১) তাকে প্রথমদিন খেলতে দেখার কথা আমার স্মরণ রয়েছে। সেটা ছিল স্পোর্টিং সিপি বয়সভিত্তিক দলের হয়ে। আমি আমার এসিস্টেন্টকে বললাম, ওই যে ‘ভ্যান বাস্তেন’ এর সন্তান যাচ্ছে। রোনালদোর দুর্দান্ত টেকনিক ছিল, সে সবার চেয়ে আলাদা ছিল।
– জোসে মরিনহো (সাবেক রিয়াল মাদ্রিদ, ইন্টার মিলান ও পোর্তো কোচ, বর্তমান টটেনহ্যাম কোচ)
২) আমার বিশ বছরে অনেক দারুণ খেলোয়াড় পেয়েছি, কিন্তু রোনালদো সেরাদের কাতারে।
– স্যার এলেক্স ফার্গুসন (সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ)
৩)গত সপ্তাহে স্পোর্টিং সিপির বিপক্ষে ম্যাচ খেলার পরে ড্রেসিং রুমে ছেলেরা অনবরত তার বিষয়ে কথা বলছিল। ফেরার পথে প্লেনে তারাই অনুরোধ করে আমাকে যেন তাকে সাইন করাই। এতোটাই উঁচুমানের ধরেছিল তারা তাকে।
– স্যার এলেক্স ফার্গুসন (সাবেক ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড কোচ)
৪)সে ৬.২ ফুট, সিংহের ন্যায় সাহসী, বৃষের ন্যায় শক্তিশালী এবং বজ্রপাতের মতো গতিময়। দেখতে সুদর্শন হলে আমাকে বলতেই হবে তার সব আছে।
– পল জিউয়েল (জার্নালিস্ট, বিবিসি স্পোর্টস)
৫)ছেলেটা আপনাকে অসুস্থ করে তুলবে! তার চলাফেরা, আচরণ সবকিছুই তার শ্রেষ্ঠত্বের সামঞ্জস্যপূর্ণ, সে নিজেই এটার মাপকাঠি। সে একটা ছয় ফুট উচ্চতার অতিমানব, সুস্বাস্থ্যের অধিকারী, সুদর্শন – কিছু না কিছু সমস্যা তার মাঝে থাকা উচিৎ!
– ইয়ান হলওয়ে (জার্নালিস্ট, বিবিসি স্পোর্টস)
৬)যখন রোনালদো চোখ টিপে দিয়েছিল সবাই ধরে নিয়েছিল সে তার টিমমেটকে (জাতীয় দলে প্রতিপক্ষ, ক্লাব সতীর্থ) বের করে দিতে পেরে খুশী। আপনার মনে হবে সে একজন সমালোচিত চরিত্রে পরিনত হতে যাচ্ছে। তার জন্য এসব সমালোচনাকে পেছনে ফেলে বেরিয়ে আসা অনেক বড় একটা কৃতিত্বের বিষয়, এটি একটি লক্ষণীয় অর্জন।
সে অবিশ্বাস্য প্রতিভাবান, রয়েছে দারুণ গতি, খেলোয়াড়দের বাঁধা পেরোনোর ক্ষমতা এবং তার রয়েছে শুট করার দারুণ ক্ষমতা। এরকমটা করতে পারা খুব বেশী খেলোয়াড় নেই। আমার বিশ্বাস গত দুই মৌসুমে তার খেলায় অকল্পনীয় উন্নতি ঘটেছে।
– মার্টিন ও’নেল (সাবেক সেল্টিক গ্লাসগো ও এস্টন ভিলা কোচ)
৭) তিনি স্বর্গ থেকে আগত আশীর্বাদ, সত্যিই তিনি স্বর্গ থেকে আগত আশীর্বাদ। যা স্পর্শ করেন তাইই স্বর্ণে পরিণত করেন তিনি।
– অ্যালান পেরি (বিবিসি স্পোর্টস ও স্কাই স্পোর্টস কমেন্টেটর)
৮) যখন আপনার কাছে এমন একজন খেলোয়াড় আছে যিনি যা স্বভাবতই করেন তা তিনি খেলার শেষপ্রান্তে এসেও করছেন তাহলে বুঝে নিতে হবে তিনি অমূল্য প্রতিভা অধিকারী।
– এন্ডি গ্রে (স্কাই স্পোর্টস কমেন্টেটর)
৯) এই ছেলেটার বর্ণনা দিতে গিয়ে শব্দের সংকটে পড়তে হচ্ছে আমাকে।
– এন্ডি গ্রে (স্কাই স্পোর্টস কমেন্টেটর)
