শত বছর আগে ফিরে যাওয়া যাক। ১৯২০/২১ মৌসুমের লোকাল বাউরাল দলের খেলা চলছিল। তো একদলের খেলোয়াড় সংখ্যা কোনো ভাবেই ১১ জনই হচ্ছিল না। সে দলের অধিনায়ক জর্জ হোয়াটম্যানের ভাতিজা আবার ঐ ম্যাচের স্কোরার। কোনো উপায় না পেয়েই নিজের ভাতিজাকে মাঠে নামিয়ে দিলেন হোয়াটম্যান। তো স্কোরার থেকে মাঠে খেলার সুযোগ কে পেলেন জানেন? স্যার ডন ব্র্যাডম্যান! এক নাটকীয় ভাবে ক্রিকেট মাঠে নেমে পড়া যাকে বলে। সে ম্যাচের দুই ইনিংসে যথাক্রমে ৩৭ এবং ২৯ রান করে নট আউট ছিলেন ব্র্যাডম্যান।
এরপর ওই মৌসুমেই সিডনি ক্রিকেট গ্রাউন্ডে অ্যাশেজের ৫ম এবং শেষ টেস্ট দেখতে ডন ব্র্যাডম্যানকে সঙ্গে নিয়ে যান তার বাবা। মাঠের পরিবেশ আর খেলা দেখে এমন ভাবেই ডন অবিভূত হলেন যে সেদিন বাবাকে প্রতিজ্ঞা করেছিলেন, “এই স্টেডিয়ামে না খেলা পর্যন্ত আমি কখনো শান্তি পাবো না”। এরপরেই ১৯২২ সালে স্কুল ছেড়ে ব্র্যাডম্যান যোগ দেন এক রিয়েল স্টেট কর্মীর সঙ্গে। তিনিই ব্র্যাডম্যানকে খেলাধুলার প্রতি ঠেলে দেন।
তবে পরবর্তীতে ক্রিকেট খেলা ছেড়ে স্যার ডন একবার টেনিসে মনোনিবেশ করলেন। পরে আবার ক্রিকেটের টানে তা ছেড়েও দেন। ভেবে দেখুন তো ব্র্যাডম্যান যদি সত্যিই ওই সময় ক্রিকেট না খেলে টেনিসেই নিজের ক্যারিয়ার গড়তেন তবে ক্রিকেট বিশ্ব কেমন হত? হ্যাঁ, সত্যিই তিনি ক্রিকেট ছেড়ে দুই বছর টেনিস খেলেছিলেন এবং পেশা হিসেবে নিতে চেয়েছিলেন। তবে ১৯২৫/২৬ মৌসুমে আবারও ক্রিকেটে ফিরে আসেন এই কিংবদন্তি।
শুরুটা তখনই, স্বপ্নটা অস্ট্রেলিয়ার হয়ে টেস্ট খেলা। স্কোরার থেকে স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান হয়ে ওঠার রূপকথা। মাত্র ১৯ বছর বয়সে নিউ সাউথ ওয়েলস টিমের হয়ে প্রথম শ্রেণীর ক্রিকেটে অভিষেক হয় তার। অভিষেক ম্যাচের প্রথম ইনিংসে শতক হাঁকান ব্র্যাডম্যান।
এরপর থেকে আলো ছড়ানো শুরু। এরপর থেকে কেবল আলোর তীব্রতা বেড়েছেই, সে আলোয় ছায়া পড়েনি কখনো। হেসেছে তার ব্যাট আর গড়েছে নতুন রেকর্ড। একে একে সবাইকে টপকে ক্রিকেট ইতিহাসের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে স্বীকৃত হয়েছেন।
সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান স্যার ডোনাল্ড ব্র্যাডম্যান সম্পর্কে নতুন করে বলার কি কিছু আছে? ৫২ টেস্টে ৯৯.৯৪ গড়, ২৯ সেঞ্চুরি, ১২টি ডাবল সেঞ্চুরি, ৫ টেস্টের এক সিরিজে সবচেয়ে বেশি ৯৭৪ রানের রেকর্ডটা তারই দখলে।
ক্রিকেট ইতিহাসে এখন পর্যন্ত ত্রিপল সেঞ্চুরি হয়েছে ৩১ টি । চারজন ব্যাটসম্যান দুটো করে ত্রিপল করায় ট্রিপল সেঞ্চুরি করা ব্যাটসম্যানের সংখ্যা ২৩। ব্র্যাডম্যান সেই চারজনের একজন, যিনি কিনা দু’বার ত্রিপল সেঞ্চুরি করেছেন। তবে এর মাঝেও ব্র্যাডম্যানের একটা ব্যতিক্রমী রেকর্ড আছে। ব্র্যাডম্যানই টেস্ট ক্রিকেটের একমাত্র ব্যাটসম্যান, যিনি ২৯৯ রান করে অপরাজিত ছিলেন।
