শিথিল করা হয়েছে লকডাউন। প্রথমে গার্মেন্টস কারখানা চালু করার পর শপিংমল খোলার ঘোষণা এসেছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমনের মুখেই। সরকারের গৃহীত এসব সিদ্ধান্ত অনেক আলোচনা সমালোচনার জন্ম দেয়। যখন সংক্রমনের হার শুধুই উদ্ধমুখী তখন এমন সিদ্ধান্ত ভাবিয়ে তুলছে বিশেষজ্ঞদের।
গত কয়েকদিনের গ্রাফ বিশ্লেষণে দেখা যায়, নতুন সংক্রমন উঠা নাম করলেও প্রতিদিনই কয়েকশো মানুষ নতুন করে আক্রান্ত হচ্ছেন। কিন্তু তার বিপরীতে সুস্থ হওয়ার হার অনেক কম।আর এই পরিস্থিতির মধ্যে বাংলাদেশে অধিকাংশ গার্মেন্টস কারখানা খুলেছে, খুলে দেওয়া হয়েছে মার্কেট। দোকানপাটে মানুষ আরও বেশী সময় ধরে কেনাকাটা করতে পারছেন, সীমিত পরিসরে চালু হয়েছে কিছু সরকারি দপ্তর।
“করোনা সংক্রমণের ঝুঁকি বিশ্লেষণ করে, নাকি অর্থনৈতিক চাপের কারণে এমন পদক্ষেপ নিচ্ছে সরকার?” এমন প্রশ্ন তৈরী হচ্ছে বিশেষজ্ঞদের মনে।
ভাইরোলজিস্ট অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “২৫ তারিখ(২৫ এপ্রিল) থেকে বেড়েই চলেছে। গত কয়েক দিন ধরে সংক্রমণের কাউন্ট উঠেই চলেছে। আর পুরো বাংলাদেশে একদিনে যদি সংক্রমণের সংখ্যা ৬০০ হয়, তাহলে দেখা যায় যে শুধু ঢাকা শহরেই হয় চারশো’। এই বিষয়টি খেয়াল রাখতে হবে।”
বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন বাংলাদেশে মার্চ এবং এপ্রিল মাসে করোনাভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে যে ব্যবস্থাগুলো নেয়া হয়েছিল, সেগুলোর একটি প্রভাব দেখা যাবে মে মাসে। মে মাসের প্রথম দিকে সর্বোচ্চ সংক্রমণের সংখ্যা পাওয়া যাবে না, বরং এটি আরও প্রসারিত হবে। তাদের আশঙ্কা,এই মাসটি (মে মাস) বাংলাদেশের জন্য বেশ কঠিন হতে পারে।
আর এমন আশঙ্কার মধ্যেই গার্মেন্টস কারখানা খুলে দেওয়া, ঢাকার রেস্তোরাগুলোকে ইফতারি বিক্রির অনুমোদন দেয়া সহ মার্কেট খুলে দেওয়া বেশ ভাবনার বিষয় বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
স্বাস্থ্যমন্ত্রীও মনে করছেন, গার্মেন্টস চালু করা এবং মার্কেট খোলার কারণে সংক্রমণ বাড়তে পারে। যদিও স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেছেন, দেশে লকডাউন কতদিন থাকবে, সেটা নির্ভর করবে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গঠিত টেকনিক্যাল কমিটির পরামর্শের ওপর। এই কমিটি পরিস্থিতি বিশ্লেষণ করে সেই পরামর্শ বা সুপারিশ তৈরি করবে।
সরকারের নীতি নির্ধারকদের কেউ কেউ বলেছেন, মানুষের জীবিকার প্রশ্ন এবং অর্থনীতি যাতে মুখ থুবড়ে না পড়ে-এসব বিবেচনায় নিয়ে সরকার বাধ্য হয়ে সীমিত পরিসরে কিছু ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলে দিচ্ছে।কিন্তু একইসাথে এরই মাঝে গার্মেন্টস কারখানাগুলো চালু করায় দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে হাজার হাজার শ্রমিকের ঢাকায় ফেরার দৃশ্য দেখা গেছে। এখন আবার মার্কেট খোলার অনুমতি দেয়ায় সামাজিক দূরত্ব নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না এটাই স্বাভাবিক।
এদিকে জাতীয় রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা ইন্সটিটিউট (আইইডিসিআর)-এর ভাইরোলজি বিভাগের প্রধান তাহমিনা শিরীন বলেন, “অনেক মানুষ রয়েছে যাদের শরীরে ভাইরাস থাকলেও উপসর্গ নেই। কিন্তু পরীক্ষা করার পর তিনি চিহ্নিত হচ্ছেন ভাইরাসবহসকারী হিসেবে।”
