ফিশারিজ মানেই সেখানে পানির সংযোগ। আর আমরা সবাই জানি পৃথিবীর ৭১ ভাগ জল আর ২৯ ভাগ স্থল। আর বাংলাদেশ তো নদীমাতৃক আগে থেকেই আছে, সাথে বাংলাদেশের আয়তনের সমান নতুন এক সমুদ্রঅঞ্চল বিজয় হয়েছে। সাবজেক্টের নাম শুনলে হয়তো সবার মাথায় যে জিনিস প্রথম ঢুকে সেটা হল মাছ নিয়ে পড়ে আর কি হবে? বড়জোর ফিশারি করব! আসলে কি তাই? সম্ভাবনাময় সাবজেক্ট নিঃসন্দেহে!
মৎস্যক্ষেত্র ও সম্ভাবনা:
নদীমাতৃক এই দেশে ফিশারিজ পড়ার সুবিধা প্রচুর। বাংলাদেশ হল ৪র্থ বৃহত্তম মাছ উৎপাদনকারী দেশ। আর ২৫-৩০ বছর পরেই হয়তো দেশে আর নদী ও বিলের মাছ তেমন পাওয়া যাবে না। তখন দেশের ৬৫ ভাগ প্রোটিনের চাহিদা যারা মেটাবে তারা হল ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েট। এই সাবজেক্টের অন্যতম আরেকটি সুবিধা হল এই সাবজেক্ট থেকে ডাইভারস করে অন্য সেক্টরেও যাওয়া যায়। আর ফিশারিজে শুধু মাছই নয় বরং অন্যান্য জলজ প্রাণীর চাষ করে অনেক লাভবান হওয়া যায়।
সম্ভাবনাময় মৎস্যক্ষেত্র
বাংলাদেশে মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে মৎস্য খাত থেকে দ্বিতীয় সর্বোচ্চ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জিত হয়ে থাকে। অন্যদিকে চিংড়ি প্রক্রিয়াজাতের ফ্যাক্টরিগুলোয় বর্তমানে মোট উৎপাদনক্ষমতার মাত্র ২০ শতাংশ ব্যবহৃত হচ্ছে যথেষ্ট পরিমাণ চিংড়ি সরবরাহ নিশ্চিত করতে না পারার কারণে। তাই চিংড়ির উৎপাদন বৃদ্ধির মাধ্যমে মৎস্য প্রক্রিয়াজাতের ফ্যাক্টরিগুলোর উৎপাদনক্ষমতার সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিত করতে মৎস্যবিজ্ঞান ভূমিকা রাখতে সক্ষম। পৌনে চার লাখ হেক্টর আয়তনের পুকুর ও ৯ হাজার ৬০ বর্গকিলোমিটার সমুদ্রসীমার দেড় কোটি মাছচাষির কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী অপার সম্ভাবনাময় খাতটি জিডিপিতে অবদান রাখছে প্রায় ৪ দশমিক ৬০ শতাংশ। জনসংখ্যার ১১ শতাংশ কর্মসংস্থান সৃষ্টিকারী খাতটি ৮৪ মিলিয়ন টন মাছ রপ্তানি করে প্রতিবছর আয় করছে ৪ হাজার ৩১৩ কোটি টাকা। গ্রামীণ জনপদের প্রতি পাঁচজনের চারজনই জলজ সম্পদের ওপর প্রত্যক্ষভাবে নির্ভরশীল। মৎস্যসম্পদ ও তত সংশ্লিষ্ট মানবসম্পদের যথাযথ ব্যবহারের পথ বাতলে দিতে সক্ষম ফিশারিজ। এ জন্যই মাছকে আরও সহজলভ্য ও সুলভ্য করার মাধ্যমে মানুষের পুষ্টি চাহিদা মেটাতে সক্ষম হবেন মৎস্যবিজ্ঞানীরা।
পড়াশোনা:
মানুষের পুষ্টি চাহিদা পূরণ ও উচ্চশিক্ষার মাধ্যমে মৎস্য সেক্টরকে এগিয়ে নিতে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৬৭ সালে প্রতিষ্ঠা লাভ করে মৎস্যবিজ্ঞান অনুষদ। বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়াও ঢাকা, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, খুলনা, সিলেট কৃষি, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কৃষি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, নোয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় ও বাকৃবির অধীন জামালপুরের শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব ফিশারিজ কলেজসহ প্রায় ১৪টি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে পাঠদান ও ডিগ্রি প্রদান করা হয়। এ ছাড়া কয়েকটি বিশ্ববিদ্যালয়ে মৎস্যবিজ্ঞান বিষয়ে উচ্চতর ডিগ্রি প্রদানের প্রক্রিয়া চলছে।
উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানসমূহ:
ভাল স্কোর নিয়ে বি.এস-সি ফিশারীজ (অনার্স) ডিগ্রী অর্জনের পর একজন গ্রাজুয়েট দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে নিম্নলিখিতভাবে যোগ দিতে পারেন-
- বৃত্তিসহ পোষ্ট গ্রাজুয়েট কোর্সে (যেমন এম.এস.) অংশগ্রহণ।
- বৃত্তিসহ গবেষণামূলক এমফিল/পি-এইচ.ডি. কোর্সে অংশ গ্রহণ।
- ফিশারীজ অনুষদে শিক্ষক হিসেবে যোগদান।
- রিসার্চ ফেলো বা গবেষণা সহকারী হিসেবে যোগদান।

কাজের সুযোগ:
নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের জন্য সময়োপযোগী আর প্রয়োজনীয় গবেষণা, সম্প্রসারণ ও উন্নয়ন কর্মকান্ডে প্রয়োজন প্রচুর পরিমাণ মৎসবিজ্ঞানে অভিজ্ঞতাসম্পন্ন জনবলের। এ ছাড়া মৎস্যসম্পদ আহরণ ও উৎপাদনক্ষেত্র, বিভিন্ন মৎস্য ও মৎস্যজাত দ্রব্য উৎপাদন ও রপ্তানি প্রতিষ্ঠান, মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতে ব্যবহৃত নানাবিধ উপকরণ উৎপাদনসংশ্লিষ্ট শিল্প-কারখানার বিস্তৃতির ফলে মৎস্য খাতে সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক কর্মসংস্থানের, যা ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফিশারিজ গ্র্যাজুয়েটদের রয়েছে অফুরন্ত কাজের সুযোগ।
সরকারী সংস্থাসমূহ:
বাংলাদেশ সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা/অফিস সমূহে ফিশারিজ গ্রাজুয়েটের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যথা-
- মৎস্য অধিদপ্তর, মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়।
- বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ গবেষণা কেন্দ্র (বিএফআরআই) ও এর শাখা ও উপকেন্দ্রসমূহ।
- বাংলাদেশ মৎস্য সম্পদ উন্নয়ন কেন্দ্র (বিএফডিসি) ও এর শাখা কেন্দ্রসমূহ।
- বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কেন্দ্র (বিএআরসি বা বার্ক)।
- ফিশারিজ ও ফিশারিজ সংশ্লিষ্ট একাডেমী ও প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।
এছাড়াও মৎস্য ও প্রাণী সম্পদ মন্ত্রণালয়কে সহায়তাকারী বেশ কয়েকটি মন্ত্রণালয় ও এর অধীনস্থ বিভিন্ন সংস্থা/দপ্তর সমূহে ফিশারিজ গ্রাজুয়েটদের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন-
- পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়
- যুব ও ক্রীড়া মন্ত্রণালয়
- ভূমি মন্ত্রণালয়
- স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়
- সেচ, পানি উন্নয়ন ও বন্যা মন্ত্রণালয়
- শিক্ষা মন্ত্রণালয়
- বাণিজ্য মন্ত্রণালয়
- শিল্প মন্ত্রণালয়
- অর্থ মন্ত্রণালয়
- পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়
- শিপিং মন্ত্রণালয়

বেসরকারি সংস্থাসমূহ:
দেশের বিভিন্ন এনজিও এর নানা ধরণের আত্মনির্ভরশীল উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ডের অন্যতম একটি হচ্ছে ফিশারিজ খাত। যেমন- বিভিন্ন মাছের একক ও মিশ্র চাষ, নার্সারি ব্যবস্থাপনা, বাওড় মৎস্য ব্যবস্থাপনা ও উন্নয়ন ইত্যাদি। এই সকল খাতে ফিশারিজ গ্রাজুয়েটের কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন-
- বাংলাদেশ রুরাল এ্যাডভান্সমেন্ট কমিটি (ব্রাক)
- প্রশিকা মানবিক উন্নয়ন কেন্দ্র
- গ্রামীণ ব্যাংক
- আরডিআরএস
- বাঁচতে শেখা
- টিএমএসএস
- এসোসিয়েশন ফর সোশ্যাল এডভান্সমেন্ট (আশা)
আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহ:
বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের মতো আমাদের দেশেও ফিশারিজ বিষয়ক কার্যক্রম পরিচালনা করে থাকে যেখানে ফিশারিজ গ্রাজুয়েটের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে। যেমন-
- ওয়ার্ল্ড ফিস সেন্টার
- ডিপার্টমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল ডেভেলপমেন্ট (ডিএফআইডি)
- ফাও (এফএও)
- ইউএনডিপি
- কেয়ার ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশ
- কারিতাস বাংলাদেশ
- নেচার কনজারভেসন মুভমেন্ট
- এশিয়ান ওয়েটল্যান্ড ব্যুরো
- ডানিডা (ডিএএনআইডিএ)
- সোসাইটি ফর কনসারভেসন অব নেচার এন্ড এনভায়রনমেন্ট (এসসিওএনই)
- ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনসারভেসন অব নেচার এন্ড ন্যাচারাল রিসোর্স (আইইউসিএন)
- সাউথ এশিয়া পার্টনারশিপ বাংলাদেশ (এসএপি)
ব্যক্তিগত খাতসমূহ:
ব্যক্তি পর্যায়ে গড়ে ওঠা নিম্নে প্রদত্ত শিল্পসমূহে যোগদান করা যেতে পারে-
- মৎস্য খামার
