১৯৮৯ সালের ঘটনা। ভারত- পাকিস্তান টেস্ট ম্যাচ। প্রথম ইনিংসে টসে হেরে ব্যাটিংয়ে পাকিস্তান, ইনিংস শেষ করে করে ৪০৯ রানে। জবাবে ৪১ রানের মধ্যেই ৪ উইকেট পড়ে যায় ভারতের।
তখন ব্যাটিংয়ে নামেন একজন কিশোর যার বয়স মাত্র ১৬ বছর। ব্যাটিংয়ে নেমেই ওয়াকার ইউনিসের বাউন্সারে মাথায় আঘাত পায় সেই কিশোর। কি মনে হয় আপনার? আহত হয়ে মাঠ ছেড়েছিল নাকি ভয় পেয়ে গেছিল সেই কিশোর মন?
আপনার ভাবনা দুটোর একটিও না। সেদিন লড়াই ছেড়েছিল না সেই কিশোর। ২৪ বলে ১৫ রানের একটি ছোট ইনিংস কিন্তু বাউন্সারে হার না মানা সেই কিশোরটি সেদিনই ইঙ্গিত দিয়েছিল ক্রিকেটের সবুজ ময়দানে সে রাজা হতে এসেছে।
কিশোরটির নাম শচীন রমেশ টেন্ডুলকার, দ্যা গড অফ ক্রিকেট।

টেনিসপ্রেমী কিন্তু …
প্রথম জীবনে শচীন একজন টেনিসপ্রেমী ছিলেন আর সেই খেলা নিয়েই জীবনে এগোতে চেয়েছিলেন। তার পছন্দের টেনিস তারকার নাম ছিলো জন ম্যাকেনরো, যিনি কিনা টেনিস দুনিয়ার সর্বকালের একজন সেরা খেলোয়াড় ছিলেন।কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত শচীনের সেই খেলা আর জীবনে শেখা হয়ে ওঠেনি, কারণ তার দাদা অজিত টেন্ডুলকার তাকে ক্রিকেট খেলায় ভর্তি করে দেন শিবাজী পার্ক অঞ্চলের বিখ্যাত ক্রিকেট কোচ রমাকান্ত আচারেকরের কাছে ।
ক্রিকেটার হওয়ার শুরুর গল্প
প্রথম প্রথম শচীন টেন্ডুলকারের পারফরমেন্স তেমন একটা ভালো ছিলোনা । অনেক শেখানোর পরও তিনি তেমন একটা ভালো খেলতে পারছিলেন না, যা দেখে কোচ আচারেকর তাকে আর খেলা শেখাতে চাননি। কিন্তু দাদা অজিতের বার বার অনুরোধ করার পর, অবশেষে কোচ আচারেকর শচীনকে শেষ সুযোগ দেন। তিনি এবার তার খেলা দেখার জন্য একটা গাছের পিছনে লুকিয়ে পড়েন, কারণ তিনি আন্দাজ করতে পেরেছিলেন যে শচীন তাকে দেখলে নার্ভাস হয়ে যায় এবং এর ফলে সে খেলতে পারেনা ভালোভাবে । পরে অবশ্য তার এই আন্দাজই সত্যি হয় । কারণ যখন তিনি গাছের পিছনে লুকিয়ে যান, তখন শচীন সেই খেলাটা দারুন ও সাবলীলভাবে খেলেন । এরপর কোচ আচারেকর সেটা দেখে তার সমস্যা বুঝতে পারেন এবং তাকে সেই সমস্যা দূর করতে সাহায্যও করেন ।
স্কুল ক্রিকেট
