শ্যাডো নিউজ: কোনো একটি দেশের প্রকৃত উন্নয়ন বা অগ্রগতি তার শেয়ার বাজারের অবস্থা দেখে অনুমান করা যায়। সাধারণত দেশের অর্থনৈতিক অবস্থা যখন ভালো হতে থাকে তখন জিডিপি (সামষ্টিক অভ্যন্তরীণ উৎপাদন) তে শেয়ার বাজারের অবদান স্পষ্ট হতে থাকে। কিন্তু আমাদের শেয়ার বাজারের চিত্র এর থেকে পুরোপুরি আলাদা। গত এক দশকে দেশের অর্থনীতি প্রবৃ্দ্ধির সাথে (গড়ে ৬%), জিডিপিতে শেয়ার বাজার মূলধনের অবদান যেখানে বৃ্দ্ধি পাওয়ার কথা সেখানে শেয়ার বাজারের অবদান পূর্বের তুলনায় বেশ কমেছে।
- শেয়ার বাজার মূ্লধনের অবদান জিডিপির তুলনায় অনেক কম।
- ২০১০ এর শেয়ারবাজার ধসের পর ১১ তে নেয়া নূ্ন্যতম শেয়ার ধারণের আইন পরিপূ্র্ণ বাস্তবায়ন হয় নি। ফলসরূপ অধিকাংশ গ্রাহকের শেয়ারবাজারে আস্থা ফেরে নি।.
- শেয়ারবাজার ডিজিটালাইজেশনের বিকল্প নেই।
গ্রাফ-১: Bangladesh Stock market , percent of GDP গ্রাফ-২: Bangladesh market capitalization
সাময়িক অবস্থা ও বিদ্যমান চ্যালেঞ্জগুলো
গ্রাফ-১ & ২ এ ১৯৯৩-২০১৮ সাল পর্যন্ত বাংলাদেশের জিডিপিতে শেয়ার বাজারের অবদান লক্ষ্য করতে পারি। এ সময়কালে শেয়ারবাজারের গড় অবদান- ১৪.৬৭% ছিলো যেখানে সর্বোচ্চ গড় ছিলো ২০১১ সালে (৩৭.৮%) এবং সর্বনিম্ন গড় ১৯৯৩ সালে (১.৪%। ২০১০ শেয়ার বাজার কেলেংকারির দীর্ঘমেয়াদী প্রভাব আমরা ২ টি গ্রাফ থেকে সুস্পষ্ট লক্ষ্য করতে পারি।
তবে মে,২০১৬- জানুয়ারী, ২০১৮ এর মধ্যে ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের [ডি এস ই] (যেটি দেশের প্রায় ৯০% শেয়ার ধারণ করে) ইনডেক্স রেটিং প্রায় ২,২০০ পয়েন্ট বৃ্দ্ধি পায়। এ সময়কালে ইনডেক্স রেটিং ৪,১৭১ (মে,২০১৬) থেকে বৃ্দ্ধি পেয়ে ৬৩১৮ (জানুয়ারী, ২০১৮) হয়। শেয়ারবাজার কেলেংকারির পর প্রথমবারের মতো ডি এস ই তে পজিটিভ ইনডেক্স রেটিং লক্ষ্য করা যায়। তবে এ রেটিং দীর্ঘস্থায়ী হয় নি। জানুয়ারি, ২০১৮- ফেব্রুয়ারী, ২০২০ এ ইনডেক্স রেটিং (৬,৩১৮-৪,৭৬৮), প্রায় ১৬০০ পয়েন্ট নিচে নেমে আসে।
শেয়ারবাজার অস্থিতিশীলতার পিছনে বেশ কয়েকটি কারণ দায়ী রয়েছে
তালিকাভুক্ত সংস্থাগুলিতে ভালো কর্পোরেট প্রশাসনের অভাব, IPO (Initial Public Companies) [একটি প্রক্রিয়া যেটির মাধ্যমে একটি প্রাইভেট কোম্পানি প্রথমবার শেয়ার বিক্রির মাধ্যমে কোনো স্টক মার্কেটে অন্তর্ভূক্ত হয়] বিক্রির ক্ষেত্রে যেখানে অন্যান্য দেশের শেয়ার বাজারে ভালো কোম্পানিগুলোকে নির্ধারণ করা হয় সেখানে আমাদের ২ টি স্টক মার্কেট (ঢাকা ও চট্টগ্রাম) এ নিম্নমানের কোম্পানি নির্ধারণ করা হয় যার মাধ্যমে স্টক মার্কেটে অস্থিতিশীলতা দেখা যায়।
এছাড়াও প্লেসমেন্ট শেয়ার সম্পর্কিত অনুমোদিত সংস্থাগুলির জন্য কিংবা মিউচুয়াল ফাণ্ডের সংস্থাগুলির জন্য স্টক মার্কেটগুলোতে যে সকল নিয়মকানুন প্রচলিত রয়েছে তা বেশ জটিল ও পুরোনো। এ সকল পুরোনো ও জটিল নীতিমালা যেমন বৈদেশিক কোম্পানিগুলোকে আমাদের শেয়ার বাজারে বিনিয়োগে বাঁধা দিচ্ছে ঠিক তেমনি দেশীয় উচ্চমানের কোম্পানিগুলোকে শেয়ার বাজারে এনলিস্ট হতে নিরুৎসাহিত করে। এ ছাড়াও সঞ্চয়পত্র/ এফডিআরগুলিতে (তুলনামূলকভাবে ঝুঁকিপূর্ণ বিনিয়োগ) উচ্চ সঞ্চয় হারের প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে যা শেয়ার বাজারে বিনিয়োগকে নিরুৎসাহিত করে।