- মৎস্য হ্যাচারি
- মৎস্য খাদ্য প্রস্তুতকারী কোম্পানিসমূহ
- মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পসমূহ

প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ:
স্বল্প ও দীর্ঘ মেয়াদী বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রোগ্রামে ফিশারিজ গ্রাজুয়েটের অংশ নেয়ার সুযোগ রয়েছে। যেমন-
সরকারী অর্থায়নে বাস্তবায়িত বিভিন্ন প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ
আন্তর্জাতিক সংস্থাসমূহের (ডিএফআইডি, ইউএস এইড, ডানিডা ইত্যাদি) উদ্যোগে বাস্তবায়িত প্রকল্প ও প্রোগ্রামসমূহ
ব্যাংকসমূহ:
বিভিন্ন ব্যাংকের ফিশারিজ বিষয়ক ঋণপ্রদানের সেকশনে কাজ করার সুযোগ রয়েছে। যেমন-
- বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক
- রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংক
- সোনালী ব্যাংক
- অগ্রণী ব্যাংক
- রূপালী ব্যাংক
- জনতা ব্যাংক
- সমবায় ব্যাংক
- কর্মসংস্থান ব্যাংক
আত্মকর্মসংস্থান:
বি.এস-সি. ফিশারিজ (অনার্স) ডিগ্রী অর্জনের পর একজন ফিশারীজ গ্রাজুয়েট নিজেই তার কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করতে পারেন। অর্থ যোগানোর জন্য দেশের বিভিন্ন ব্যাংকসমূহে ঋণের সুযোগও রয়েছে। প্রথমে স্বল্প পরিসরে উদ্যোগ গ্রহণের মাধ্যমে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার পর সে প্রচেষ্টাকে বৃহৎ পরিসরে বর্ধিত করে নিশ্চিতভাবেই অন্যদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করাও ফিশারিজ গ্রাজুয়েটের পক্ষে সম্ভব। যেমন-
- হ্যাচারি ও রেণু উৎপাদন
- পোনা ও টেবিল-সাইজ মৎস্য উৎপাদন
- মুক্তা উৎপাদন
- কাঁকড়া উৎপাদন
- বাহারি মাছের রেণু ও পোনা উৎপাদন
- মৎস্য খাদ্য উৎপাদন
- মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ
- মৎস্য সংশ্লিষ্ট সরঞ্জাম (যেমন- জাল) উৎপাদন
- চাষকৃত পুকুর/দিঘীতে মৎস্য শিকার প্রতিযোগিতা আয়োজন
- মৎস্য পর্যটন (ফিশারিজ হটস্পট যেমন- সুন্দরবন, কাপ্তাই লেক, হাকালুকি হাওর, চলন বিল, মেঘনার ইলিশ অভয়াশ্রম ইত্যাদি স্থানে ফিশারিজকে গুরুত্ব দিয়ে পরিদর্শনের আয়োজন। আবার বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে কোর্স অনুযায়ী শিক্ষা সফরের আয়োজন)
- মৎস্য রোগ প্রবণ এলাকায় মৎস্য ক্লিনিক স্থাপন
- অনলাইন মৎস্য তথ্য কেন্দ্র পরিচালনা
দেশের বাইরে:
দেশের বাইরেও মৎস্য বিষয়ক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে একজন ফিশারিজ গ্রাজুয়েট যোগ দিতে পারেন। যেমন-
ইউরোপ, আমেরিকা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান, চীন, কোরিয়া, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া ইত্যাদি দেশের বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে বৃত্তিসহ উচ্চশিক্ষা (যেমন- এম.এস., এম.ফিল., পি-এইচ.ডি., ডি.এস-সি. ইত্যাদি) গ্রহণের সুযোগ রয়েছে।

পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিশেষত গল্ফ ও আফ্রিকা অঞ্চলের দেশসমূহে মৎস্য চাষ ও মৎস্য প্রক্রিয়াজাতকরণ শিল্পে মৎস্য পেশাজীবীর চাহিদা রয়েছে।
তাই যারা ভাবছেন এই সাবজেক্টে পড়ে কি হবে, তারা এখনি তা মাথা থেকে ঝেড়ে ফেলো। কারণ এই সাবজেক্টে পড়ে যারা মোটামুটিও রেজাল্ট করে, তারা ভাল চাকরির পেছনে নয় বরং ভাল চাকরি তাদের পেছনে দৌড়ায়। তাই চিন্তার কোনই কারণ নেই।
মোট কথা, ফিশারিজ এমন একটি সাবজেক্ট যার মাধ্যমে শুধু নিজেকে দেশেই নয় বরং বাইরেও সমানভাবে উন্নতির শিখরে পৌছাতে পারবেন।
তাই সিদ্ধান্তহীনতায় ভুগতে হবে না।
তবে একটা কথা মনে রাখতে হবে, ফিশারিজ সাবজেক্টে পড়লে কখনো নিজেকে পিছনে ফিরে তাকাতে হবে না এটা যেমন সত্য তার চেয়ে বড় সত্য পরবর্তীতে আপনার পরিশ্রম, মেধা, একাগ্রতা আর আপনার স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্য প্রতিটি সময়ের সঠিক ব্যবহার করার।