১০) বেশ কয়েক বছর ধরে অনেককেই নতুন জর্জ বেস্ট নামে আখ্যায়িত করা হয়েছে তবে এই প্রথমবারের মতো এটা আমার জন্য প্রশংসাসূচক মনে হয়েছে।
– জর্জ বেস্ট (লিজেন্ডারি ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবলার, রোনালদোকে তার সাথে তুলনা করার প্রসঙ্গে)
২০১৬ সাল। সম্ভবত জুনের শেষ দিককার কথা বলছি। সেসময় ইউরো কাপ চলছে। গ্রুপ পর্বে পর্তুগালের অবস্থা শোচনীয়।গ্রুপ পর্বের শেষ ম্যাচে হাঙ্গেরির সাথে হারলেই ইউরো থেকে বাদ। মেসি ফ্যান হিসেবে স্বভাবতই আমি বেজায় খুশি। ম্যাচের ৪৭ মিনিটে হাঙ্গেরি গেল ২-১ গোলে এগিয়ে। আনন্দ দ্বিগুণ হওয়ার জন্য এরকম স্কোরলাইনই যথেষ্ট আমার জন্য। কিন্তু তিন মিনিট না যেতেই রোনালদোর গোলে সমতা আনলো পর্তুগাল। মিনিট পাঁচেক পর হাঙ্গেরি পর্তুগালের জালে বল ঢুকিয়ে ৩-২ গোলে লিড নিল হাঙ্গেরি। গুগলে স্কোরলাইন দেখে কেবল নিজেকে সৌভাগ্যবান ভাবতে শুরু করেছি অমনি বসের রাইভাল গোল দিয়ে বসল। ম্যাচ ড্র হলেও গ্রপের তৃতীয় দল হিসেবে পর্তুগাল চলে যায় দ্বিতীয় রাইন্ডে। পর্তুগালকে একদম খাদের কিনারা থেকে বাঁচালেন সিআরসেভেন। এর পরের ইতিহাস তো সবার জানা। জাতীয় দলকে প্রথম কোন আন্তর্জাতিক ট্রফির ছোঁয়া পাইয়ে দেন, গোটা টুর্নামেন্টে পর্তুগালের ৯ গোলে তার অবদান ৫ গোলে, গুরুত্বপূর্ণ ৩ খানা গোলই এই জাদুকরের পা থেকে আসে। ফাইনালে অপ্রত্যাশিত ভাবে ইঞ্জুরিতে পড়ে লাখো ভক্ত কে কাঁদিয়ে মাঠ ছাড়লেও ঠিকই ডাগ-আউট থেকেই সত্যিকারের দলনেতার মতো দলকে জেতার ইন্ধন জুগিয়েছেন। যার ফল ২০১৬ ইউরো জয়, পর্তুগালের ফুটবল ইতিহাসের প্রথম শিরোপা জেতানোর মহানায়ক তো তিনিই, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
আরেকটু পিছনের দিকে যাওয়া যাক। ২০১৩ সালের কথা। সুইডেন বনাম পর্তুগালের বিশ্বকাপ বাছাই পর্বের খেলা চলছে। দু দলের জন্যই ডু অর ডাই ম্যাচ। যে দল জিতবে তারা পাবে বিশ্বকাপের টিকিট, আর যারা হারবে তারা বিশ্বকাপ খেলার সুযোগ হারাবে- এমন সমীকরণে খেলতে নেমেই ইব্রাহোমোভিচের জোড়া গোলে ৭২ মিনিটে ২-১ গোলে লিড সুইডেনের। তাহলে কি ২০১৪ বিশ্বকাপ রোনালদোর মতো মহাতারকাকে মিস করতে যাচ্ছে? ফুটবল বিশ্বের যখন এমন অনিশ্চয়তা তখন ৭৭ ও ৭৯ মিনিটে টানা দুই গোল করে পর্তুগাল সমর্থকদের বাঁধভাঙ্গা জয়োল্লাসের আনন্দ উপহার দেন রোনালদো। রোনালদোর হ্যাট্রিকে পর্তুগাল পায় বিশ্বকাপ খেলার টিকিট। কখনো কি প্রশ্ন জাগে না, প্রতিনিয়ত রোনালদো বিরোধী স্টেটমেন্ট কেন দেন ইব্রাহোমোভিচ? ২০১৪ বিশ্বকাপ হতে পারতো ইব্রার শেষ বিশ্বকাপ। কিন্তু রোনালদোর অমন পারফরমেন্সে সেবার ইব্রা বিশ্বকাপ খেলতে ব্যর্থ হন, সেই সাথে সুইডেনের বিশ্বকাপ খেলার স্বপ্নভঙ্গ হয়। সম্ভবত এ কারণেই রোনালদোকে এর পর থেকে শুধু কথার মাধ্যমে আক্রমণই করে গেছেন।