তার একথাটি থেকেই বুঝা যায় সংক্রমনের যে সংখ্যা আমরা জানতে পারছি সেটা আসলে বাংলাদেশের প্রকৃত চিত্র নয়। অনেক অসুস্থ মানুষ রয়েছেন যাদের পরীক্ষা করা দরকার। কিন্তু তারা পরীক্ষা করাতে পারছেন না। আবার অনেকেই রয়েছেন উপসর্গ বিহীন অথচ তারা বহন করছেন করোনা ভাইরাস।
স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের রোগনিয়ন্ত্রণ শাখার সাবেক পরিচালক ডা. বেনজীর আহমেদও বলেন যে সংক্রমণের যে হিসাবটি পাওয়া যাচ্ছে, তাতে তার মনে হচ্ছে না যে সংক্রমণের সঠিক চিত্রটা প্রতিফলিত হচ্ছে। এর কারণ হিসেবে তিনি বলেন, “হিসাবটা প্রতিনিয়ত দ্বিগুণ করে বা দ্বিগুণের কাছাকাছি করে একটা পর্যায় পর্যন্ত যাওয়ার কথা। সেটা যেহেতু হচ্ছে না, তার মানে হচ্ছে কিছু একটা মিস হয়ে যাচ্ছে।”
তবে লকডাউন প্রত্যাহার বা শিথিল করার আগে ছয়টি শর্ত পূরণের তাগিদ দিয়েছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা। এসব শর্তের প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে কোথায় দাঁড়িয়ে রয়েছে?
শর্তগুলো হলো:
১)রোগ সংক্রমন পুরোপুরি নিয়ন্ত্রনে থাকা: প্রতিদিনই বাংলাদেশে করোনাভাইরাস সংক্রমিত রোগী শনাক্ত হচ্ছে এবং নতুন নতুন এলাকায় তা ছড়িয়ে পড়ছে। প্রতিদিন কয়েকশো করে নতুন রোগী শনাক্ত হচ্ছে। কিন্তু প্রয়োজনের তুলনায় পরীক্ষা অনেক কম করা হচ্ছে বলেই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
২)দেশের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটা রোগীকে শনাক্ত, পরীক্ষা, আইসোলেশন আর চিকিৎসায় এবং সংস্পর্শে আসা প্রত্যেককে শনাক্ত করতে সক্ষম: এদিক থেকে বাংলাদেশ অনেকটাই পিছিয়ে। ১৭ কোটি জনগনের বিপরীতে দেশে মাত্র ২৯ টা ল্যাব রয়েছে করোনা শনাক্ত করার। ফলে দেখা যায় পরীক্ষা করতে এসে দীর্ঘ লাইনে দাড়িয়ে থাকতে হচ্ছে সবাইকে। এতে করে যারা করোনা সন্দেহে পরীক্ষা করতে আসছে তাদের মনেও ভয় কাজ করে,হয়তো তার করোনা না থাকলেও কোন করোনা রোগীর সংস্পর্শে চলে আসছেন তিনি।
৩)নার্সিংহোমের মতো সেবা কেন্দ্রগুলোর মতো নাজুক স্থানগুলোয় ঝুঁকি নিম্নতম পর্যায়ে নামিয়ে আনা: বাংলাদেশ চিকিৎসক ফাউন্ডেশনের তথ্য অনুযায়ী এ পর্যন্ত দেশে ২০০ এর ও বেশি চিকিৎসক এবং ১০০ এরও বেশি স্বাস্থ্য কর্মী করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। ইতোমধ্যেই মারা গিয়েছেন ২ জন চিকিৎসক।
৪)শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস, আদালত ও অন্যান্য দরকারী স্থানে সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহন: কিছু কিছু জায়গায় সুরক্ষামূলক ব্যবস্থ্যা থাকলেও অধিকাংশ দরকারী স্থানই রয়ে গেছে পর্যাপ্ত সুরক্ষা বিহীন।
৫) বাইরে থেকে আসা নতুন রোগীকে কঠোর নজরদারিতে রাখা: অন্যান্য দেশ থেকে আসা নতুন রোগীূের ক্ষেত্রে সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে। বাধ্যতামূল কোয়ারেন্টাইন নিশ্চিত করতে হবে।
৬)সমাজের বাসিন্দারা পুরোপুরি সচেতন এবং নতুন জীবন যাপনের ব্যাপারে অঙ্গীকার বদ্ধ: বাংলাদেশের ক্ষেত্রে পুরোপুরি উল্টো চিত্র দেখা যায়৷ মানুষের মধ্যে ব্যাপকভাবে সচেতনতার অভাব দেখা যাচ্ছে। যেখানে মানুষ লকডাউন থাকাকালীন সময়েই লকডাউন না মেনেই চলাফেরা করেছে সেখানে লকডাউন শিথিল করা হলে কতোটুকু সচেতন ভাবে জীবন যাপন করতে সেটাই ভাবনার বিষয়।
শিথিলতায় আমারা কি ধরনের বিপদে পড়তে যাচ্ছি কিংবা এর থেকে কি সুফল পেতে পারি?