তারপর ধীরে ধীরে যখন শচীনের খেলা আরো ভালো হতে শুরু করে, তখন কোচ তার সেই খেলার উন্নতির জন্য তাকে সারাদাশ্রম বিদ্যামন্দির হাইস্কুলে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন । কারণ সেই স্কুলের ক্রিকেট দল মুম্বাইয়ের মধ্যে খুব নাম করা ছিলো এবং সেই স্কুলের হয়ে খেলতে পারলে শচীনের ক্রিকেট ক্যারিয়ার আরো এগোবে বলে তিনি ভেবেছিলেন । অবশেষে কোচের কথা মতো, তার বাড়ির লোক তাকে সারাদাশ্রম বিদ্যামন্দির হাইস্কুলে ভর্তি করে দেন এবং সেইসাথে কিছুদিনের মধ্যেই তিনি সেই স্কুলের জুনিয়ার ক্রিকেট দলেও সুযোগ পেয়ে যান ।
কোচের পয়সা পুরস্কার পদ্ধতি
শচীন নিজের একটা সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন যে, তার কোচ তার ব্যাটিংকে আরো উন্নত করার জন্য উইকেটের উপর একটা পয়সা রাখতেন এবং বোলারদের বলতেন তাকে বল করার জন্য । যে তাকে আউট করতে পারতো, পয়সা তার হতো আর না পারলে সেটা তিনিই পেতেন ।এইভাবে তার কাছে মোট ১৩টা পয়সা জমেছিলো, যেটাকে তিনি আজও কোচের থেকে পাওয়া সবচেয়ে সেরা পুরস্কার মনে করেন ।নেটে প্রতিদিন প্রচুর পরিশ্রম করার ফলে শচীন ধীরে ধীরে এক দূর্দান্ত ব্যাটসম্যান হয়ে ওঠেন এবং স্কুল ক্রিকেটে লাগাতার দারুন ব্যাটিং করায় তিনি খুব তাড়াতাড়িই লোকচর্চার বিষয় হয়ে দাড়ান |
ডেনিস লিলি’র পরামর্শ, অতঃপর পুরোদস্তুর ব্যাটসম্যান
এরপর তিনি স্কুল টিমের হয়ে ক্রিকেট খেলার পাশাপাশি, মুম্বাইয়ের অনান্য প্রসিদ্ধ টিমের হয়েও খেলা শুরু করে দেন । সেইসময় তিনি ব্যাটিং করার পাশাপাশি বোলিং করার পিছনেও বিশেষ মন দেন এবং নিজের বোলিং স্কিলকে আরো ভালো করার জন্য ১৯৮৭ সালে চেন্নাইতে, মাত্র ১৪ বছর বয়সে এম.আর.এফ পেস ফাউন্ডেশান যান । যেখানে তখনকার সময়য়ের নামকরা অস্ট্রেলীয় পেস বোলার ডেনিস লিলি সবাইকে বোলিং প্রশিক্ষণ দিতেন | কিন্তু তিনি শচীনের ব্যাটিং দেখে তাকে একজন ভালো ব্যাটসম্যান হওয়ার পরামর্শ দেন । যা পরবর্তীকালে তিনি অক্ষরে অক্ষরে পালন করেন।
ঘরোয়া দলে সুযোগ প্রাপ্তি
মাত্র ১৫ বছর বয়সে এরপর শচীন টেন্ডুলকার মুম্বাই দলে সুযোগ পেয়ে যান । ১৯৮৮ সালে তিনি গুজরাটের বিরুদ্ধে প্রথম ১০০ রান করেন এবং তারপর সেই একই বছর দিলীপ ট্রফি, ইরানী ট্রফি আর রঞ্জি ট্রফিতে লাগাতার একের পর এক সেঞ্চুরি করতে থাকেন আর হয়ে যান ভারতের প্রথম একজন নজির গড়া ব্যাটসম্যান ।

আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে অভিষেক
এর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৮৯ সালে, শচীন ভারতীয় ক্রিকেট দলে সুযোগ পেয়ে যান এবং করাচিতে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দেশের জার্সিতে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলেন । অবশ্য সেই ম্যাচে তিনি একদম ভালো খেলতে পারেননি, মাত্র ১৫ রানে সেদিন আউট হয়ে যান । কিন্তু পেশোয়ারে সেই সিরিজের পরের ম্যাচে তাকে আবার সুযোগ দেওয়া হয় । সেই খেলায় তার নাকে চোট লাগে জোরে বল লাগার জন্য কিন্তু তবুও তিনি শেষ পর্যন্ত খেলেন এবং ভারতের হয়ে ৫৪ রানও করেন ।
আন্তর্জাতিক ক্রিকেটে প্রথম শতক

তারপর পরের বছর অর্থাৎ ১৯৯০ সালে শচীন অবশেষে নিজের প্রথম আন্তর্জাতিক সেঞ্চুরি করতে সফল হন ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে । আর সেখানে তার অসাধারণ ব্যাটিং পারফরমেন্সকে দেখে সারা ক্রিকেট বিশ্ব একেবারে মুগ্ধ হয়ে যায় এবং তার তুলোনা প্রাক্তন সময়কার সব প্রসিদ্ধ ক্রিকেট খেলোয়াড়দের সাথে করতে থাকে ।
১৯৯১-১৯৯২ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরেও শচীন দূর্দান্ত খেলেন এবং সেখানে একটা খেলায় তিনি ১৪৮ রান করেন ।
৯৯ এর এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ
১৯৯৯ সালে অনুষ্ঠিত এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়নশীপ টুর্নামেন্টে, কলকাতার ইডেন গার্ডেন্স ক্রিকেট স্টেডিয়ামে অনুষ্ঠিত প্রথম ম্যাচে পাকিস্তানের শোয়েব আখতারের সঙ্গে ধাক্কা লেগে শচীন রান আউট হয়ে যান । যা দেখে কোলকাতার দর্শকরা ক্ষোভে একদম ফেটে পরেন আর সেইজন্য খেলা বন্ধ করে দিতে হয় । কিন্তু কিছুক্ষণ পর, শচীনের আবেদনে দর্শকেরা শান্ত হন এবং আবার খেলা শুরু হয় । সেই প্রতিযোগীতায় শচীন পরবর্তীতে শ্রীলঙ্কা ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সেঞ্চুরিও করেন ।
বাবা’র মৃত্যু, সেঞ্চুরি উৎসর্গ
সেই বছরই আবার ইংল্যান্ডে, আন্তর্জাতিক ক্রিকেট বিশ্বকাপ অনুষ্ঠিত হয় । আর সেই বছরে বিশ্বকাপ চলাকলীন সময়ে শচীনের বাবা রমেশ টেন্ডুলকারের মৃত্যুও হয় । যার জন্য তাকে প্রতিযোগীতার মাঝেই বাবার সৎকারের জন্য ভারতে ফিরে আসতে হয় । শ্রাদ্ধাদি অনুষ্ঠানের পর তিনি পুনরায় প্রতিযোগীতায় যোগ দেন এবং পরে ম্যাচে কেনিয়ার বিরুদ্ধে অপরাজিত ১৪০ রান করেন । আর সেই রান তিনি সেদিন তাঁর বাবাকে উৎসর্গও করেন ।
২০০৩ বিশ্বকাপ, রানার্স আপের আক্ষেপ
এরপর ২০০৩ সালের বিশ্বকাপে শচীন আবারও দূর্দান্ত খেলেন ও নিজের দলকে বিশ্বকাপের ফাইনালে নিয়ে যেতে সফল হন কিন্তু সেইবছর তার দল বিশ্বকাপ জিততে পারেনি । অস্ট্রেলিয়া দল, ভারতকে হারিয়ে বিশ্বকাপ জয়ী হয় । তখনকার সময় ভারতের অধিনায়ক ছিলেন সৌরভ গাঙ্গুলী । কিন্তু বিশ্বকাপ না জিতলেও সেই টুর্নামেন্টে শচীন তেন্ডুলকার ম্যান অফ দ্য টুর্নামেন্ট হন । গোটা টুর্নামেন্টে তিনি মোট ৬৭৩ রান করেছিলেন ।

২০১১ বিশ্বকাপ : আকাঙ্ক্ষিত বিশ্বকাপ জয়

অবশেষে তার বিশ্বকাপ জয়ের স্বপ্ন পূরণ হয় ২রা এপ্রিল ২০১১ সালে । সেই বছর মহেন্দ্র সিংহ ধোনির নেতৃত্বে টিম ইন্ডিয়া দ্বিতীয়বারের জন্য বিশ্বকাপ জিততে সক্ষম হয় । গোটা টুর্নামেন্টে শচীন তেন্ডুলকারের মোট রানসংখ্যা ছিলো ৪৮২ রান ।

শততম সেঞ্চুরি

এরপর পরের বছর ২০১২ সালের ১৬ই মার্চ তারিখে, অবশেষে তিনি তার শততম সেঞ্চুরি করতে সক্ষম হন ।যেটা ক্রিকেট ইতিহাসে এখনো পর্যন্ত কোনো ক্রিকেটারের ব্যক্তিগত সর্বাধিক সেঞ্চুরি করার রেকর্ড । আর এতবছর পরেও এই রেকর্ড এখনো অবধি বিশ্বের দ্বিতীয় কোনো ক্রিকেটার ভাঙ্গতে পারেননি ।

একজন শচীন টেন্ডুলকারকে একটা ফিচারে তুলে ধরা যায় না। ১০০ টা সেঞ্চুরি থেকে ১০০ টা গল্প আছে। স্কুল ক্রিকেটে বন্ধু বিনোদ কাম্বলির সাথে ৫৫৪ রানের জুটির একটা গল্প আছে, ৩৪ হাজার ৩৫৭ রান আর প্রায় দুই যুগের ক্যারিয়ার সহস্রাধিক শব্দে ফুটিয়ে তোলা সম্ভব না। কারণ তিনি ক্রিকেটীয় বিশেষণের ঊর্ধ্বে, মানদন্ডের অতি উচ্চতায় তিনি অবর্ণনীয়। তিনি ক্রিকেট ঈশ্বর।
শুভ জন্মদিন ক্রিকেট ঈশ্বর, লিটল মাস্টার শচীন টেন্ডুলকার