১৮ জুলাই ১৮৪৮ , ব্রিস্টলের কাছের এক মফ:স্বল অঞ্চলের ভিক্টোরিয় পরিবারে হেনরি ও মার্থার ঘরে জন্ম নিল তাদের অষ্টম সন্তান। ছেলেটির নাম উইলিময়াম গিলবার্ট গ্রেস ( সংক্ষেপে ডব্লিউ জি গ্রেস) । আত্বীয়দের মধ্যে দাদা, বাবা ,মামা সবাই ক্রিকেটার ছিলেন । তিন বড় ভাইও ক্রিকেটার । এমন ক্রিকেটীয় পরিবারে জন্ম হওয়া সূত্রে স্বভাবতই মাত্র দু বছর বয়সে ব্যাট হাতে তুলে নেন তিনি । গ্রেস কোনো এক স্মৃতিচারণায় বলেছিলেন , ১৮৫৪ সালের ‘অল ইংল্যান্ড ইলেভেন’ বনাম ‘টোয়েন্টি টু অফ ওয়েস্ট গ্লস্টারশায়ার ‘ এর ম্যাচটাই তাঁর দেখা প্রথম ম্যাচ । তিনি এও দাবী করেছিলেন যে ১৮৫৭ সাল নাগাদ ৯ বছর বয়সে তিনি ম্যাচ খেলা শুরু করেন । তবে ইতিহাস বলে, ১১ বছর ১০ দিনের মাথায় ক্লিফটনের ডার্ডহ্যাম ডাউন মাঠে তিনি প্রথম অফিশিয়াল ম্যাচে অংশগ্রহণ করেন।

ক্রিকেট ক্যারিয়ারের একদম শুরুর দিকে মাত্র ১২ বছর বয়সে গ্রেস পশ্চিম গ্লস্টারশায়ারের হয়ে ক্লিফটনের বিরুদ্ধে ৫১ রান করেন । এর পরই তার মা মার্থা গ্রেস ‘অল ইংল্যান্ড ইলেভেন’ এর জর্জ পার কে লেখা চিঠিতে তার ছেলে ই এম গ্রেসকে দলে নেওয়ার অনুরোধ করে জানান “আমার অন্য আর এক ছেলে আছে যার বয়স ১২, সে সময়ের সাথে সাথে তার দাদার থেকে বড় খেলোয়াড় হবে । কারন সে ব্যাকে খুব ভালো খেলে এবং সবসময় সোজা ব্যাটে খেলে ।”
মায়ের কথা সঠিক প্রমাণ করে সেই ছেলে উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস ১৮৬৩ সালে জেন্টলম্যান অফ সমারসেটের বিরুদ্ধে ৫১ ও ১ রান করেন , বল হাতে মোট ৫ উইকেট ও ১টা ক্যাচ নেন । তখন তিনি সবেমাত্র ১৫ বছর । ২ বছর বাদে ১৮৬৫ সালে তার প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে অভিষেক ঘটে। তার আগে ১৮৬৩ সালে ব্রিস্টল ও ডিডকট একাদশের হয়ে ‘অল ইংল্যান্ড ইলেভেন’ -এর বিরুদ্ধে খেলেন , ৩২ করেন ও ১ উইকেট নেন । মজার ব্যাপার হলো, গ্রেস পরিবারের মোট ৪ জনই ঐ ম্যাচে খেলেছিলেন ।
১৮৬৮ সালে অল ইংল্যান্ড ইলেভেন দলের হয়ে সারের বিরুদ্ধে ওভালে ডব্লিউ জি গ্রেসের অপরাজিত ২২৪ রানের মাধ্যমে এক আজব কীর্তির সূত্রপাত । ঐ বছর একই ম্যাচে দুটি সেঞ্চুরি করে তিনি ক্রিকেট ইতিহাসে দ্বিতীয় ক্রিকেটার হিসেবে এই কৃতিত্ব অর্জন করেন (প্রথম উইলিয়াম ল্যাম্বার্ট , ১৮১৭) । একটা তথ্য বেশ অবাক বনে যাওয়ার মতো, ১৮৭৩ থেকে ১৮৭৮ এর মধ্যে ৬ বছরে ডব্লিউ জি গ্রেস ১০,৫৪৮ রান করেন এবং উইকেট পান ৮৯৭ টি ! একজন ক্রিকেটারের তার নামের পাশে পুরো ক্যারিয়ারে যা অর্জন থাকা স্বপ্ন থাকে তা গ্রেস করেছিলেন মাত্র ৬ বছরে!
