📚বইয়ের নাম: মরণ বিলাস
👤লেখক: আহমদ ছফা
📃প্রকাশনা: খান ব্রাদার্স অ্যান্ড কোম্পানি
📑ক্যাটাগরি: উপন্যাস
💷মূল্য: ১৩২৳
বাংলাসাহিত্যে এ পর্যন্ত যত প্রাবন্ধিক, লেখক এবং সাহিত্যিক জন্মগ্রহণ করেছেন তাদের মধ্যে নিঃসন্দেহে সবচেয়ে সাহসী, বুদ্ধিমান, কুশলী, বহুমুখী এবং তেজদীপ্ত লেখকদের তালিকায় একটি নাম জ্বলজ্বল করবে, নামটি “আহমদ ছফা”। মননশীল এবং সত্যসমৃদ্ধ স্পষ্টবাদী সাহিত্যক আহমদ ছফা ছিলেন সুবিধাবাদের বিরুদ্ধে এক প্রতিবাদী কণ্ঠ এবং আদর্শনিষ্ঠ-প্রগতিপন্থী একজন গণবুদ্ধিজীবী। নতুন নতুন বিষয় অনুসন্ধান করা তার সাহিত্যের প্রকৃতিজাত স্বভাব।তার উপন্যাসের ভেতর দিয়ে তিনি মানুষের জীবনের-মনস্তত্ত্বের ভাল-খারাপ নানান বিষয়ের আলোকপাত করেছেন খুবই সহজ-সরল ভাষায়।
মরণ বিলাস। আহমদ ছফার একটি রাজনৈতিক উপন্যাস। নষ্টসময়ের রাজনীতিতে একজন নষ্টরাজনীতিকের রাজনৈতিক সামাজিকায়ন অথবা পেশাদার রাজনীতিক হয়ে ওঠার এক অনবদ্য বর্ণনা-এ উপন্যাসটি। আকারে ছোট, মাত্র ৮৬ পৃষ্ঠার এক সুখপাঠ্য উপন্যাস। “মরণ বিলাস” আমার পড়া উপন্যাসগুলোর মধ্যে খুবই বিশিষ্ট একটি রচনা। উপন্যাসটি রচিত হয় ১৯৮৮ সালে, এবং পরের বছরই সেটি প্রকাশিত হয়।
উপন্যাসের মূল চরিত্র জনাব ফজলে ইলাহি, তিনি দেশের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী, যিনি কিনা এক সময়ে পাকিস্তান আমলেও মন্ত্রী ছিলেন এবং ক্রমাগত ভোল পাল্টে মন্ত্রিত্ব বহাল রেখেছেন স্বাধীন বাংলাদেশেও। তিনি মৃত্যুপথযাত্রী, বুঝতে পারছেন ভয়াবহ ক্যান্সারে তিনি মৃত্যুর দিকে ক্রমাগত এগুচ্ছেন। মৃত্যু শয্যায় তিনি দেখতে পাচ্ছেন ইতিপূর্বে করা তার সকল অপকর্ম তার দিকে যেন তেড়ে আসছে, আর মৃত্যুর আগে শেষ সময়টুকু তিনি কাউকে অপকর্মের কথা বলে হালকা হতে চাইছেন। রোগীর সাথে রাতে থাকেন মাওলা বক্স নামক মেরুদণ্ডহীন তোষামুদে এক ব্যক্তি, হাসপাতালে শুয়েশুয়ে যার কাছে মন্ত্রীসাহেব তার অতীতস্মৃতিচারণ করছেন। ছফার বর্ণনায় এ-স্মৃতিচারণ এতটাই সাবলীল হয়ে ওঠে যে, পাঠকের মনে হবে যে, তিনি আসলে তাঁর সময়কার কোন নষ্টরাজনীতিককে প্রত্যক্ষ করছেন। চরিত্রটা তাঁর খুব চেনা। যাকে তিনি প্রতিদিন দেখেন, টেলিভিশনে, পত্রিকায় অথবা কোন জনপরিসরে।
পাঠক একই সাথে খুঁজে পাবেন ইতিহাসের উপাদান-রাজনীতিতে ধর্মের অপব্যবহার, রাজনীতিকদের কুৎসিত যৌনবিলাস, বহুগামিতা ইত্যাদি।
