দেশভাগের পর সাতচল্লিশেই বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়েছিল। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে সরব হয়েছিলেন কয়েকজন লেখক, সাংবাদিক ও সাংস্কৃতিক কর্মী। তাদের মধ্যে অন্যতম একজন হলেন সাঈদ হায়দার ।

সাঈদ হায়দার হলেন একজন বাংলাদেশী ডাক্তার ও লেখক। তিনি ১৯৫২ এর ভাষা আন্দোলনের একজন সক্রিয় কর্মী ছিলেন। তিনি একুশের চেতনা পরিষদের সহসভাপতি ও প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম সহযোগী নকশাবিদ। ভাষা আন্দোলনে তার অবদানের জন্য বাংলাদেশ সরকার ২০১৬ সালে তাকে একুশে পদক প্রদান করে।
তিনি ১৯২৫ সালের ৫ পৌষ পাবনা শহরে জন্মগ্রহণ করেন। তিনি কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে আইএ পাশ করেন। কলকাতা মেডিকেল কলেজে ভর্তি হলেও দেশ ভাগের পর ঢাকা মেডিকেল কলেজে পড়াশোনা করেন। তিনি সহশিক্ষার্থীদের মধ্যে সবার বয়োজ্যেষ্ঠ ছিলেন। ভাষা আন্দোলন সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করেছিলেন। ২৩শে ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেল কলেজে ছাত্ররা প্রথম শহীদ মিনার গড়ে তোলেন আর এর নকশাকারী ২ জনের ১ জন হলেন তিনি, যা ২৬ ফেব্রুয়ারি পাকিস্তান সেনাবাহিনী ধবংস করে দেয়। শহীদ মিনার নির্মাতাদেরও একজন তিনি।

প্রবীণ এই ভাষাসংগ্রামীর বয়স এখন ৯২, তবে চোখে-মুখে এখনো খেলা করে তারুণ্যের দীপ্তি। তাঁর সঙ্গে কথা হচ্ছিল রাজধানীর উত্তরা মডেল টাউনের ৫ নম্বর সেক্টরে, তাঁর নিজের বাড়িতেই।
গৌরবের সাক্ষী এ ভাষাসংগ্রামী জানান, বায়ান্নর ২০ ফেব্রুয়ারি ছিল সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। সেদিন রাতে ঢাকার নবাবপুরে আওয়ামী লীগ অফিসে সর্বদলীয় কেন্দ্রীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের সভায় বিভিন্ন দলের প্রতিনিধিরা আন্দোলন নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করেন। যুবলীগ নেতা অলি আহাদ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রনেতা আবদুল মতিন ও ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ছাত্রসংসদ ভিপি গোলাম মাওলা পরের দিন ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভেঙে আমতলায় ছাত্র সমাবেশ করে মিছিল নিয়ে অ্যাসেম্বলি অভিমুখে যাত্রা ও স্মারকলিপি দেওয়ার পক্ষে জোরালো অবস্থান নেন।
ঘটনাস্থলটি মেডিক্যাল কলেজ লাগোয়া হওয়ায় সেখানে উপস্থিত ছাত্র-জনতার অধিকাংশই ছিল ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের। সে সময় মেডিক্যাল ছাত্রসংসদের সভাপতি গোলাম মাওলা ও সাধারণ সম্পাদক শরফ উদ্দিন আহমেদের নেতৃত্ব ছিল চোখে পড়ার মতো। সে সভায় মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানীরও উপস্থিত থাকার কথা ছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তিনি যোগ দেননি। এ নিয়ে তখন উপস্থিত লোকজনের মধ্যে বেশ সমালোচনাও হয়।