একবার ‘বিটন’ গ্রামের সাথে খেলা । গ্রেসদের গাড়িটা ছিল ঝড়ঝড়ে । তাতে চড়ে হেনরি (দাদা) আর ডব্লু জি যখন খেলতে যাচ্ছেন তখন ই এম হাজির । সে ও যাবে । হেনরি আর ডব্লু জি তাকে নিতে রাজি নয় । গাড়ির চাকা ফেটে যাবে । ই এম এর দাবি অসম্ভব ! এ সপ্তাহে একবারও ফাটেনি । ‘অগত্যা’! ‘কোথায় যাবে?’ ‘ তোমরা যেখানে যাবে সেখানে নামিয়ে দিও! বিটনে গিয়ে দেখা গেল ‘ই এম’ বিটনের হয়ে খেলবে । যাই হোক খেলা শুরু হল । ডব্লু জি দের দল মাত্র ১০(দশ) রান করল ১১ জন মিলে । এতো ই এম ফুঁ দিয়ে তুলে দেবে । তারপর ? ই এম নামল বিটনের হয়ে । হেনরির তোল্লা বল হাঁকড়াতে গিয়ে বোল্ড । এরপর বিটনের উইকেট পতন :০/১, ০/২,০/৩,০/৪,৩/৫,৬/৬,৬/৭,৬/৮,৬/৯,৬/১০। শেষে দুই ভাই মিলে আনন্দ করতে করতে ই এম কে গাড়ি করে বাড়ি নিয়ে এল।
১৮৭৬, ১০ই আগস্ট । লর্ড হ্যারিসের ১৫০ রান কেন্টকে অনেক রান এনে দেয় । জবাবে এম সি সি শনিবার চা বিরতির মধ্যে অল আউট হয়ে গিয়ে ফলো-অনে পড়ে যায় গ্রেস এই সব দেখে ধান্দা করেন অনেক দিন বাড়ি ফেরা হয়নি , এবার ফিরতে হবে । তিনি চালিয়ে খেলতে থাকেন । ৪৫ মিনিটে ১০০। দিনের শেষে ১৩৩ রানে অপরাজিত । পরের দিন রবিবার । গ্রেস একদিকে মারছেন, অন্যদিকে উইকেট পড়ছে । অবশেষে ৩৪৪ করে ১৮২০ সালে করা উইলিয়াম ওয়ার্ডের করা ২৭৮ রানের রেকর্ড ভেঙ্গে দেন তিনি । পরের খেলায় নটিংহ্যামের বিরুদ্ধে ১৭৭ । নটিংহ্যামের মুখ থেকে শুনে ইয়র্কশায়ার পরের খেলায় আটকানোর চেস্টা করে। ফল? গ্রেস ৩১৮ করেন । ৭ দিনে ৮৩৯ রান । অর্থাৎ ৭ দিনের মধ্যে ওয়ার্ড -এর রেকর্ড দু’বার ভাঙল ।
১৮৭৬ সালে টোয়েন্টি টু অফ গ্রিমসবীর বিরুদ্ধে গ্রেস অপরাজিত ৪০০ রান করেন । খেলেছিলেন ইউনাইটেড সাউথ ইংল্যান্ডের হয়ে । প্রথম দিন দলের ২১৭/২ (গ্রেস ১৩৬ ,অপরাজিত) রান । দ্বিতীয় দিন গ্রেস ৩১৪ রানে অপরাজিত। পরের দিন পূরণ করেন ব্যক্তিগত ৪০০ রান । গ্রিমসবীর লোকেদের দাবি যে ওটা ৩৯৯ ছিল । কথিত আছে, আগের দিন গ্রেসের দ্বিতীয় পুত্র হয়েছিল বলে স্কোরার তাকে ১ রান উপহার দিয়ে দেন ।

১৮৮০ সালে প্রথম টেস্ট নেমেই ১৫২ করেন । টেস্টে ওটাই ইংল্যান্ডের হয়ে প্রথম সেঞ্চুরি । ইংল্যান্ডের মাটিতেও প্রথম । দ্বিতীয় বার সেঞ্চুরি করেন ১৮৮৬ সালে (১৭০) । যে টেস্টে হারার জন্য ‘অ্যাশেজ’ তৈরি হয় তার দায়ও তাঁর বলে অনেকে মনে করেন । তিনি ‘অ-খেলোয়াড়োচিত’ (কিন্তু বৈধ )ভাবে রান আউট না করলে স্পফোর্থ ঐ ভাবে ক্ষেপে উঠত না । এই ঘটনা প্রমান করে যে ‘ভিক্টোরীয়’ যুগে ‘জেন্টলম্যান স্পিরিট’ বা স্পোর্টম্যান স্পিরিট এর সাথে সাথে ‘গেমসম্যানশিপ’ পুরোপুরি ভাবে চলত। শোনা যায় যে একবার এক ম্যাচে দিনের শেষ বলে এক ব্যাটসম্যান আউট হলেও কেউ আবেদন করেননি । ব্যাটসম্যান মাঠ থেকে বেরোতে বেরোতে হাসতে হাসতে ডব্লু জি কে জানায় বিষয়টি । পরের দিন প্রথম বলেই আউটের আবেদন করেন ডব্লু জি । আম্পায়ার আউট দিয়ে দেয় (এখন এই নিয়ম নেই ) ।
ডব্লিউ জি গ্রেস আমেরিকা , কানাডা , অস্ট্রেলিয়া সফরেও গেছেন । ১৯০৮ সালে জেন্টলম্যান অফ ইংল্যান্ডের হয়ে সারের বিরুদ্ধে করেন ১৫ ও ২৫। এটাই গ্রেসের জীবনের শেষ প্রথম শ্রেণির ম্যাচ । আরও ৬ বছর মাইনর ক্রিকেট খেলেন । ১৯১৪ সালের ২৫ শে জুলাই এলহ্যামের হয়ে গ্রেভ পার্কের বিরুদ্ধে ৬৬ বছর বয়সে শেষবার ব্যাট করতে যখন নামেন দলের তখন ৩১/৪। নিজে ৬৯ করে অপরাজিত দলকে ১৫৫ অবধি টানেন । গ্রেভ পার্ক ৮ উইকেটে ৯৯ তোলার পর ম্যাচ ড্র হয়ে যায় । তবে জীবনের শেষ ম্যাচ খেলেন ১৯১৪ সালের ৮ আগস্টে। ৬৬ বছর ২১ দিন বয়সে জীবনের শেষ ম্যাচ খেলতে নামলেও সে ব্যাট ও বল কোনোটিই করেননি গ্রেস।
ডব্লিউ জি গ্রেসের ক্রিকেটীয় পরিসংখ্যান নিয়ে রয়েছে অনেক মতবিরোধ। তবে ইএসপিনক্রিকইনফো’র তথ্যানুযায়ী
ডব্লিউ জি গ্রেস ক্যারিয়ারে টেস্ট খেলেছেন ২২ টি, রান করেছেন ১০৯৮ রান, ২ টা সেঞ্চুরি, উইকেট ৯টা । সর্বোচ্চ -১৭০ ।
প্রথম শ্রেণির ক্রিকেটে খেলেছেন ৮৭০ টি ম্যাচ রান করেছেন ৫৪,২১১। শতরান ১২৪ টি ,অর্ধশতরান-২৫৪) । সর্বোচ্চ ৩৪৪ রান। উইকেট পেয়েছেন ২৮০৯ টি । ৫ উইকেট (ইনিংসে) ২৪০ বার। ১০ উইকেট (ম্যাচে)-৬৪বার। সেরা বোলিং -৪৯ রানে ১০ উইকেট (ইনিংসে) ।
বিশ্বযুদ্ধ শুরু হলে খেলোয়াড়দের তাতে যোগ দেওয়ার জন্য চিঠি লেখেন ডব্লিউ জি গ্রেস । ২৩শে অক্টোবর ১৯১৫ উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেস পৃথিবী থেকে বিদায় নেন । প্রাক ভিক্টোরিয় মধ্যযুগীয় ক্রিকেট কে আধুনিক খেলায় পরিণত হতে দেখে যান তিনি , যাতে তাঁর নিজেরই বিশাল ভূমিকা ছিল । সামন্তদের পৃষ্ঠপোষকতায় শ্রমজীবীদের খেলাকে মধ্যবিত্তের আবেগ ও ইংল্যান্ডের জাতীয় খেলায় পরিনত করতেও তিনিই প্রধান ভূমিকা নেন ।
‘আধুনিক ক্রিকেটের পিতা’ ও ব্রিটিশ ক্রিকেটের এই কিংবদন্তীকে ১৭৩ তম জন্ম দিবসের শুভেচ্ছা ও শ্রদ্ধা
তথ্যসূত্রঃ ইএসপিনক্রিকইনফো, সুমিত গঙ্গোপাধ্যায়ের “ক্রিকেট সমুদ্রের কোল ঘেঁষে” , উইজডেন।
আরো পড়তে পারেন