উপমহাদেশের দ্বি-মেরুকৃত সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার প্রেক্ষাপটে হিন্দু মধ্যবিত্তের নাক সিটকানো, আর পশ্চাৎপদ মধ্যবিত্ত বাঙালি মুসলমানের হীনমন্যতা কিভাবে সাম্প্রদায়িকতার জন্ম দেয়, সদ্ভাবপূর্ণ দুটি সম্প্রদায়কে কিভাবে ঠেলে দেয় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের দিকে, তার তাৎপর্যময় বর্ণনা করেছেন আহমদ ছফা।
উপন্যাসে দেখা যায়, এক এক করে নিকৃষ্ট কর্মের বর্ণনা শুনে, মাওলা বক্সের মত তোষামুদে ব্যক্তিও বিষিয়ে ওঠে সেই সব অপকর্মের ভারে। তার মনে হতে থাকে এই সব নৃশংসতার কাহিনী তাঁর স্নায়ুকে অবশ করে দিচ্ছে। কিন্ত মন্ত্রীসাহেব তার করা পাপ নিয়ে মোটেই দুঃখিত নন,তিনি স্বীকার করেন সকল অপকর্ম তিনি পরিষ্কার বিবেকে করেছেন কিন্তু দায়ভার চাপিয়ে দেন সমাজ-মহাকাল-ইতিহাস ইত্যাদি বায়বীয় জিনিসের উপর। তা সত্ত্বেও মন্ত্রী জানেন তিনি মানুষ নন, তার ভাষায়, “আমি জানি আমি পশু এবং সারাজীবন পশ্বাচারই করেছি”। অনেক পাপ, অনেক হত্যার দায়ভার তার উপর, কিন্তু দেশভাগের দাঙ্গার সময় নিঃস্বার্থ ভাবে জীবন বাজি রেখে একটি কিশোরকে বাঁচানোর স্মৃতি তাকে নিজের ভিতরকার মানুষটিকে অনুভব করায়–“আমার পাপ কর্মগুলো আমাকে গ্রেপ্তার করার জন্য উন্মত্ত আবেগে উদ্বাহু নৃত্য করছে। কিন্তু কাছে ঘেষতে পারছে না। কিশোরটি আমাকে রক্ষা করছে। মাওলা বক্স,আমার মানবজন্ম বৃথা যায়নি। আমারও কিছু সুকৃতি আছে। আমি উদ্ধার পেয়ে যাবো।” হয়তো তাই..আলোর একটি শিখা অনেকখানি অন্ধকার মুছে দেয়–কে না জানে সে কথা!এভাবে, নাতিদীর্ঘ, তবে সুখপাঠ্য উপন্যাসটির কেন্দ্রীয় চরিত্র ফজলে ইলাহির জবানের মাধ্যমে আহমদ ছফা মানুষের জীবনের উত্থান-পতন, চড়াই-উৎরাইসহ নানা বিষয়ের যে শৈল্পিক বর্ণনা দিয়েছেন, বোধ করি পাঠককে তা নিরাশ করবেনা মোটেই !
চলুন উপন্যাসটির কিছু উদ্বৃতি নিয়ে প্রেক্ষাপট আলোচনা করি।
“মাওলা বক্স হুইস্কির মাহাত্ম্য আমি তোমার চেয়ে কম বুঝিনে। কিন্তু জীবনে একটা বিশেষ মুহূর্ত আসে যখন স্নায়ু তাতিয়ে ভয় তাড়ানো যায় না।”
ঠিক, অতিমাত্রায় ঠিক। মৃত্যুর দোরগোড়া অবধি না গিয়েও একজন মৃত্যুপথযাত্রীর মনের অনুভূতি এত সাবলীল ও সূক্ষ্ম করে পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে ফুটিয়ে তোলা, নিজ মানস দিয়ে অপরের জীবন এত গভীরভাবে উপলব্ধি করা শুধু আহমদ ছফার দ্বারাই হয়তো সম্ভব। ছফা’র ‘মরণ বিলাস’ বইটির কাহিনী গড়ে উঠেছে মৃত্যুশয্যায় শায়িত