প্রথম শহীদ মিনারের অন্যতম এই নকশাবিদ জানান, ১৯৫২ সালে মেডিকেলে পরীক্ষা হওয়ার কথা থাকলেও তা পিছিয়ে ১৯৫৩ সালে চলে যায়। এ কারণে তিনি আরো সক্রিয়ভাবে ভাষা আন্দোলনে শরিক হতে পেরেছিলেন। একুশের দুপুরে পুলিশ তাঁর চোখের সামনেই মেডিক্যাল ছাত্রাবাস ও ব্যারাকে প্রবেশ করে নিরস্ত্র শিক্ষার্থীদের ওপর গুলি চালায়। এর ফলে আন্দোলনের চরিত্রটাই পাল্টে যায়। ‘সেদিন রক্ত ঝরেছে বলেই ওরা আমাদের ভাষা কেড়ে নিতে পারেনি’ । রাতে মেডিক্যালের ছাত্রসংসদের ভিপি গোলাম মাওলার রুমে জরুরি সভা হয়। সেখানে তিনি উপস্থিত থেকে বিশেষ ভূমিকা পালন করেন। তিনিসহ অন্যরা ২২ ফেব্রুয়ারি মেডিক্যাল ব্যারাক হোস্টেল প্রাঙ্গণে শহীদদের গায়েবানা জানাজা শেষে বিশাল গণমিছিল নিয়ে গুলিস্তানের প্রধান সড়ক দিয়ে নবাবপুর হয়ে সদরঘাট পর্যন্ত যান। হাজারো মানুষ রাস্তার দুই পাশে দাঁড়িয়ে সেই মিছিলের সঙ্গে সহানুভূতি প্রকাশ করে।
তিনি বলেন, ‘২৩ ফেব্রুয়ারি রাতে ঢাকা মেডিকেলের ছাত্ররা গড়ে তোলেন প্রথম শহীদ মিনার। নকশা নেই, ইট নেই, বালু কিংবা কোনো নির্মাণ শ্রমিকও ছিল না। শুধু মনের জোরকে পুঁজি করে তাঁরা এতে হাত দেন। নকশা আঁকার ভার দেওয়া হয়েছিল বদরুল আলমের ওপর। এ কাজে তার দক্ষতা ও সক্ষমতা দুই-ই ছিল। সে যে নকশা নিয়ে আসে, শৈল্পিক ব্যঞ্জনায় তা অতীব সুন্দর; কিন্তু দুটি বাঁক থাকায় ঢালাইয়ের প্রয়োজন হবে বলে এক রাতে শেষ করা যাবে না। এই পরিস্থিতিতেই আমি জড়িয়ে পড়ি কাজটার সঙ্গে।

আমি একটা মোটামুটি নকশা দেখালাম বরুকে (বদরুল আলমের ডাকনাম)। খুব সাদামাটা একটা স্থাপত্য পরিকল্পনা—একটা বড়সড় ছয়তলাবিশিষ্ট কিউব বা ঘনক্ষেত্র (৬ র্ × ৬ র্ × ৬ র্); এর বারোটা কিনারা—একেকটা ৬ ফুট পরিমাপের এবং ছয়টা তল বা সারফেসের মাপ ৬ র্ × ৬ র্। এই কিউবটার নিম্নতল বসানো থাকবে আরেকটা স্থাপনার ওপরে, যা মূল স্তম্ভের বেদি হিসেবে কাজ করবে এবং সব পাশে প্রধান কিউবটাকে ছাড়িয়ে যাবে। বেদি হিসেবে ব্যবহৃত হওয়ার জন্য এটা মাটির ওপরে থাকবে এক ফুট এবং মাটিতে প্রোথিত থাকবে পাঁচ ফুট। প্রধান কিউবটার উপরিতলকে—ইটের মাপের ওপর নির্ভর করে—দুটি ছোট ভাঁজ দিয়ে নিয়ে এসে স্তম্ভের সর্বনিম্ন অংশ তৈরি করবে। এখন এই ছোট করে আনা উপরিতলের ওপরে একটা প্রলম্বিত পিরামিড থাকবে, যা ক্রমেই শীর্ণ হয়ে এগারো ফুটে গিয়ে শেষ হবে।’
‘এই সহজ-সরল প্ল্যানটা শুধু ইট-সিমেন্টেই শেষ হবে বলে সহজসাধ্য। বদরুল আলম বরুরও পছন্দ হলো। দুজন মিলে যে নকশাটা করি তা মেডিকেলের ভিপি-জিএসসহ সাধারণ শিক্ষার্থীদের সবাই পছন্দ করলেন।’