ব্র্যাডম্যান টেস্টে সেঞ্চুরি করেছেন ২৯ টি। যদি ইনিংস অনুপাতে সেঞ্চুরি হিসেব করা যায় অবিশ্বাস্য পরিসংখ্যান চোখের সামনে চলে আসবে। সেটা হলো, ব্র্যাডম্যান প্রতি ১.৭৯ ইনিংসে একটি করে সেঞ্চুরি হাঁকিয়েছেন। এমন অনুপাত আর কারো নেই ক্রিকেট বিশ্বে।
৫২ টেস্টে ৬৯৯৬ রান আর ৯৯.৯৪ রেকর্ডধারী স্যার ডন ব্র্যাডম্যান ১০০ টা টেস্ট খেললে কিংবা শচীনের মতো ২০০ টা টেস্ট খেললে কি এই একই গড়ে খেলে যেতে পারতেন? এমন প্রশ্ন আমার, আপনার সবার মনে উদয় হতেই পারে। তিনি এই গড়ে খেলতে পারতেন কিনা সেটা ছাপিয়ে ডনের প্রথম শ্রেণির ক্যারিয়ারটা একটু আলোকপাত করা যাক। ২৩৪ টা প্রথম শ্রেণি ম্যাচের ৩৩৮ ইনিংসে স্যার ডন ব্র্যাডম্যান করেছেন ২৮০৬৭ রান। গড় ৯৫.১৪! ১৯২৮ থেকে ১৯৪৮ টানা ২০ বছর তিনি এমন ধারাবাহিকভাবেই খেলে গেছেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের কারণে স্যার ডনের টেস্ট ক্যারিয়ারের ৮ টি বছর নষ্ট না হলে তার ক্যারিয়ার গ্রাফটা তাহলে কোথায় যেত একবার ভেবে দেখুন।
টেস্টে দ্রুততম দুই হাজার (২২ ইনিংস), তিন হাজার (৩৩ ইনিংস), চার হাজার (৪৮ ইনিংস), পাঁচ হাজার (৫৬ ইনিংস) এবং ছয় হাজার (৬৮ ইনিংস) রান করেন তিনিই। তার অবসরের এত বছর পরেও এই রেকর্ড এখনও অক্ষত রয়েছে।
ব্র্যাডম্যানের সময়ে ওয়ানডে ছিল না। তাই সীমিত ওভারের ক্রিকেটে ডন কেমন করতেন তাও জানা যায়নি। তবে একটা প্রদর্শনী ম্যাচের পারফরম্যান্স দেখলে আবার ভালোভাবেই আঁচ করা যায়। এবার সতীর্থ ওয়েন্ডেল বিলের সাথে ব্ল্যাকহিথ নামে এক জায়গায় গেলেন ব্র্যাডম্যান। উদ্দেশ্য সেখানকার নতুন বানানো পিচে একটা প্রদর্শনী ম্যাচ খেলা। তখন ওভার হতো ৮ বলে। সেই ম্যাচে মাত্র ১৮ মিনিট এবং ৩ ওভারে সেঞ্চুরি পূর্ণ করেন তিনি! মোট রান করেছিলেন ২৫৬! এই রান করতে তিনি বাউন্ডারি মারেন ২৯টি, ওভার বাউন্ডারি মারেন ১৪টি! সময়টা কিন্তু আজ থেকে আরো আট দশক আগের, ১৯৩১ সালে! তাহলে বুঝে নেন এ সময়ের সীমিত ক্রিকেটে স্যার ডন কেমন হতে পারতেন।
স্যার ডনের ক্রিকেট ক্যারিয়ারে একমাত্র আক্ষেপ হয়তো ৯৯.৯৪ ব্যাটিং গড়। ৪ টি রান করলেই হতে পারতেন ১০০ গড়ওয়ালা ব্যাটসম্যান। কিন্তু এরিক হলিস সে পথে বাঁধা হয়ে দাড়ালেন। ডনের ক্যারিয়ারের শেষ ইনিংসে শূণ্য রানে ফিরিয়ে ক্রিকেট বিশ্বের অন্যতম আক্ষেপের জন্ম দেন তিনি। নার্ভাস নাইন্টি গড়ে কাটা পড়া ব্র্যাডম্যান জীবনের ঘড়ির কাঁটায় কাটা পড়েছিলেন নার্ভাস নাইন্টিতেই(৯২ বছর বয়সে)। কিন্তু বর্ণাঢ্য ক্যারিয়ার ডনকে পরিণত করেছিল একজন ‘স্যার’ ডন ব্র্যাডম্যান হিসেবে।
১৯০৮ সালের আজকের এই দিনে (২৭ আগস্ট) জন্মগ্রহণ করেন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান।
শুভ জন্মদিন স্যার ডন ব্র্যাডম্যান…
স্যার ডন ব্র্যাডম্যান, আপনাকে কুর্নিশ
আরো পড়তে পারেন