সাবেক রাষ্ট্রপতি এবং আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মো. জিল্লুর রহমানের ৭ম মৃত্যুবার্ষিকী আজ শুক্রবার।
জিল্লুর রহমান বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রপতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ছিলেন। ১৯৫২ সালের বাংলা ভাষা আন্দোলন থেকে শুরু করে এ যাবৎ দেশের সবকয়টি আন্দোলনে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। তিনি মুক্তিযুদ্ধে সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি প্রধান বিচারপতি এম এম রহুল আমিন তাঁকে বাংলাদেশের ১৯তম রাষ্ট্রপতি হিসেবে বঙ্গভবনে শপথ বাক্য পাঠ করান। আসুন মহান সাবেক এই রাষ্ট্রপতির সম্পর্কে কিছু জেনে নেয়া যাক-
প্রারম্ভিক জীবন :
১৯২৯ সালের ৯ মার্চ জিল্লুর রহমান কিশোরগঞ্জ জেলার ভৈরবে জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর বাবা মেহের আলী মিঞা ছিলেন একজন আইনজীবী, তৎকালীন ময়মনসিংহের লোকাল বোর্ডের চেয়ারম্যান এবং জেলা বোর্ডের সদস্য। তাঁর স্ত্রী আইভি রহমানও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের একজন রাজনীতিবিদ ছিলেন। ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট রাজধানী ঢাকার বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে আওয়ামী লীগের সমাবেশে গ্রেনেড হামলায় জিল্লুর রহমান তাঁর সহধর্মিনী ও মহিলা আওয়ামী লীগের তৎকালীন সভানেত্রী আইভি রহমানকে হারান। পারিবারিক জীবনে তিনি বর্তমান সংসদ সদস্য ও বাংলাদেশ ক্রিকেট বোর্ডের বর্তমান সভাপতি নাজমুল হাসান পাপন নামে এক পুত্র এবং তানিয়া ও ময়না নামে দুই কন্যা সন্তানের জনক।

শিক্ষাজীবন :
তার বাড়ীর পাশের ভৈরব আদর্শ প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তার প্রাথমিক শিক্ষা শুরু হয়। এখান থেকে পাশ করে ১৯৪১ সালে তিনি ভৈরব কে.বি পাইলট মডেল হাই স্কুলে চলে যান। সেখান থেকে মাধ্যমিক পাশ করেন ১৯৪৬ সালে। তারপর ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজ থেকে তিনি আইএ পাশ করেন। জিল্লুর রহমান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হতে ইতিহাস বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন। একই বিশ্ববিদ্যালয় হতে তিনি আইন বিষয়ে স্নাতক ডিগ্রি লাভ করেন।
রাজনৈতিক জীবন :
মহান ভাষা আন্দোলনের মাধ্যমে তার রাজনীতিতে হাতেখড়ি। সে সময় তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফজলুল হক হলের জিএস ছিলেন। দেশের বিভিন্ন আন্দোলন সংগ্রাম ও ক্রান্তিলগ্নে তার ভূমিকা অবিস্মরণীয়। মহান মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ছিলেন তিনি। দল-মত নির্বিশেষে তিনি সবার কাছে সমভাবে গ্রহণযোগ্য ছিলেন। কিশোরগঞ্জের ভৈরব-কুলিয়ারচর আসন থেকে তিনি ছয়বার সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
এর আগে ২০০৯ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি দেশের রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নিয়েছিলেন। এর আগে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ দলীয় সরকার গঠন হলে তিনি স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী এবং সংসদের উপনেতা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন।
২০০৬ সালের ১১ জানুয়ারি ফখরুদ্দীন আহমদের তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব নিলে যখন শেখ হাসিনা গ্রেফতার হন তারপর থেকেই জিল্লুর রহমান বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের হাল ধরেন। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন ১৪-দলীয় মহাজোট বিপুল ভোটে জয়লাভ করে। নবম জাতীয় সংসদে জিল্লুর রহমান সংসদ উপনেতা নির্বাচিত হন।