একজন মন্ত্রী ফজলে ইলাহী ও তার সেবক মাওলা বক্সকে নিয়ে। তাদের কথোপকথনে, তর্কে-বিতর্কে, পারস্পরিক স্তুতি ও নিন্দায়, কখনো স্বগতোক্তিতে, কখনো সুস্পষ্ট উচ্চারণে, কখনো শালীন বাক্যে, কখনো খিস্তিতে, কখনো তীব্র ঘৃণায়, কিংবা কখনো বিনম্র শ্রদ্ধার অনুভূতিতে পেরিয়ে যায় হাসপাতালের শেষ রাতটি- আসে নতুন ভোর। কিন্তু সেই ভোরটি অবশ্যই অন্যরকম হয়।
“মাওলা বক্স তুমি একটা আস্ত শুয়োরের বাচ্চা, মৃত্যুর সময় মাওলানা ডেকে আমাকে দুর্বল করে ফেলতে চাও! সেটি হচ্ছে না মাওলা বক্স, সেটি হচ্ছে না।”
কাহিনীর মূল নায়ক ফজলে ইলাহী একজন শক্তিশালী রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব। তিনি দেশের ক্ষমতাসীন সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তার ক্ষমতা এখনও বজায় আছে, ধড়ে এখনও জীবন আছে। কিন্তু কঠিন রোগের কারণে তার ভঙ্গুর জীবনের অনিশ্চয়তা তাকে সময়ের আগেই রূঢ় বাস্তবতার মুখোমুখি করেছে। একজন মহাক্ষমতাবান মন্ত্রী মৃত্যুশয্যায় শুয়ে আছেন, কিন্তু তার শয্যার পাশে একজন পেশাদার স্বার্থান্বেষী সেবক ব্যতীত কেউ নেই- সহকর্মী, তোষামোদকারী, নেতা, এমনকি পরিবার-পরিজন কেউ না। ক্ষণে ক্ষণে জ্ঞান হারানো মন্ত্রীসাহেব যখনই সম্বিৎ ফিরে পান, তখনই তার মস্তিষ্কের অলিগলি ছাপিয়ে তার অতীত জীবনের সব স্মৃতি ভিড় করে আসে তার চোখের সামনে। সেসব স্মৃতি মূলত অসৎ কর্মের, পাপের স্মৃতি। তার যেসব পাপবোধ তাকে কোনোদিন স্পর্শ করতে পারেনি, কিংবা স্পর্শ করলেও গ্রাস করতে পারেনি, সেসব তাবৎ পাপরাজি মরণের কিনারায় এসে তাকে ঘিরে ধরেছে। তার দুরবস্থা টের পেয়ে যখন সেবক মাওলা বক্স তাকে তওবা করানোর জন্য মাওলানা ডাকার অনুমতি চায়, তখনই ধমক খেয়ে তাকে থেমে যেতে হয়-

না, ফজলে ইলাহী চাননি প্রথাগত পদ্ধতিতে নিজের পাপ স্বীকার করতে। সৃষ্টিকর্তার কাছে ক্ষমা চাওয়ারও তার কোনো ইচ্ছে দেখা যায় না। পাপ স্বীকার করার চাইতে বড় কঠিন কাজ তার জন্য ছিল পাপকে পাপ বলে গ্রহণ করা। যে পাপবোধের মুখ চেপে ধরে তিনি অন্তরের অন্দরে দাফন করে রেখেছিলেন সারাটি জীবন, জীবনের শেষ মুহূর্তে সেই পাপবোধ নিজের কফিন ভেঙে তার সামনে এসে দাঁড়িয়েছে। স্বীকারোক্তির চেয়ে তাই আত্মোপলব্ধি তার জন্য বেশি জরুরি। এমন না যে উপলব্ধি তার কখনো হয়নি; কিন্তু পাপরাজির দুষ্টচক্রে পড়ে, পাপকে পাপ দিয়ে ঢাকতে গিয়ে সঠিকভাবে অনুতপ্ত হবার যথেষ্ট সময় তার হয়ে ওঠেনি। তাই জীবনের শেষ প্রান্তে দাঁড়িয়ে ফজলে ইলাহী চান একজন শ্রোতা, যে কোনো বাধা না দিয়ে শুধু তার কৃতকর্মের ফিরিস্তি শুনে যাবে। দুঃসহ চেতনার ভারে, আর মৃত্যুর পরের অজানা জীবনের অনিশ্চয়তায় পড়েই হয়তো দিশেহারা হয়ে ওঠেন মন্ত্রী ফজলে ইলাহী।