স্বাভাবিক ভাবেই সংক্রমণ বাড়ার এই সময়য়ে হঠাৎ করে যদি লকডাউনের শর্ত শিথিল করা হয়, তাহলে ঝুঁকি বাড়বে।যেখানে মানুষ লকডাউন করলেই ঘরে থাকছে না, সেখানে শিথিল করা হলে মানুষ আরও উৎসাহ নিয়ে আগাবে। যেভাবে চলছে, তাতে খারাপ একটা অবস্থা হতে পারে।
অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, ঢাকায় সবচেয়ে বেশি করোনাভাইরাসে সংক্রমিত রোগী রয়েছে. ফলে এই শহরে এ ধরণের ঢিলেঢালাভাবে লকডাউন কার্যকর রাখা হলে অনেক বেশি ঝুঁকি বাড়বে। তিনি বলেন, ঢাকা ও নারায়ণগঞ্জকে এই মুহূর্তে সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। দরকার হলে এর জন্য একটা টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে, যারা কেবলমাত্র এ বিষয়টি নিয়ে কাজ করবে।
কিন্তু এই লকডাউন শিথিল করার কারনকে অর্থনৈতিক ও মানসিক দিক থেকে বিশ্লেষন করা যায়।দীর্ঘদিন লকডাউনে থাকায় অর্থনৈতিক ভাবে ব্যপক ক্ষতির সম্মুখীন হয় দেশ। সবচেয়ে বেশি বিপদে পড়ে মধ্যবিত্ত, নিম্ন মদ্যবিত্ত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠী।
বিশ্বব্যাংক তাদের এক প্রতিবেদনে বলেছে, করোনাভাইরাসের কারণে সৃষ্ট পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮% নেমে দুই কিংবা তিন শতাংশ হতে পারে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক যে ধারণা দিচ্ছে সেটি রীতিমতো আঁতকে ওঠার মতো।
বাংলাদেশ আশা করেছিল ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন মাস পর্যন্ত জিডিপি প্রবৃদ্ধি হবে ৮.২ শতাংশ। কিন্তু বিশ্বব্যাংক বলছে, এখন একই মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হবে দুই থেকে তিন শতাংশ। অবস্থা আরো খারাপ হবে ২০২১ সালে।
এদিকে বাংলাদেশের ভোক্তাব্যায়ের জায়গা মূলত দুটো, পহেলা বৈশাখ এবং রমজানের সময়। পহেলা বৈশাখ এর আয়োজন পুরোপুরি বাতিল হওয়া এমনিতেই বড় আর্থিক ক্ষতির মুখোমুখি হয় ব্যাবসায়িক প্রতিষ্ঠানগুলো। এর মধ্যে রমজান মাসেও যদি তারা বাধ্যতামূলক লকডাউনে থাকে তবে তারা অপূরনীয় ক্ষতির মুখোমুখি হবেন।বেসরকারী তথ্য মতে বাংলাদেশের রাজস্বে ইতোমধ্যেই ৫৬ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি দেখা দিয়েছে। সেদিক চিন্তা করেই সরকার লকডাউন শিথিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, গার্মেন্টস কারখানাগুলো চালু হওয়ার ১৪ দিন হবে আগামী ১২ মে। সেখানে কোন সংক্রমণ হলো কিনা-তা বিশ্লেষণ করা হবে। তিনি আরও বলেছেন, শপিংমল বা অন্যান্য ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান খোলার পরে সেই পরিস্থিতিরও বিশ্লেষণ করা হবে। বিশেষজ্ঞদের দিয়ে বিশ্লেষণ করার পর এসব চালু রাখা না রাখার প্রশ্নে স্বাস্থ্য বিভাগের সুপারিশ সরকারকে দেয়া হবে।