এছাড়াও ২০১০ সালে শেয়ার বাজার কেলেংকারির পর শেয়ার বাজারে পুনরায় আস্থা ফেরানোর নিমিত্তে বিভিন্ন আইনের পরিমার্জন, পরিবর্তন করা হয় যেটির অনেক নিয়ম এখন পর্যন্ত অবাস্তবায়িত রয়ে গেছে। এ রকম কয়েকটি আইনের অন্যতম একটি আইন –‘নূ্ন্যতম শেয়ার ধারণ’। এ আইনানুযায়ী ‘স্টক এক্সচেঞ্জভুক্ত কোনো প্রতিষ্ঠানের পরিচালকের হাতে ২% এর কম শেয়ার থাকলে তাকে সেই পদ ছাড়তে হবে’। কিন্তু নভেম্বর, ২০১১ সালে বি.এস.ই.সি [BSEC] – (Bangladesh Securities and Exchange Commission) অধীনে পুনগর্ঠিত তৎকালীন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত এই আইন গত ৯ বছরেও কার্যকর হয়নি।
এই সকল সমস্যা তো শুরু থেকেই আমাদের স্টক মার্কেটে ছিলো কিন্তু আরও একটি নতুন চ্যালেঞ্জ যা বর্তমান সময়ে কোভিড-১৯ আমাদের সামনে এনেছে তা হচ্ছে – শেয়ার বাজারে ডিজিটালাইজেশনের অভাব। এই মহামারীর সময়ে পুরো বিশ্ব যখন লকডাউনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছিলো তখনও বিশ্বে কোথাও শেয়ার বাজার বন্ধ হয় নি। জর্ডান ও শ্রীলংঙ্কায় শেয়ার বাজার সাময়িক সময়ের জন্য বন্ধ করা হলেও তা পরবর্তী সময়ে খুলে দেয়া হয়। কিন্তু এ রকম সমন্বিত একটি ব্যাবস্থার অভাবেই ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জ, বাজার মূ্লধনের ভিত্তিতে বিশ্বে যার অবস্থান ৪৪ তম, [বাজার মূ্লধন- $33 billion] ২ মাসের অধিক [৬৬ দিন] সময় ধরে বন্ধ ছিলো।

চ্যালেঞ্জ উত্তরণে করণীয় পদক্ষেপ এবং ভবিষ্যৎ সম্ভাবনা
অনেক দিন যাবৎ সংকটে থাকা শেয়ারবাজারকে এতো দীর্ঘ সময়ের অচলাবস্থা পরিস্থিতিকে আরও সংকটাপন্ন করে তুলেছে। এ সকল সংকট দূ্র করতে যেমন সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করা উচিৎ ঠিক তেমনি গৃহীত সকল পরিকল্পনাগুলো যথাযথভাবে ও সঠিকসময়ে বাস্তবায়ন করাও জরুরী।
২০১১ সালে বি.এস.ই.সি (BSEC) এর অধীনে পুনগর্ঠিত তৎকালীন কমিশন কর্তৃক প্রস্তাবিত যে সকল আইন কার্যকর করা হয় নি সে সকল আইন অতি দ্রুত বাস্তবায়ন করার সময় এসেছে। অনলাইন নির্ভর বিশ্বে স্টক মার্কেট ডিজিটাইলাইজেশন এর যে কোনো বিকল্প নেই তা আমরা ইতোমধ্যেই টের পেয়েছি। এ প্রক্রিয়াটি সহজ করতে বি.এস ই.সি (BSEC) প্রস্তাবিত নতুন কোম্পানি [Central Counterparty Bangladesh Ltd] যতো দ্রুত সম্ভব বাস্তবায়ন করা উচিৎ এবং এ কোম্পানি এর স্বছতা নিশ্চিত করাও অতি জরুরী বিষয়।