“উত্তেজিত হয়ে লাভ নেই, শুনে রাখো, মানুষ মানুষের কর্মের বিচারক হতে পারে না। তারপরেও তোমার মন যদি কৈফিয়ত দাবি করে বসে, অবশ্যই আমারও কিছু বলার থাকবে।”
ফজলে ইলাহী মূলত তার জীবনের তিনটি বিশেষ ঘটনা বর্ণনা করেন মাওলা বক্সের কাছে। কাম, লালসা, ঘৃণা আর অবিবেচনার মোড়কে আবৃত এই ঘটনাগুলো যেন মানব জীবনের চিরন্তন কদর্যতারই প্রতীক। প্রতিটি পাপকেই ফজলে ইলাহী পাশ কাটিয়ে এসেছেন, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন, জীবনে খ্যাতি ও প্রতিপত্তি অর্জন করেছেন, কিন্তু জীবন সায়াহ্নে এসে তার সকল অর্জনের নিষ্ফলতা তার সামনে প্রকট। ছফা অতি সন্তর্পণে কথোপকথনের ছলে কাহিনী প্রবাহ এগিয়ে নিয়েছেন। কিন্তু তিনি কখনোই পাঠককে বিচারকের আসনে বসাতে চাননি। ফজলে ইলাহীর উক্তির মাধ্যমে তাই তিনি পাঠককে যেন একপ্রকার সাবধানই করে দিয়েছেন-
এটিই এই বইয়ের সবচেয়ে আকর্ষণীয় ব্যাপার। আহমদ ছফা শুধু গড়গড় করে কাহিনী বলে গিয়ে লেখকের দায় সেরে ফেলেননি। তিনি পাঠককে তার কাহিনীর ও কাহিনীর ভেতরের কাহিনীর অন্তর্ভুক্ত করেছেন। তিনি পাঠককে চিন্তা করতে উদ্বুদ্ধ করেছেন, ভাবতে উৎসাহিত করেছেন, একইসাথে অন্ধভাবে বিচার করতে বাধা দিয়েছেন। শুনতে যতই খারাপ লাগুক, পরমত সহিষ্ণুতা কিংবা পরের মত অন্তত শোনা যে একটি তাৎপর্যবাহী জিনিস, তা ছফা বইটির শেষ পাতা পর্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়ে দেখিয়েছেন।
মূল তিনটি গল্পের বা ঘটনার বাইরে আরও একটি ঘটনা ছিল ফজলে ইলাহীর জীবনে, যা তাকে আকণ্ঠ নিমজ্জিত পাপবোধের মধ্যেও মুক্তির আলো দেখায়। একজন জনমপাপী ফজলে ইলাহীর কি এতটা দুঃসাহস করা উচিত? এতখানি সম্ভাবনা কি আদৌ তার মধ্যে আছে? পাহাড় সমান পাপ করার পরেও কি একজন মানুষের পাপমুক্তির স্বপ্ন দেখা উচিত? ছফা ফজলে ইলাহীর ভাষায় বলেছেন,
“ওহে মাওলা বক্স, তোমার সমস্ত হিসেব মুদি দোকানদারের মতো। তুমি যে অতো মানুষ হওয়ার গৌরব করছো, নিজেকে প্রশ্ন করে দেখো তুমিও কি মানুষ। মানুষের উচ্চতা, মানুষের গভীরতার কি জানো তুমি?”
“আমার মানব জন্ম বৃথা যায়নি… আমার আশা আছে মাওলা বক্স, আশা আছে!”
