছে
কিডনির যত্ন নেয়া হোক এখন থেকেই
করোনায় সুস্থ থাকতে ঘরে বসেই শরীরচর্চা করুন
ডেঙ্গু জ্বর: কারণ, লক্ষণ ও প্রতিরোধ