আমাদের দেশের শেয়ার বাজার অন্যান্য দেশের মতো সুরক্ষিত নয়; আমাদের শেয়ার মার্কেটে ম্যানিপুলেশন বিষয়টি বেশ লক্ষ্য করা যায়; এর অন্যতম কারণ হচ্ছে বড় কোম্পানিগুলোর শেয়ার মার্কের্টে অতিরিক্ত প্রভাব। এই প্রভাব এতোটাই বেশি যে বাজার মূ্লধনের ভিত্তিতে প্রথম ১০ টি কোম্পানি মার্কেটের প্রায় ৫০% শেয়ার দখল করে থাকে। উপরের গ্রাফ-৪ এই weight এর ভিত্তিতে শেয়ার মার্কেটে বিভিন্ন কোম্পানির অবদান দেখানো হয়েছে। তবে বাজার মূ্লধনের ভিত্তিতে দেখলে অবশ্য গ্রামীনফোন (492 billion taka-14% of DSE’s total) সবার উপরে; ২য় ও ৩য় তে যথাক্রমে BATBC (5.36%) ও Square (4.74%)। দেশের শেয়ারবাজারে এ সকল কোম্পানির প্রভাব খুব বেশি লক্ষ্য করা যায়। এ সকল কোম্পানির যে কোনো ছোট একটি পরিবর্তন শেয়ারবাজারে প্রভাব ফেলে।
যদি আমরা গ্রামীনফোনের ক্ষেত্রে চিন্তা করি তাহলে আমরা দেখবো সরকারের ২ টি প্রতিষ্ঠান [BTRC & NBR] গ্রামীনফোনের কাছে প্রায় ১২৬০ বিলিয়ন টাকা [যথাক্রমে ৮৫০ বিলিয়ন ও ৪০৯ বিলিয়ন টাকা পায়] এবং এ বিষয়টি যখন সবার সামনে আসে প্রতিষ্ঠানের অনেক শেয়ার হোল্ডাররা তাদের শেয়ার বিক্রি করা শুরু করে দেয় যেটির কারণে লকডাউনের আগে (গত ফেব্রুয়ারি মাসে) শেয়ারবাজারে এক দিনে GP এর শেয়ারমূল্য প্রায় ৩৫% (400 tk/each- 260 tk/each) কমে যায় যার কারণে শেয়ারবাজারের ইনডেক্সে ও খুব বড় পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। GP এর শেয়ার মূল্য হ্রাস এতটাই মারাত্নক ছিলো যে কোভিড-১৯ মহামারীর কারণে স্টক মার্কেট বন্ধু হবার সপ্তাহে (মার্চ,১৯-মার্চ,২৬) শেয়ার বিক্রির ক্ষেত্রে floor price (নূন্যতম মূল্য) নির্ধারণ করা হয়।
মার্কেটের এই রকম ম্যানিপুলেশন শেয়ার মার্কেটকে ঝুঁকিপূর্ণ করে তুলে এবং সম্ভাবনাময় অনেক দেশী ও বিদেশী প্রতিষ্ঠানকে শেয়ার মার্কেটে প্রবেশে অনাগ্রহী করে তুলে। এ ক্ষেত্রে এ সকল ম্যানিপুলেশন স্টক মার্কেটে কমানোর জন্য নিয়মকানুনে ঢেলে সাজাতে হবে। দেশে প্রায় ৯২১ টি বহুজাতিক প্রতিষ্ঠান রয়েছে কিন্তু তার মধ্যে মাত্র ১১ টি স্টক মার্কেটে অন্তগর্ত রয়েছে; শুধু তাই নয় অনেক দেশীয় স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান স্টক মার্কেটে অন্তগর্ত নেয়। এ সকল স্বনামধন্য দেশীয় ও বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো যাতে শেয়ারবাজারে প্রবেশে আগ্রহী হয় সেই জন্য শেয়ারমার্কেটে প্রবেশের প্রকিয়া সহজীকরণ, অপ্রয়োজনীয় নিয়ম বাতিল, নতুন নিয়মের তৈরি ও তার সঠিক প্রয়োগ যাতে হয় সেই জন্য অভ্যন্তরীন স্বচ্ছতা নিশ্চিতকরণের বিকল্প নেই। এ ছাড়াও সরকার ব্যাংকগুলোর জন্য যে ‘Capital Market Exposure Limit’ প্রবর্তন করেছেন তা যাতে সঠিকভাবে প্রবর্তন করা হয় সে দিকেও খেয়াল রাখা উচিৎ।
আমাদের শেয়ার মার্কেটের সম্ভাবনা বরাবরই ছিলো কিন্তু দূর্নীতি ও অপরিকল্পিত নিয়মকানুন কোনো দিন এই সম্ভাবনার জায়গাকে সফল হতে দেয় নি। করোনা পরবর্তী সময়ে পুরো বিশ্ব যেখানে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের জন্য প্রস্তুতি নিচ্ছে সেখানে আমাদেরও কিছু পদক্ষেপ নেয়া উচিৎ এবং দীর্ঘদিন ধরে অবহেলায়, অনিয়মে থাকা এই শেয়ারবাজারকে নতুন ভাবে পুর্নগঠিত করার উদ্যোগ নেয়া উচিৎ।
লেখকঃ আরাফাত জুবায়ের
অর্থনীতি বিভাগ, শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়
আরো পড়ুন,
আপনার মতামত দিন