প্রকৃতই তো! ভালো-মন্দ, পাপ-পুণ্য মিলিয়েই তো মানব জীবন। একটি স্বার্থহীন সৎকাজেরও হয়তো অসীম ক্ষমতা থাকে সহস্র পাপকর্মকে ম্লান করে দেবার। হয়তো থাকে, হয়তো থাকে না। কিন্তু ছফা ইঙ্গিত করেছেন এই সুযোগটা গ্রহণ করার প্রতি। হয়তো এই উপায়েই আমরা ফজলে ইলাহীর সাথে কন্ঠ মিলিয়ে বলতে পারবো,
‘মরণ বিলাস’ এর ছফা ঘোর আশাবাদী। মানুষ ও মানুষের জীবন নিয়ে তার দৃপ্ত আশাবাদই মূলত ব্যক্ত হয়েছে এই বইটিতে। তিনি মানুষের প্রগতিতে ও চিরন্তন সম্ভাবনায় বিশ্বাস স্থাপন করেছেন। ফজলে ইলাহীর মতো মানুষরা মৃত্যুর পরে স্বর্গে যায় নাকি নরকে, সে প্রশ্ন উহ্যই থাক। জীবিতাবস্থায় স্বর্গ আর নরকের সহাবস্থানে মানুষের আস্ফালন, পথ নির্ধারণ আর, স্বাধীন ইচ্ছার সঠিক ব্যবহার আর সর্বোপরি এক চিরন্তন অপার সম্ভাবনার মধ্যে দিয়েই মানবজীবন মহিমাময় হয়ে ওঠে। আর তাই মানবজীবন তথা মানুষ সম্পর্কে সংকীর্ণ ধারণা পোষণ করার পক্ষপাতী ছফা নয়।
“মাওলা বক্স তুমি নিষ্ঠুর এবং হৃদয়হীন মানুষ। তোমার নিষ্ঠুরতার সাথে দুনিয়ার কোনো একনায়কের নিষ্ঠুরতার তুলনা হয় না। তুমি এমন একটি পদ্ধতি অনুসরণ করে যুক্তিজাল বিন্যাস করছো যা আমাকে নিজের কাছে তুচ্ছ এবং অকিঞ্চিৎকর করে তুলেছে। তুমি আমার আমিত্বকে খন্ড খন্ড করে কেটে ফেলছো।”
এই বইটিকে একটু অন্য নজরে দেখলে এর নায়ক হিসেবে ফজলে ইলাহীকে না ভেবে তার সেবক মাওলা বক্সকেও ভাবা যায়। কারণ তার স্বগতোক্তি, তার নিজস্ব চেতনার প্রবাহই মূলত পাঠককে এই কাহিনীতে অন্তর্ভুক্তিকরণের কাজ করেছে। একজন তোষামুদে, মিথ্যুক মাওলা বক্স যেভাবে মনোজগতে বিশাল পরিবর্তনের মাধ্যমে এক রাতের মধ্যে এক অন্য মানুষে পরিণত হয়, তা-ও কম নায়কোচিত নয়। যে ফজলে ইলাহী মাওলা বক্সকে কাহিনীর শুরুর দিকে বলেন, “মাওলা বক্স তুমি চাটুকার। তোমাকে ঘৃণা করতে ইচ্ছা হয়। তবু আমি তোমার তারিফ করি। তুমি ঠিক সময়ে ঠিক কথাটি বলে ফেলতে পারো। এটি তুচ্ছ জিনিস নয়।”- তার মুখেই শেষের দিকে আমরা শুনতে পাই,
ঠিক তা-ই। কাহিনীর অগ্রগতির সাথে সাথে, রাত যতই ভোরের দিকে গড়াতে থাকে, ততই মাওলা বক্সের মনোজগতে আমূল পরিবর্তন আসতে থাকে। পরিস্থিতি তাকে বাধ্য করে তার পেশাদার তোষামুদে আবরণখানি ঝেড়ে ফেলে বিদ্রোহী হয়ে উঠতে। একজন পাপিষ্ঠ মন্ত্রী নিজের পাপ রোমন্থনের ছলে যেন তার বহুকষ্টে লভিত জীবনবোধ তার সেবকের ভেতরে ছড়িয়ে দিলেন। মন্ত্রী ও সেবক দুজনের জন্যই সে রাত শেষের ভোরটি অন্যরকম ভোর ছিল।
আহমদ ছফা তার সূক্ষ্ম জীবনবোধ ও মানব দর্শন প্রকাশ করেছেন ‘মরণ বিলাস’-এ। মানুষের জীবনের নগ্নতম অবয়বটি চূড়ান্ত বাস্তববাদিতার সাথে ফুটিয়ে তুলে পাঠককে তিনি ভাবিয়েছেন; যারা আগেও ভেবেছেন, তাদের আরও আরেকবার ভেবে দেখার আগ্রহ জাগিয়েছেন। একইসাথে তিনি সাম্প্রদায়িকতা, পশ্চাৎপ্রদতা, প্রভূত রিপু ও মানবীয় সীমাবদ্ধতাসমূহ অবজ্ঞা করে মানুষ হিসেবে আমাদের যে অপার সম্ভাবনা, তাকে জড়িয়ে ধরার আহবান জানিয়েছেন। নিঃসন্দেহে ‘মরণ বিলাস’ আহমদ ছফার শ্রেষ্ঠতম কীর্তিগুলোর একটি। ভাবতে ভালোবাসেন এমন পাঠকদের জন্য এটি আহমদ ছফার এক অনবদ্য উপহার।