‘২৬ তারিখে এই শহীদ মিনারকে দড়ি দিয়ে, কাছি দিয়ে, ভেঙে উপড়ে ফেলে নিয়ে গেল পাকিস্তান সেনাবাহিনী। শেষ টুকরো টুকরো ওখান থেকে অপসারণ করে নিয়ে গেল। কিন্তু আমাদের সেই স্মৃতির মিনার তারা ভাঙতে পারেনি। এটা আমাদের প্রতিবাদের প্রতীক হয়ে রইল। প্রতিটা জাতীয় ইস্যুতে আমরা এই শহীদ মিনারের কাছে ছুটে যাই। আমাদের সব সমস্যার সমাধান খুঁজি। ’
তিনি আরো বলেন, ‘ বিভিন্ন সরকার ভাষা আন্দোলন ও ভাষাসৈনিকদের ব্যাপক মূল্যায়ন করেছে। এর বাইরেও কিছু বিষয় চোখের আড়ালে রয়ে গেছে। যেমন ভাষা আন্দোলনের সময় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রসংসদের সাধারণ সম্পাদক শরফ উদ্দিন আহমেদ কে এখন পর্যন্ত ভাষাসৈনিক হিসেবে একুশে পুরস্কার দেওয়া হয়নি। তাঁর পরিবার অনেক চেষ্টা করেও সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করাতে পারেনি। এমনকি আমি গত বছর ২৪ অক্টোবর তাঁকে মরণোত্তর পুরস্কার দেওয়ার জন্য লিখিতভাবে সংস্কৃতিবিষয়ক মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছি। তাঁর মতো এমন অনেক খ্যাতনামা ভাষাসৈনিক এখন পর্যন্ত একুশে পদক পাননি।’
ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের তৎকালীন ছাত্রনেতা ও ভাষাসৈনিক আলী আসগর ও মামুনুর রশিদও আছেন তাঁদের মধ্যে। তাঁরা রামপুরা ও বনানীতে জীবনের শেষ দিনগুলো কাটাচ্ছেন। অথচ মৃত্যুর আগে তাঁরা ভাষাসৈনিক হিসেবে একুশে পদক পেলে খুশি হতেন।
ভাষা আন্দোলনের সময় শুধু পাঁচজনই শহীদ হননি। এর বাইরেও নাম-ঠিকানা ও পরিচয়বিহীন অনেকে শহীদ হয়েছিলেন। কিন্তু আমাদের ব্যর্থতা হলো আমরা তাঁদের পরিচয় খোঁজার চেষ্টা করিনি। যার কারণে তাঁদের মূল্যায়নের পথ রুদ্ধ হয়ে গেছে। আমি মনে করি, এখনো চেষ্টা করলে ভাষা আন্দোলনের সময় পুলিশের গুলিতে নিহত বেওয়ারিশ শহীদদের পরিচয় খুঁজে পাওয়া সম্ভব।’

সবশেষে এই প্রবীণ ভাষাসংগ্রামীর ছোট্ট নিবেদন, ‘কয়েক সপ্তাহ আগে উদীচী শিল্পীগোষ্ঠীর ২০তম জাতীয় সম্মেলন উদ্বোধন করতে শহীদ মিনারে গিয়েছিলাম। শহীদ মিনারের আবিল পরিপার্শ্ব, অস্বাস্থ্যকর পরিবেশ আমাকে দুঃখ দিয়েছে, বেদনাক্লিষ্ট হয়েছি, লজ্জা পেয়েছি। শহীদ মিনার এক বিশিষ্ট ঐতিহাসিক স্থাপনা, যা দেখতে দেশি-বিদেশি পর্যটক আর দেশের শিক্ষার্থীরা নিয়ত আসে এখানে। আদি নকশামাফিক এর পরিমার্জন, পরিবর্ধন না-ও করতে পারি—আমরা একে ছায়ানিবিড় সবুজের উদ্যানঘেরা পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন দৃষ্টিনন্দন নিরাপদ স্থাপনায় রূপ দিতে কি পারি না? এ প্রশ্ন সরকার, গণমাধ্যম ও চিন্তাশীল সবার কাছে।’