২০১৮ বিশ্বকাপের কথাই ধরা যাক। স্পেনের বিপক্ষে করে ফেললেন হ্যাট্রিক। আগের বিশ্বকাপের ব্যর্থতা সুদে আসলে মেটালেন অতিমানবীয় পারফরম্যান্স দিয়ে যদিও দলীয় ব্যর্থতায় দ্বিতীয় পর্বেই তার বিশ্বকাপ মিশন শেষ হয়ে যায়।
রোনালদো সমালোচকদের তির্যক কথার উত্তর দিয়ে গেছেন পারফরম্যান্স দিয়ে। গতবারে ইউসিএলের কথাই ধরা যাক। রাউন্ড অফ ১৬ তে জুভদের বিপক্ষে প্রথম লেগে ২-০ গোলে এগিয়ে থাকার পর কোচ সিমিওনে রোনালদোকে নিয়ে করে ফেললেন বেফাঁস মন্তব্য। তির্যক সে মন্তব্যের জবাব দিলেন পরের লেগে হ্যাট্রিক করে। রোনালদোর সেই হ্যাট্রিকে জুভেন্টাস চলে যায় কোয়ার্টার ফাইনালে আর সিমিওনের হয় স্বপ্নভঙ্গ। অ্যাথলেটিকো কোচ সিমিওনে আর গোলরক্ষক মাইকেল ও বালাক কে সম্ভবত সবচেয়ে বেশি ভুগিয়েছেন এই রোনালদোই। সিমিওনের চ্যাম্পিয়ন্স লিগের শিরোপা স্বপ্ন বহুবার ভেঙ্গেছেন রোনালদো। আর গোলরক্ষক মাইকেল ও বালাক রোনালদোর কাছেই হ্যাট্রিক হজম করেছেন ৪ টি।
বয়স নাকি মানুষ কে কাবু করে দেয়? অথচ এই রোনালদো যেন দিনকে দিন যুবক হচ্ছেন। গ্রহের একমাত্র ফুটবলার হিসেবে একই বছরে ব্যালন ডি অর, সাথে দলগত ভাবে ইউরো চ্যাম্পিয়নশীপ, চ্যাম্পিয়ন্স লিগ আর সুপার কাপ, আর ক্লাব বিশ্বকাপ জিতেছেন। ২০১৭ সালে প্রথম ফুটবলার হিসেবে টানা দুইবার ফিফ দ্য বেস্ট জিতেছেন। দলকে টানা তিনবার চ্যাম্পিয়নস লিগও জিতিয়েছেন এই চিরসবুজ কিংবদন্তী।
আমি মেসিভক্ত। আমি মেসির আগে আর্জেন্টিনাকে চিনেছিলাম। আমি মেসিকে খেলতে দেখার আগে আর্জেন্টিনার জার্সি গায়ে চাপিয়েছি। কিন্তু রোনালদো এই দেশের বেশ কিছু ফুটবল সমর্থকদের পর্তুগালের জার্সি গায়ে চাপাতে বাধ্য করেছেন। এখানেই অনন্য রোনালদো।
আপনি রনের হেটার হতে পারেন, অহেতুক সমালোচনা করতে পারেন। তবে আপনার অজান্তেই রোনালদোকেই বরং সাহায্য করে ফেলেন, “Your love makes me strong, your hate makes me unstoppable !”
রোনালদোর এই উক্তিটি জগতখ্যাতই।
রোনালদোকে নিয়ে আমার অনুভূতি কী? রোনালদো বারবার ফিরে এসেছেন। ৪-১ থেকে ৫-৫ এ নিজেকে নিয়ে গেছিলেন। ফুটবল বিশ্বে নিজেকে অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন।
বছর দশেক পর, রোনালদোকে হয়তো আর সবুজ ঘাসে ভেজা চত্ত্বরে দেখা যাবে না, রন আসবে না তুরিনের ডেরায়, রিয়াল- জুভের ফ্যানেরা আর কখনোই তাদের রাজপুত্র কে মাঠে দেখতে পারবে না৷ তবে থেকে যাবে ফুটবল বিশ্বের হৃদয়ে, রয়ে যাবে স্মৃতির পাতায়। থাকবেন ফ্যানদের গল্পতে, আড্ডায়, রেকর্ডবুকে অমলিন হয়ে! “বেঁচে ছিলাম রোনালদোর সময়ে” – হয়ত এভাবে বলেই রন সমর্থকরা পরবর্তী প্রজন্মকে গল্প শোনাবে।
শুভ জন্মদিন দ্য লিজেন্ড, ক্রিস্টিয়ানো রোনালদো।
লেখকঃ মাহবুব হাসান তন্ময়