জিল্লুর রহমানের অনন্য ব্যাক্তিত্ব ও সফলতা:
প্রকৃত উদার এবং শুভবুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিত্ব জিল্লুর রহমানের ছিল বিরুদ্ধবাদীদের কাছে টানার সম্মোহনী শক্তি। দেশের দুর্দিনে ব্যক্তিগত দুঃখ-বেদনাকে শক্তিতে রূপান্তরিত করে জিল্লুর রহমান আবির্ভূত হয়েছেন যুগান্তকারী নেতৃত্বের ভূমিকায়। ২০০৭ সালে দেশে জরুরি আইন জারি এবং আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনাসহ রাজনৈতিক নেতারা গ্রেপ্তার হলে জিল্লুর রহমান এগিয়ে এসেছিলেন দেশ ও মুক্তিকামী মানুষের টানে। তিনি হয়ে উঠেছিলেন গোটা রাজনীতি পুনরুদ্ধারের বাতিঘর।
বাংলাদেশের রাজনীতিতে যে কয়েকজন হাতেগোনা নির্লোভ, নিরহংকারী, চরিত্রবান, দৃঢ়চেতা আর দূরদর্শী নেতা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে জিল্লুর রহমান ছিলেন অন্যতম। ভাষা আন্দোলনের গোড়াতে ছিলেন জিল্লুর রহমান। রাষ্ট্রভাষা বাংলার দাবিতে অগ্রণী ভূমিকায় ছিলেন তিনি। পাকিস্তানবিরোধী আন্দোলনের কারণে সেই সময়ে তাঁর সনদপত্রও বাতিল হয়েছিল।
সংস্কৃতি ও সামাজিক মানুষের সঙ্গে মিশেছেন শৈশব থেকেই। সপ্তম শ্রেণির ছাত্রাবস্থায় ‘মুকুল মেলা’ এবং কলেজজীবনে ‘প্রগতিশীল যুব সংগঠন’-এর সাধারণ সম্পাদক ছিলেন। রাজনীতি তাঁর প্রধানতম ক্ষেত্র হলেও আত্মপ্রকাশের একমাত্র মাধ্যম নয়। সব রকম দুর্দিনেই থেকেছেন মানুষের পাশে—দেশের পাশে। উন্নত-প্রগতিশীল সমাজ বাস্তবায়নে জীবনসংগ্রামী জিল্লুর রহমানের রাজনৈতিক চিন্তা-দর্শনে উল্লেখযোগ্য প্রভাব রয়েছে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের। সিলেট ভারত না পাকিস্তানে থাকবে, সেই প্রশ্নে গণভোট হয়েছিল ১৯৪৭ সালে। সিলেটবাসীর আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করতে জিল্লুর রহমান যখন সিলেটে গিয়েছিলেন, তখন তিনি ঢাকা ইন্টারমিডিয়েট কলেজের মুসলিম ছাত্রলীগের সভাপতি। সেখানেই শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে তাঁর প্রথম দেখা হয়। একটি প্রবন্ধে তিনি উল্লেখ করেছেন এভাবে,
‘আমি অন্যদের সঙ্গে নিয়ে মুজিব ভাইয়ের পাশে যাই। তাঁর পা ছুঁয়ে সালাম করি। তিনি আমাকে বুকে জড়িয়ে ধরেন। মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে দেখা ও কথা হওয়ার পর থেকে সক্রিয় রাজনীতির প্রতি আগ্রহ বেড়ে যায়। তখন থেকেই মূলত রাজনীতিতে সক্রিয়ভাবে প্রবেশ করি।’
দেহাবসান :
দীর্ঘদিন রোগে আক্রান্ত হয়ে ১০ মার্চ, ২০১৩ তারিখে কিডনি ও মূত্রপ্রদাহে আক্রান্তজনিত কারণে উন্নত চিকিৎসার জন্য সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে ভর্তি হন জিল্লুর রহমান। এর পূর্বদিন সম্মিলিত সামরিক হাসপাতালে ফুসফুসের সংক্রমণ ব্যাধিতে আক্রান্ত হয়ে চিকিৎসাধীন ছিলেন। রাষ্ট্রপতির পদ অলংকৃত অবস্থায় ২০১৩ সালের ২০ মার্চ জিল্লুর রহমান মৃত্যুবরণ করেন। তাঁর প্রয়াণে দল-মত-নির্বিশেষে সব শ্রেণি-পেশার মানুষ তিন দিনের রাষ্ট্রীয় শোক কর্মসূচি পালন করে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বের ইতিহাসে এটিও একটি অনন্যসাধারণ ঘটনা।
জিল্লুর রহমানের অনাড়ম্বর জীবন, বিনয় ও উদারতা বর্তমান রাজনীতিতে অনুকরণীয় হতে পারে। রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্মৃতি বাংলাদেশ ও বাঙালির মনে চিরজাগরূক থাকুক। এই মহান নেতার প্রয়াণ দিবসে জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।